• Wed. Nov 20th, 2024

জীবনের সুখ দুঃখ কথকতা (সারাহবানু শুচি )

কতটুকু বা জীবন! তার সুখ দুঃখ কোথায়?
আসলে জীবনে সবকিছু মিলেমিশে থাকে।
সুখ খুঁজতে দুঃখ সন্ধান ঘটে।
সুখের ঘরে কখনও ঢোকে কালসাপ।
সারাজীবন হয় কন্টকময়।
কাটাঁহেরি ক্ষ্যান্ত কেন কমল তুলিতে- এমন প্রশ্ন অনবরত করে এগিয়ে যেতে হয়। জীবনে যতই প্রাপ্তি আসুক, শিশুকালই মানুষের কাছে সুখসময়।
জীবন তো ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক। পিছনে ফেরার উপায় নেই, তাই মানুষ শিশুকাল ফিরে পেতে চায়। বিশেষ করে শেষ জীবনে।
মানবজীবন দুধে ভাতে কাটে না। সেই জীবন আবার আনন্দময় করতে হয় নিজকেই। চেষ্টা থাকে সুখময় আর্বতে ঘূর্ণনে! আবার পরিণত বয়সে সোনার পালঙ্কে শুয়েও জীবন বিষবৃক্ষ সামান্য অবহেলায়। এত দুঃখ অনুভবের কারণ কি? সুখ দুঃখের কথা লিখতে মনে পড়ে শিশুকালের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কি ছিল? আসলে সবদিন-ই তো ছিল আনন্দের। তবে এই মূহুর্তে মনে পড়েছে ছোটবেলায় পাবনা হতে এসে ঢাকার বনগ্রাম লেনের ভাড়া বাড়িতে ছাদে বাচ্চা কোলে মা বাঁদরের অবাধ আগমন দেখে অবাক হয়েছি। বানরের বুকে আকঁড়ে বাচ্চা বানরের চুপচাপ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য মজা লাগা বা সুখের ভাব নিয়ে আসে মনে। কি শান্তি মাতৃক্রোড়ে! মা-ই যে আনন্দ ও সুখের চাবিকাঠি এটা প্রাণীজগতে প্রতিষ্ঠিত। শিশুবয়সে সব আনন্দ মায়ের আশেপাশে।
তাই মাকে ঘিরেই সব স্মৃতি। বেশি ভাগ আনন্দের।
পাবনার মামার বাড়িতে আমার জন্ম; সেখানে অনেক বছর থেকেছি। স্মৃতিতে উজ্জ্বল গরমে আম কাঠাঁল ভরা বাড়িতে আলুবোঝাই ঠেলাগাড়ি শীতের খেজুরের গুড়; মানুষজন গমগমা; সবাই খাচ্ছে একসাথে। এটাই যেন আনন্দ। খাবার খেতে টাকা লাগে জেনেছি অনেক পরে। তখন মনেও হয়নি খাবার চাই। সবসময়ই আনন্দদায়ক অবস্থায় ছিলাম এজন্য হয়তো বা। ঈদে নতুন কাপড় পেয়ে খুশি হবার কথা তেমন মনে পড়ে না। ঈদ নিজেই আনন্দ নিয়ে আসে। নূতন কাপড় কারা কেমন পেলো; এটা দেখতেই ভালো লাগতো।
তবে সুখ দুঃখের আলাপচারিতায় মনে পড়ে একবার নতুন জামা পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। জামাটি বানিয়েছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ যাদুমিয়ার ভাই সিধু কাকার বৌ, বিবি রাসেলের মা। তখন অবশ্য বিবি রাসেল জনপ্রিয় নয়। মানে তিনি তখন কিশোরী। বানু আপা, বিবি আপা ও আরেকটি বোন ওদের দেখতে বেশ লাগতো।
সিধু কাকা র‌্যাংকিঙ স্ট্রীট এ নতুন বাড়ি করেছেন। ঢাকায় এসেছি অল্পদিন; আমরা সেখানে খেলতে যেতাম। আমরা মানে আমি আমার বড়ো বোন শিরিন বানু মিতিল ও ফুপু চন্দন। চন্দন ফুপুর সাথে বিবির বেশ খাতির। আমার মা ছিলেন যুক্তফ্রন্টের সময়ে নির্বাচিত এমএলএ। সিধু কাকার সাথে মায়ের সাথে অনেক আগে যোগাযোগ। একদিন মা আমাদের ঐ বাসায় খেলতে যেতে নিষেধ করেন। আমরা নাকি খেলতে গিয়ে সিধু কাকার বাড়ির দেয়াল নষ্ট করি। কিন্তু বিবি খুব নরম মনের মেয়ে। সে আমাদের বলতো আমরা পুরোনো বাসায় খেলব। কিন্তু এরপরই ফুপু ও মিতিল আপা পাবনা চলে যান। আমরাও চলে আসি কে এম দাস লেন রোডের বাড়িতে। তবে যাবার আগে সিধু চাচীর হাতে বানানো একটি সুন্দর জামা পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম।
সে জামাটির দু’পাশে দুটি পকেট ছিল। পরে আমরা কুমিল­া চলে যাই। দীর্ঘদিন আর যোগাযোগ ছিল না ঐ পরিবারের সাথে। অনেকদিন পর বিবি রাসেলের সাথে দেখা হয়েছিল। চাচীর সাথে দেখা হয়নি। মৃত্যু সংবাদ শুনেও যেতে পারিনি। অথচ যাব বলেছিলেম। এজন্য দুঃখ বোধ হয়।
এরকম কত কথা দিয়েও রাখতে পারিনি।
যাক; আপাতত মায়ের কথাই বলি। মা বিয়ের আগে হতেই বিখ্যাত ছিলেন চলি­শের দূর্ভিক্ষে অনাহারী মানুষকে অন্ন দিতেন। তার মা; মানে নানীকে লুকিয়ে। নানী অকাল বিধবা, তিনি বিধ্বস্ত। স্বামীর অগাধ সম্পত্তি কিন্তু দেখাশোনার লোক নেই। মা খালাদের না খেয়ে থাকতে হয়। মানে খাবার শুধু ভাত। ধানের গোলায় ধান শুকিয়ে পড়ে। সেসব বিক্রি করে অন্যকিছু কেনা সেটি নানীর মাথায় নেই। মা ও খালারা দু’জনে দূর্ভিক্ষের দিন ধান বিলিয়ে দিতেন চুপচাপ। মানব সেবায় হাতেখড়ি।

পাবনার মামার বাড়িতে যে ঘরটিতে জন্ম হয়েছিল আমাদের দুবোনের, মা কেন যেন বারবার সে ঘরটি আমাদের দেখাতেন। হয়তো একসময় এটা ছিল মায়ের নিজের পড়ার ঘর।
সেখানে মায়ের পড়ার টেবিল ছিল। ঘরটি পুরাতন হয়ে গিয়েছিল। এখন ওটা আলু আর আম কাঁঠাল রাখার ঘর। সাথে বাচ্চাদের খেলার ঘরও। তবে সেখানে নাকি একসময় মায়ের পায়ের উপর সাপ নীরবে পার হয়ে গেছে। মা পড়তে বসেছিলেন। স্কুলের শেষের ক্লাসগুলির একটিতে তখন তিনি। ভাগ্যিস; মা ঠান্ডা বোধ হওয়ায় হঠাৎ পা নাড়াচাড়া করেননি। আমরা সচরাচর যা করি। তবে সাপের কথায় আমার মনে পড়ে গেল ঢাকায় এক বন্যায় আমাদের হাটখোলা রোডের বাড়ি পানি ওঠে। তখন বাবার ওষুধের কারখানা ছিল বাংলা মটরের কাছে। বতর্মান হাতিরঝিলের কাছে। তখন আমি পিঠে এক বোলতার কামড় খাই। বোলতা বলছি কিন্তু তখন সবাই ভেবেছিল সাপ। কারণ ক’দিন আগেই বড়ো একটি সাপ মারা পড়ে। এমন জায়গায় কামড় যে বাঁধ দেয়া সম্ভব নয়। আমি ভাঙা দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে, পিঠ ছিল দেয়ালে লাগানো। ভাঙা দেয়ালের ভিতরে সাপ থাকা অসম্ভব নয়। দুটি পাশাপাশি দাঁতের দাগও ছিল। তখন সবাই ভাবছে এই বুঝি মৃত্যুর লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে। সেসময় আমি হঠাৎই মজা পেলাম। তার মানে মরে যাব? মা ভয়ে কাঁপছেন। কেউ একজন বলেন ব্লেড দিয়ে পিঠ কেটে দিতে। মা তাই করলেন। চিমটি দিয়ে দেখলেন ব্যাথা পায় কি না! অবাক করা বিষয় সত্যি ব্যাথা লাগেনি। আমি ভয় পাইনি। আর সত্য যে সাপের কামড় মনে হলেও বেঁচে গিয়েছি।
এই মৃত্যু ভয় একাত্তরে হয়েছিল। তখনও ভয় হলেও পাকবাহিনী কিভাবে গুলি করবে এসব ভাবতে মৃত্যু ভয় কমে যায়। সেদিন পাকবাহিনী সামনের ঘরে ঢুকে অন্যদিকে চলে যায়। তখন হঠাৎই এক কোরাণ শরীফ হাতে পাই। মৃত্যুর আগে পাঠ করছিলাম প্রস্তুতি নিয়ে।
পাবনা ছিল শিশুকালের ছিল তীর্থস্থান। বড়ো খালার বিছানার পাশে বসে থাকি। বাড়ির ঘরের ফাঁকে দেখা যায় ঝিঙে ফুল ঝুলছে। কখনও উঠানে একজোড়া খাসির আগমন ঘটতো। তারা কোরবানির ঈদের পর কোথায় গেলো! আর খুঁজে পেতাম না।

মায়ের মুখে শুনতাম উপেন্দ্রকিশোর রায়ের জোলা ও বাঘের গল্প। পাশে আমগাছ। সেখানে হূতূম পেঁচা কোথা হতে উড়ে আসে। রাতে ওদের জ্বলজ্বলে চোখ দেখা যায়। পাশে সাহ বাড়ি। সেখান হতে তাঁতের খটখটে শব্দ আসে। ঠাকুর সুখু দুখু গল্পের তাঁতীর কথা মনে পড়ে।
আমারও তাঁত বুনতে ইচ্ছে করতো।
আলতা বুজি শাহজাদপুর হতে এসেছেন। বলতেন, ওনার গ্রামে প্রতি ঘরে ঘরে তাঁত। চাটমোহর, উল­াপাড়া আরও অনেক নামের জায়গা সেখানে তাঁতের শাড়ি বোনা হয়।
একদিন শুনতে পেলাম আমগাছটি কাটা পড়বে। মন খারাপ হলো। পেঁচাটি হঠাৎ উড়াল দিলো। আশেপাশে গাছ কাটা পড়েছে। স’মিল হবে। সবুজবিহীন এলাকায় গাছটি একাই দাঁড়িয়ে রইলো বহুদিন।
সে যেন কাঠ কাটার শব্দ শুনতে শুনতে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ত। রাতে শিয়ালের আনাগোনা কমে আসে।
আগে রাতে শেয়ালের হূকাহুয়া শুনে ভয় পেলে জিজ্ঞেস করতাম শেয়াল কেমন দেখতে?
মা বলতেন কুকুরের মত।
শুধু মুখ চোখা। লাল রঙের। যখন আরও ছোট ছিলাম সাঁঝের বেলায় শেয়ালের হুকাহূয়া শব্দ শুনলে ভাবতাম সকাল হলেই শেয়াল খুঁজতে বের হবো। কিন্তু ভোরে সব লাল কুকুরকে শেয়াল মনে হতো। ওদের তো মুখ লম্বা। আসলে শেয়ালের মুখ সূচালো।
শীতের সকালে ঘুম হতে উঠে কোনো সময় দেখতো খেজুরের রসসহ মাটির হাঁড়ি নিয়ে এসেছে গাঁয়ের মানুষ। কি মজার সেই ঠান্ডা রস। মনে হতো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু শরবত।
সেটা খেতে বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি। সূর্য ওঠার আগেই শেষ করতে হবে। সূর্য উঠলে নাকি ওটা মদ হয়ে যায়। মদ মানে কি?
ঐ তাড়ি।
ভাত পঁচে গেলে যেমন হয়।
বাড়ির পিছনে মেথরপট্টি। সেখানে তাড়ি খেয়ে হট্টগোল করে মেথরেরা। তাই জানতাম তাড়ি বা মদ খুব ভালো কিছু না, মেথরেরা ওসব খায়। শিশুকালেই মদকে ঘৃণা করতাম। কিন্তু সুইপারদের বিশেষ করে ওদের কালো মেয়েদের দেখতে আবার খুব সুন্দর লাগতো।
কালো শরীর। টানা টানা হাত পা। মেয়েরা শাড়ি পরে সুন্দর করে, সামনে আঁচল টেনে দিতো।
মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম কাজের মেয়ে ময়নাকে। ওরা এভাবেই শাড়ি পরে।
ময়না, তোরা কুচি দিয়ে শাড়ি পরিস না কেন?
ময়না বলতো আমরা তো একপেঁচে শাড়ি পরি। এক প্যাঁচ মানে কি?
খালার কাছে জানতে চাই।
খালা বলেন বাংলাদেশে গাঁয়ের মেয়েরা এরকম পড়ে। সুইপারেরা বেশিরভাগই মাদ্রাজী।
-ওরা আঁচল সামনে নিয়ে শাড়ি পরে। স্কুলে মেয়েরা যখন নাচে তখন এভাবে শাড়ি পরে।
“হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল” নাচটি হতো। বনমালী ধাম হতে গানের সুর ভেসে আসতো।
কিন্তু একটি বিরক্তি; সুইপারগুলি রোজ টাকা চাইতো। চৈত্র সংক্রান্তিতে হনুমান সেজে রাম-সীতার পালা দেখাতে আসতো।
মা বলতেন ওরা দ্রাবিড়। এই যে দেখেছিস কালো রঙ। এটি আমাদের রঙ। ওরা আমাদের মাঝে আর আমরা ওদের মাঝে মিলেমিশে আছি। এদেশে বহু জাতির মিলন ঘটেছে। তাই সাদা ও কালো একসাথে আছে এদেশে।
মিতিল ঐ কবিতা টি শোনা!
মিতিল আপা লম্বা একটা ফ্রক পরে সারা বাড়ি তদারকি করে উঁচু গলায় কবিতা পড়তেন।

“হেথায় দ্রাবিড় এক দেহে হলো লীন–

হে মোর চিত্ত পূণ্য তীর্থ- জাগরে ধীরে
এই কবিতাটি শুনে মা ও খালার মনটা উদাস হতো।
বলতেন- দেশ ভাগ হলো! মানুষে মানুষের ভাগ! আমরা কি পাকিস্তানের এমন ভাগ চেয়েছিলাম!
বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীকার, গণতন্ত্র নিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আজও বহমান। বাংলার মুখোশধারী নরপিচাশের দল আজও এই বাংলায় বিচরণ করছেন, তাদেরকে সমূলে বিনাশ করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তাঁর কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে আরও বিলম্বিত হবে। সকল শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের আত্মার শান্তি এবং জাতির জনক ও বঙ্গমাতা সহ মুজিব পরিবারের ৪৫তম শাহাদৎ বার্ষিকীতে আমাদের শপথ নিতে হবে। সকল অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে অজস্র ত্যাগে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে যথার্থ রূপায়নে সম্মিলিত প্রয়াসে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *