• Wed. Nov 20th, 2024

কোরবানির মাংস সংরক্ষণ ও রান্নার সেকাল-একাল ( আফরিন শাহনাজ )

ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত তিনদিন ধরে ঈদুল আজহা পালন করা হয়। আরবি ‘কুরবান’ শব্দটির অর্থ নৈকট্য। আল­াহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সহী তারিকায় যে পশু জবেহ করে উৎসর্গ করা হয় তাকে কুরবানি বা কোরবানি বলে। কোরবানি মুসলমানদের একটি ধর্মীয় ইবাদত এবং সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময় কোরবানি করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াত্তমূল আজহা’ বলা হয়ে থাকে। রাসুলুল­াহ (সা:) একে ‘ঈদুল আজহা’ নামকরণ করেছেন। এছাড়াও এই উৎসবটিকে ‘ইয়াত্তমূল নহর’ও বলা হয়। ঢাকায় এই ঈদের নাম ‘বকরি ঈদ’। সহজলভ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বিবেচনা করে এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা সবসময় গরুকেই কোরবানির পশু হিসেবে বেছে নিতে চাইতেন। তবে ভিন্নধর্মীয় বাধা নিষেধ ও সংস্কারের কারণে কোরবানির পশু হিসেবে খাসি বা ছাগলও তারা কোরবানি করতেন। উনিশ শতকের হিন্দুত্ববাদের জাগরণ ও প্রভাবশালী জমিদারদের কারণে সেটাও সম্ভব হতো না।

আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন: ‘বকরা ঈদে গরু কোরবানি কেউ করত না। জমিদারদের তরফ থেকে এটা কড়াকড়িভাবে নিষেধ ছিল। খালি বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করতও তা প্রচুর। বিশেষ করে হিন্দু জমিদারি অঞ্চলে গরু কোরবানি দেয়া প্রায় অসম্ভব ছিল এবং এ সম্পর্কে তারা বৈরী মনোভাব পোষণ করতেন। হিন্দু ধর্মে কোথাও নেই যে, গরু খাওয়া যাবে না, তবে সংস্কারে আছে। আবার মুসলমান ধর্মে কোরবানি (গরু) বিধান আছে, কিন্তু সংস্কারের কারণে তা হতো না।’ কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন চলেনি। ফরায়েজি আন্দোলনে এ অবস্থার পরিবর্তন এনেছিল। ইসলাম ধর্মের এই লোকজ উপাদানের অধিপত্য এবং অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু রীতিনীতির উপর ফরায়েজি আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল প্রবল অভিঘাত। এ সময়ই বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে।

আবার ব্রিটিশ আমলে ভারত জুড়ে গরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে ধর্মীয় দ্ব›েদ্বর সূচনা তার প্রকট রূপ পূর্ববঙ্গের জমিদাররা মুসলমান প্রজাদের কোরবানি দিতে বাধা দিতেন এবং দিন দিন এই সংকট গভীর থেকে গভীরতর আকার ধারণ করেছিল। সংঘাত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় সারস্বত পত্র (৩০ মার্চ ১৮৯০) লিখেছে : ‘এটা সত্যি যে, ঢাকার সমাজের অনেক ত্র“টি ও দুর্নাম আছে। কিন্তু এখন দেশে গরু কোরবানি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন চলছে, সে সময় ঢাকা এসব থেকে মুক্ত। ঢাকার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে নিখুঁত ভাল সম্পর্কই বিদ্যমান ছিল। উভয়ে উভয়ের ধর্মীয় উৎসবাদিতে যোগ দেয় এবং কেউ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে চায় না। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের উচিত ঢাকাকে অনুসরণ করা।’

মাংস রান্না-খাওয়া, বিতরণ ও সংরক্ষণ কোরবানি ঈদের মূল অনুষঙ্গ। সংরক্ষণ সম্পর্কে আলোচনার আগে আমরা মাংস রান্না এবং খাওয়ার ইতিহাস জেনে নেই। প্রাচীন বাংলায় নানারকমের পাখির মাংস খাওয়ার চল ছিল। সেকালে হরিণের মাংস বাঙালির খুব প্রিয় ছিল। ছাগলের মাংস সমাজের সব স্তরেই ছিল বহুল প্রচলিত। বাংলার কোনে কোনো প্রান্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্ভবত শুকনো মাংসখাওয়ার চল ছিল। পাহাড়পুর এবং ময়নামতিতে পোড়ামাটির ফলকে কোনো পুরুষের শিকার করা হরিণ কাঁধে করে ঘরে ফেরার দৃশ্যও দেখা যায়। মধ্যযুগেও বাঙালির হেঁসেলে মাংস নিষিদ্ধ ছিল না। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কেবল দেবদেবীর পুজোয় অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করা মাংস খেতেন। মাংস রান্নার অনেক বৈচিত্র মঙ্গলকাব্যে রয়েছে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে পাই-

‘কচি ছাগ মৃগমাংসে ঝাল ঝোল রসা।

কালিয়া দোলমা বাঘা সেচকি সমসা?

অন্য মাংস শিক ভাজা কাবাব করিয়া।’

সপ্তদশ শতকে মুসলমান বাঙালির মধ্যে কী ধরনের মাংসের চল ছিল তার বিবরণ পাই কবি আবদুল হাকিমের ‘লালমোতি সাইফুল-মূলক’ কাব্যে-

‘উট, গাভী, মেষ, ভেড়া, দুম্বা, অজা, খাসী

অন্নের সহিতে মাংস রান্না রাশি রাশি?’

বিরিয়ানি বা পোলাওয়ের চল হয়েছে ততদিনে। রাঢ় বাংলার ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর সময়ে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার চল ছিল। তবে গো-মাংস বিক্রেতা কসাই হিসেবে নিন্দিত হতো-

‘গো-মাংস বেচিয়া নাম ধরয়ে কসাই।

এই হেতু যমপুরে তার নাই ঠাঁই?’

মোরগের মাংস মুসলমানেরা খেতেন এবং তারা মোরগ জবাই করার জন্য মোল­াকে কিছু সম্মানীও দিতেন। মোল­া বকরি জবাই করলে ছয় বুড়ি দান এবং বকরির মাথা পেতেন। প্রাচীন বা মধ্য যুগের মাংস রান্নার সঙ্গে আজকের মিল খুঁজে লাভ নাই। মুসলমানরা এদেশে আসার পর থেকে মাংস রান্নার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের মাংস রান্নার প্রকরণ এখন বাঙালির হাতের মুঠোয়।কোরবানিতে যে পশু আল­াহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয় তার মাংস তিনভাগ করা হয়। একভাগ গরিব-দুঃখীদের মধ্যে, একভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আর একভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা হয়। আবার আত্মীয়-স্বজন যারা কোরবানি দেন তাদের বাড়ি থেকেও মাংস আসে। এইভাবে ঈদের দিন খাওয়ার পরও অনেক মাংস রয়ে যায়। তখন মাংস সংরক্ষণের তাগিদ অনুভব হয়।

এবার আসি মাংস সংরক্ষণ প্রসঙ্গে। যখন ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটরের প্রচলন ছিল না তখন কুরবানির পর মাংস (রান/সিনা) সাধারণত ঝুলিয়ে রাখা হতো। এতে মাংসের ভেতরের সকল রক্ত ঝরে গিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ উপযোগী হতো। এখনো এ পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবেই নিজস্ব এনজাইমের ক্রিয়ায় মাংসের আঁশগুলো নরম হয়ে যায় এবং মাংস আরো সুস্বাদু হয়। তবে মাংস সংরক্ষণের জন্য সঠিক তাপমাত্রা জরুরি। এভাবে সংরক্ষণের জন্য ৩৩ থেকে ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। আবার ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে মাংসে দ্রুত পচন ধরে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা মাংস ঝুলিয়ে রাখা হলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাংস যত শুকনা হবে এর সংরক্ষণকাল তত বৃদ্ধি পাবে।

ষাটের দশকে ঢাকাবাসী মাংস সংরক্ষণের নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত মাংসগুলোকে হাড়হীন বড় বড় টুকরো করে আদা রসুন পেঁয়াজের রস সহযোগে এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে মোটা করে কাটা আদার টুকরো, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ দিয়ে চর্বিতে ডুবুডুবু অবস্থায় অল্প আঁচে কয়েকদিন ধরে একবার করে রান্না করা হতো। প্রায় তিন মাস ধরে এগুলো ভালো থাকতো। চর্বিতে ডুবানো এই মাংস খুবই সুস্বাদু। মহররম মাস পর্যন্ত রাখা যেত। তিন মাস ধরে খাওয়া হলেও মহররম মাসের ১০ তারিখে বাকরখানি বা নিমসুখা বা পরোটার সঙ্গে এই মাংসখাওয়া বিশেষভাবে তৃপ্তিকর। এক সময় এ প্রক্রিয়ায় রান্না করা মাংসকে ‘জাহাজি কোর্মা’ বলা হতো। এ রান্নাটি আজও খুব জনপ্রিয়। আগে ঢাকা থেকে আরব, ইরাক, ইরান পথে হজ্জ্বযাত্রী বা বণিকেরা জাহাজে সমুদ্রপথে যাতায়াত করতেন। জাহাজি কোর্মার সৃষ্টি হয় সমুদ্রপথের যাত্রীদের খাবারের চাহিদা পূরণের জন্য।

এছাড়া কোফতা করে মাংস রাখার রীতি ছিল। কাঁচা মাংস শিলপাটায় পিষে গুঁড়ো গরম মসলা আদা রসুন বাটা মিশিয়ে দুই হাতের তালু দিয়ে গোল গোল আকৃতি করে চর্বিতে ডুবিয়ে জ্বাল করে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে রাখা যেত। কোফতা ডুবানো চর্বি দিয়ে তেহারি রান্না করার প্রচলন ছিল। কোফতা দিয়ে তেহারি খাওয়া হতো।

মাংস সংরক্ষণের আর একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলো কিউরিং বা সল্টিং। অণুজীবের হাত থেকে রক্ষা করতে মাংস থেকে পানি অপসারণের নাম হলো কিউরিং। বাজারে কিউরিং সল্ট পাওয়া যায়, তার সাথে সোডিয়াম নাইট্রেট যোগ করা হয়। ফ্রিজ আবিষ্কারের পূর্বে এই পদ্ধতি অধিক জনপ্রিয় ছিল। বাড়ির মহিলারা নিজস্ব পদ্ধতিতে মাংস কিউরিং করতেন। এর একটি চিত্র দেখতে পাই কনিজ মাওলার ‘মাংসের ঝুরি’ প্রবন্ধে:

‘সেই সময়ের তাগিদে উদ্ভব হয়েছিল যে রান্নার কথা বলছি এবার। এই রান্না একদিকে মাংস সংরক্ষণ করছে আর অন্যদিকে অতি সুস্বাদু এক মাংসের পদ প্রস্তুত করেছে। প্রথমে মাংসকে ভালো করে ধুয়ে, জল ঝরিয়ে, লবণ মাখিয়ে রেখে দিতে হবে। যখন লবণ সম্পূর্ণভাবে মাংসের সঙ্গে মিশে যাবে, তখন সে পাত্রের নিচে জল আর লবণের এক মিশ্রণ দেখা যাবে। এবার সেই পাত্রকে উনুনে বসিয়ে গরম করতে হবে যতক্ষণ না জলটা পুরো শুকিয়ে যায়। তারপর সেই পাত্র নামিয়ে ঠান্ডা করতে দিতে হবে স্বাভাবিকভাবে- ফ্রিজ নেই কিন্তু। এরপর প্রতিদিন ঐ মাংস গরম করতে হবে অল্প তাপে। কোনও জল ঢালা যাবে না। ক্রমাগত নাড়তে হবে তিনটি কারণে। প্রথম কারণ, তাতে মাংস পাত্রে লেগে গিয়ে পুড়বে না; দ্বিতীয় কারণ মাংসের মধ্যে যে চর্বি থাকে তা বেরিয়ে আসবে এবং মাংস তাতেই সিদ্ধ হবে। তৃতীয় কারণ ক্রমাগত নাড়ার ফলে মাংস-টি ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়। এইটি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া- পাশ্চাত্য দেশে অনেকটা এভাবেই কোল্ড মিট তৈরি হয়।’

এই মাংস দিয়েই কিন্তু পরবর্তীতে তৈরি করা হয় চমৎকার স্বাদের মাংসের ঝুরি ভাজা। আরেকটি বহুল প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতি হলো ডিহাইড্রেশন। অল্প আঁচে মাংস জ্বাল দিয়ে শুকানো মাংস সংরক্ষণ একটি প্রাচীন পদ্ধতি। এভাবে সংরক্ষণ করতে চাইলে মাংস ছোট ও পাতলা টুকরো করে নেয়া হয়। মাংস থেকে অতিরিক্ত চর্বিও ফেলে দেয়া হয়। এরপর জ্বাল দিয়ে বা রোদে শুকিয়ে মাংস থেকে পানি দূর করা হয়। ফলে মাংসের পচনের জন্য দায়ী অণুজীবের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে শুকনো মাংসকে পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণ করতে আররেফ্রিজারেশনের প্রয়োজন নাই। বায়ুমুক্ত কনটেইনার বা প্লাস্টিকের ব্যাগে এভাবে দুই মাস বা তার অধিক সময় পর্যন্ত মাংস সংরক্ষণ করা যাবে। তাছাড়া ছোটবেলায় বড় বড় হাড়িতে অনেক মাংসে হলুদ লবণ মাখিয়ে প্রতিদিন জ্বাল দিয়ে দিয়ে বাড়ির মহিলাদের দেখতাম মাংস সংরক্ষণ করতে। এই প্রক্রিয়ায় চর্বির পরিমাণ বেশি থাকতো। মাংস চর্বিতে ডুবে থাকলে বেশিদিন ভালো থাকে। সেই মাংস খাওয়ার মজাও ছিল আলাদা। দশ/বারোদিন প্রতিদিন জ্বাল দেয়ার পরে মাংসের আঁশ খুলে আসে। তার স্বাদও হয়ে যায় অসাধারণ। এই মাংস গরম ভাত বা রুটি দিয়ে খেতে ভীষণ উপাদেয়। এছাড়া মাংস আচার করে, ভেজেও মাংস সংরক্ষণ করা যায়। আর রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করলে মাঝারি টুকরো করে রক্ত ঝরিয়ে রাখাই উত্তম।

ঈদুল আজহা উদযাপনের বড় আকর্ষণ হলো ঈদের রান্না, বিশেষত মাংসের বিভিন্ন পদ রান্না করা। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় কোরবানি ঈদে অধিক সংখ্যক পশু কোরবানি করা হতো। ঈদের দিন মাংস বড় বড় টুকরা আকারে রান্না করা হতো। সুফি পারেশ ইসলাম (অধ্যাপক পারেশ ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ঈদের দিনের বংশালের মাংস এক বিশেষ আকর্ষণ বলে অভিহিত করেছেন। কোরবানির ঈদে খাসির মাংসের সাথে নুনিয়া (নোনতা) শাক রান্না করার রীতি প্রচলিত ছিল। এছাড়া কাবাব, মুরগির রোস্ট, মাংসের রেজালা, কোরমা রান্না করা হতো। এ সমস্ত রান্না এখনো হয়। কোরবানির খাসি বা গরুর মাংস দিয়ে প্রস্তুত হয় বটি কাবাব, কলিজি কাবাব, তিলি­ ভুনা, গুরদা ভুনা, কিমা, মগজ, নেহারি, কোপ্তা, চপ, খাসির মাথা ডাল দিয়ে রান্না, শিক কাবাব ইত্যাদি। এছাড়াও হয় বিরিয়ানি, তেহারি, পোলাও। এর বেশিরভাগ খাবারই মোঘল বা বাদশাহি রান্না থেকে এসেছে। তবে মোগল আমলের আগে ভারতবর্ষে বাদশাহি রান্না শুরু হয়েছিল। এর প্রমাণ হলো খিলজি বংশের তুর্কি সুলতান গিয়াসুদ্দিন ও তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিনের রান্নার বই ‘নেয়ামতনামা’। বাদশাহি রান্নার প্রথমেই রয়েছে বিরিয়ানি এবং পোলাও। মূল ফারসি শব্দ বিরিয়ান বা বুরিয়ান থেকে বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে। বিরিয়ান শব্দের অর্থ ভাজা বা ঝলসানো। ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন প্রদেশে স্বাদের পার্থক্য অনুযায়ী নিজের মতো রূপ ধারণ করেছে। যেমন: হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, অওয়াধি বিরিয়ানি, ক্যালকাটা বিরিয়ানি, ঢাকাই বিরিয়ানি ইত্যাদি। রান্নার কৌশল অনুসারে বিরিয়ানি আবার দুইরকম হয়। পাক্কি বিরিয়ানি ও কাচ্চি বিরিয়ানি। পাক্কি বিরিয়ানি বানাতে হলে মাংস, আলু, চাল আলাদা আলাদা করে রান্না করে নিতে হয়। তারপর হাড়িতে এক স্তরে ভাত, এক স্তরে মাংস এরকম করে সাজিয়ে পাত্রের মুখ সিল করে দমে দিতে হয়। আবার কাচ্চি বিরিয়ানি হলে একসঙ্গে চাল, মাংস সব মিশিয়ে দমে দিতে হয়। তবে কাচ্চি বিরিয়ানি বানানোটা কৌশলের ব্যাপার এবং খেতেও  সুস্বাদু।

‘পিলাফ’ শব্দটি থেকে এসেছে পোলাও। ‘বুরিয়ান’ মানে হলো তুর্কি ও ম্যাসিডোনিয়ার একপ্রকার মাংস ভাত যাকে পিলাফও বলে। আলেকজান্ডারের স্ত্রী রুকসানা ওই অঞ্চলের মহিলা। পোলাও তাদের মাধ্যমেই ভারতে আসে এমন গল্পও শোনা যায়। ফারসি মূল উচ্চারণ পুলাও বা পিলাও। যদিও বিখ্যাত রন্ধনগ্রন্থ প্রণেতা বিপ্রদাসের মতটিও গ্রহণীয় মনে হয়। তাঁর ‘পাক-প্রণালী’ গ্রন্থে পলান্ন প্রকরণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘অতি প্রাচীনকাল হইতে এদেশে পলান্ন প্রচলিত আছে। সংস্কৃত গ্রন্থ পলান্নের নাম ও রন্ধনপ্রণালী দেখিতে পাওয়া যায়। মুসলমানদিগের সময় হইতে, পলান্ন এই শব্দের অপভ্রংশ পোলাও নামে প্রচলিত হইয়াছে। পল শব্দ মাংস এবং অন্ন শব্দে ভাত এই দুটি মিলিত হইয়া (অর্থাৎ মাংস ও ভাত একসঙ্গে পাক করা হইয়া থাকে বলিয়া) পলান্ন শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে।… মুসলমানদিগের রাজত্বকালে এদেশে পলান্ন এবং মাংস প্রভৃতির রন্ধনগত উন্নতি সাধিত হইয়াছে।’

প্রাচীন আরবি ভাষায় কাবাব্বা থেকে ফারসি শব্দ কাবাবের উৎপত্তি। ইবনে বতুতা সুলতানি আমলে দিলি­র বাবুর্চিদের হাতে কাবাব তৈরি হতে দেখেছেন। এই কাবাব মোগল আমলে নানান সু²তা যুক্ত হয়ে বিস্তারলাভ ঘটে এবং ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। অঞ্চলভেদে নাম ও রূপেরও পরিবর্তন ঘটে। নানা নামকরণ হয়। যেমন: সুতি কাবাব, কাঠি কাবাব, বোটি কাবাব, চেলো কাবাব, গিলৌটি কাবাব, শামি কাবাব, রেশমি কাবাব, টিক্কা কাবাব, হুসেনি কাবাব, চাপলি কাবাব, কাকোরি কাবাব, কলেজি কাবাব ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রন্ধন প্রশিক্ষক তথা ‘বেগমের বাদশাহি রান্না’ গ্রন্থপ্রণেতা মনিরা বেগম লিখেছেন, ‘মানুষের রান্না করা প্রাচীনতম খাদ্য কাবাব। গুহাবাসী আদিম মানুষ আগুন জ্বালাতে শেখার পর মাংস পুড়িয়েই খেতেন। সেই পোড়া মাংসকেই সূ²তর রূপ দিয়েছেন তুর্কি-ইরানি ও ভারতীয় মোগল সভ্যতা। কাবাবকে জনপ্রিয় করার মূলে অবশ্য তুর্কিরাই। ধারালো তলোয়ারে গাঁথা মাংস আগুনে পুড়িয়ে খেতেন তুর্কি সৈন্যরা। ক্রমে তলোয়ারের জায়গায় এলো লোহার তার এবং এখন সেটা হয়েছে শিক বা কাঠি। প্রথমদিকে লবণ ও বিশেষ কিছু গুল্ম দিয়ে ঝলসানো হতো মাংস, পরে নানারকম মসলার ব্যবহার করে বাড়ানো হয়েছে কাবাবের স্বাদ ও বৈচিত্র। এ ব্যাপারে মোগলদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তাঁরা কাবাবে আনলেন গোলাপজল, ক্যাওড়া, কস্তুরি, শুকনো ফল, পোস্ত ইত্যাদি বিভিন্ন মশলা ও সুগন্ধি। শুরুতে খোলা জায়গায় কাঠের আগুনে তৈরি হতো কাবাব, পরে তন্দুর, কয়লার উনুন ও গ্রিল এর প্রচলন হয়।’

বাদশাহি রান্নায় বিরিয়ানি, পোলাও, কাবাব ছাড়াও কোর্মা, কোপ্তা, রেজালা, হালিম ইত্যাদি মাংসের পদ আছে। কোরমার মসলাটা হয় সাদা। এতে হলুদ, মরিচের কোনো বালাই থাকে না। দুধ সহযোগে মিষ্টি করে রান্নার পদই হলো কোরমা। কোরমা তুর্কি শব্দ। তুর্কি মুসলমানদের মাধ্যমে এর আগমন। মাংস ছাড়াওডিম, পটল, মাছেরও একইভাবে কোরমা করা হয়ে থাকে। মাংসের কাচা কিমা ও সিদ্ধ কিমাকে একসাথে পাটায় পিষে ভাজা গরম মসলার গুঁড়ো সহযোগে গোল গোল বলের মতো করে তেলে ভেজে তৈরি হয় মাংসের কোফতা। কোফতা ফরাসি শব্দ।

গম, নানান রকমের ডাল, মাংস ও বেশ অনেক পদের মসলা যোগে ঢিমে আঁচে তৈরি হয় মজাদার হালিম। অনেক জায়গায় হালিমে সাতাশ/আটাশ পদের মসলা ব্যবহৃত হয়। শাহী রেজালা ছাড়া ঈদ উৎসবের কথা ভাবা যায় না। রেজালা শব্দটি রাজিল (নিম্নবিত্ত) থেকে এসেছে যেহেতু কর্মচারী শ্রেণির লোকেরা এই খাবার পছন্দ করত সেহেতু এই খাবারের নামকরণ হয় ‘রাজিলা’। পরে সেটা রেজালা উচ্চারণ হয়। মোগল খাবারে মরিচ ব্যবহৃত হতো না। কিন্তু প্রশাসনের কর্মচারী স্থানীয় লোকেরা ঝাল পছন্দ করতো। তাই কোরমাতে কাঁচামরিচের ব্যবহার করে রেজালা রান্না করা হতো। ক্রমেই অন্দরমহলের মহিলারা এই খাবারের ভিন্ন স্বাদ, গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।

এগুলো তো গেল বাদশাহি রান্না বা মোগল রান্না। এছাড়াও আছে বিখ্যাত সব আঞ্চলিক রান্না যেগুলো মূলত কোরবানির মাংস দিয়েই বেশি রান্না করা হয়। যেমন: চট্টগ্রামে মেজবানি মাংস, গরুর কালাভুনা, খুলনার চুইঝালে গরুর মাংস, সিলেটের সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস, ঝুরি মাংস, কড়াই গোস্ত, কাটা মসলায় মাংস রান্না ইত্যাদি। তবে এই রান্নাগুলোও কোনো না কোনোভাবে মোগল, ইংরেজ বা পাকিস্তানি রান্নাগুলো থেকে আমাদের বাঙালি রান্নায় রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন: বলতে পারি ইংরেজ আমলের স্টু রান্নাই পরবর্তী সময়ে আমাদের মুরগি বা খাসির পাতলা ঝোল। আবার কোরমার মসলার সাথে হলুদ, মরিচ যুক্ত করে বাঙালিকরণের নাম কালিয়া। আরো এসেছে বিফ ভিন্দালু, বিফ স্টেক, রেলওয়ে মাটনকারী ইত্যাদি। উৎসব প্রিয় বাঙালি মুসলমানের জীবন ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এলেও আজও ধর্মীয় উৎসব ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। তবে যোগ হয়েছে বহুমাত্রিকতা। সপ্তদশ শতাব্দীর সেই মোগল রাজধানী ঢাকারও হয়েছে আমূল পরিবর্তন। বিলুপ্তির পথে অনেক খাবার, অনেক খাবার বিলুপ্ত হয়েছে বহুদিন আগেই। খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাসের এই উভয়মুখী পরিবর্তন সংস্কৃতির ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবুও ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, মহররমকে কেন্দ্র করে উৎসব, ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের রেওয়াজ চলে এসেছে যুগের পর যুগ। তাই আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীদের নিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ আজও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি ধরে রেখেছে। 

তথ্যসূত্রঃ  রাইজিংবিডি.কম   

   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *