• Thu. Nov 21st, 2024

আল-মাউত আল-আসওয়াদ বা কালো মৃত্য

মানচিত্রে আরবের ব্ল্যাক ডেথ ‘আল-মাউত আল-আসওয়াদ’, ১৩৪৬-১৩৫৩
এশিয়া থেকে সারা দুনিয়ায় তান্ডব চালানো ভয়ঙ্কর মহামারিটি ইতিহাসে ‘ব্লাক ডেথ’ নামে পরিচিত। ১৩৪৬ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই যমদূত। আরব অঞ্চলে এই কালো মৃত্যু ‘আল-মাউত আল-আসওয়াদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। চীনে মোঙ্গলদের জয় হলে চাষবাস ও কলকারখানায় অনুৎপাদনশীলতার সৃষ্টি হয়। ব্যাপক খাদ্যঘাটতি থেকে মন্দার তৈরি হয়। ব্লাক ডেথে আক্রান্ত হয় মোঙ্গলরাও। কোথাও কোথাও মোঙ্গলরা মহামারিতে আক্রান্ত সেনাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আক্রমণ করা এলাকায় সেনাদের লাশ ফেলে মহামারি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। এতে মানুষ ঘরবাড়ি-শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। ব্যবসায়ীরা জাহাজে করে শহরত্যাগ করতে থাকে। আর এভাবেই বন্দরে বন্দরে পৌঁছে যায় বিশ্বের কুখ্যাত মহামারি ব্লাক ডেথ। বণিকদের জাহাজে থাকা কালো ইঁদুর যাত্রীদের মাঝে বুবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে দেয়।
এশিয়া থেকে সিল্করোড হয়ে এই প্লেগ পৌঁছে ক্রিমিয়ায়। ১৩৪৬ সালে বণিকদের মাধ্যমে কনস্ট্যান্টিনোপোল থেকে কৃষ্ণসাগর হয়ে একটি জাহাজ এসে নোঙর করে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। দাস ব্যবসায়ীদের সে জাহাজ থেকে সমগ্র আরববিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আল-মাউত আল-আসওয়াদ বা বøাক ডেথ। সে বছরই গাজা, জেরুসালেম, হোমস, দামাস্কাস, আলেপ্পোসহ প্যালেস্টাইন, লেবানন, তিউনিসিয়া ও সিরিয়ার নানা শহরে দাপিয়ে বেড়ায় এ যমদূত। ১৩৪৯ সালে পবিত্র শহর মক্কা, মসুল ও বাগদাদ আক্রান্ত হয়। খলিফা মামুনের সময়েও মহামারিতে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে: ১৩৪৬ সাল থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত এ মহামারিতে ইউরেশিয়ায় ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
ঐতিহাসিক সূত্রমতে আল-মাউত আল-আসওয়াদের কারণে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এ মহামারিতে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় একদিনেই বিশ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৩৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৩৪৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কায়রো ও পূর্ব-মিশরের বেলবাইসে মৃত্যু হয় দুই লক্ষ মানুষের। আরব ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে এ মহামারির বিভৎসতার আন্দাজ করা যায়। বিউবেনিক প্লেগ শহর-নগরকে এমনভাবে খালি করেছিল যে, মৃতদের লাশ দাফনের জন্যও কোনো মানুষ পাওয়া যেত না। দেখা দিয়েছিল কফিনের অভাব। লাশ বহনের জন্য খাঁটিয়া না পেয়ে মানুষ দরজার পাল্লা ব্যবহার করেছে। কাফনের অভাবে কম্বল দিয়ে কবরে শুইয়ে দিতে হয়েছে। অবশ্য অনেকের ভাগ্যে তাও মেলেনি। গণকবর ছিল একমাত্র উপায়। যাদের কপালে তাও জুটেনি তাদের লাশ রাস্তাঘাটে পড়ে থেকে পচে গলে গেছে। এতে মহামারি আরো ছড়িয়েছে।’আল-মাউত আল-আসওয়াদ’ বিষয়ে মরোক্কান পরিব্রাজক ইবনে বতুতার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ইবনে বতুতা লিখেছেন,’সে সময় মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষদের দেহ পথে-ঘাটে এলোমেলো পড়েছিল। শকুনের দল আকাশে দলবদ্ধ হয়ে উড়ছিল। বড় বড় গর্ত করে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। মুসলমানরা কুরআন হাতে প্রার্থনার জন্য বেরিয়েছিল কোথাও না কোথাও। আক্রান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা ‘সাওমে বিছাল’ বা তিন দিন লাগাতার রোজা রেখেছেন ব্যাপকভাবে।
বিখ্যাত আরব পন্ডিত, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (আবু যায়দ আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন আল-হাদরামি, ১৩৩২-১৪০৬ খ্রিস্টাব্দ) সতের বছর বয়সে তিউনিসিয়ায় আল-মাউত আল-আসওয়াদ মহামারিতে তার পিতা-মাতাকে হারান। ফলে খুব ঘনিষ্ঠভাবে এ মহামারিকে দেখেছেন তিনি। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-মুকাদ্দিমা’য় ১৩৪৮-১৩৪৯ সালে তিউনিসিয়ায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,’দেশ ও গোষ্ঠীগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যেন মহাবিশ্বের জিহ্বা নিস্তেজের দিকে আহ্বান করছিল। যেন এ এক নতুন সৃষ্টি। নতুন বিশ্ব’ প্লেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন,’প্লেগের প্রধান কারণ বায়ু দূষণ, নগরায়ন, ও আর্দ্রতা।
‘ইবনে খালদুন আরো লিখেছেন,’প্লেগ মহামারি ছড়িয়ে পড়া মূলত রাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং হিজরতের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রাকৃতিক ফল। মানুষ এসব কারণে কৃষিকাজ থেকে দূরে থেকেছে।’ ইবনে খালদুন আরো ব্যাখ্যা করেন,’যে শহরে সূর্যের আলো ভালো করে পড়ে না এবং নগরের বাতাস চলাচল ভালো হয় না সে শহরের নাগরিকদের ব্যক্তিত্ত্বে ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ‘এমনকি ১৯ শতকেও এটি ইউরোপের কিছু জর কিছু জায়গায় দেখা গিয়েছিল।
২০১০ এবং ২০১১ সালে বিশেষজ্ঞরা এই মহামারির শিকার হওয়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের অধিবাসীদের ডিএনএন বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। এতে ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়ার (প্লেগ রোগ বিশেষ) জন্য রোগ সংক্রামক জীবাণু প্যাথোজেকে দায়ী করা হয়।
১৪০০ খৃষ্টাব্দ: বøাক ডেথ প্লেগ (দ্বিতীয় প্লেগ মহামারি)
বুবোনিক প্লেগের প্রকোপ ক্রমে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যার প্রভাব প্রথম প্রলয়ের প্রায় একশ বছর পর পর্যন্ত ভোগায় পৃথিবীর মানুষকে। এই প্লেগের দ্বিতীয় প্রলয় আঘাত আসে ১৪২০ সাল নাগাদ। এই মহামারির কবলে পড়ে ১৪শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। মানুষের প্রাচীনতম ফসিল, সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিভিন্ন রোগ কীভাবে পাল্টে দিয়েছে পৃথিবীর গল্প। মহামারি কয়েক মাসে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে জনপদ। এ যেন অভিশাপ- ভেবে পালিয়ে যাচ্ছিল নগরবাসী। কিন্তু মৃত্যু পিছু ছাড়েনি। ১৫ বছরের ব্যবধানে রোম রীতিমতো ভুতুড়ে শহর হয়ে ওঠে। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে এই প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে গ্রিসে। এথেন্স তখন গ্রিসের ফুসফুস। প্লেগ এসে তছনছ করে দেয় এথেন্সকে। এক লাখ মানুষ মারা যায় সে সময়। একশ বছর পর ইউরোপ, মিসর ও পশ্চিম এশিয়ায় প্লেগের ছোবল লাগে। গোটা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ সে সময় মারা গিয়েছিল। মানুষ ঘর ছেড়ে বের হতো না। সেই শতাব্দীতে এটি সুসভ্য রোমান সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে তা প্লেগ অব শ্যারো নামে ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান ইরানে। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে মাত্র এক বছরে এক লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা ধারণা করা হয় এই মহামারির প্রভাবে। কেউ রোগাক্রান্ত হলে ছুটে পালাত তার সঙ্গী-স্বজনরা। পার্সিয়ার অর্ধেক মানুষই মারা যায় তখন।
১৫০০ খৃষ্টাব্দ: প্লেগ, কলেরা ও গুটি বসন্ত গুটি বসন্ত ব্যাপক মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকবার। সর্বপ্রথম দেখা যায় ১৫২০ সালে। ভ্যারিওলা মাইনর নামে ভাইরাস থেকে এই রোগ হয়। মানবসমাজের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী যে ক’টি রোগ রয়েছে স্মলপ বা গুটি বসন্ত তার অন্যতম। এই রোগে আক্রান্ত হলে সারা শরীর জুড়ে তরল-ভর্তি ছোট ছোট গুটি দেখা যায়। এবং এই মহামারি যখন তুঙ্গে তখন গুটি বসন্ত আক্রান্ত প্রতি ১০জন রোগীর মধ্যে তিনজনই প্রাণ হারাত। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে, ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে স্প্যানিশ বণিকরা নিয়ে আসে ভয়ঙ্কর স্মলপক্স, বিউবোনিক প্লেগ ও হামের মত জীবাণু। ইউরোপিয়ানরা এইসব রোগ প্রতিরোধী হলেও ক্যারিবিয়ানের মানুষের শরীরে এই রোগের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। এর ফলে প্রায় ৯০ ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী এইসব রোগে মৃত্যুবরণ করেন। ১৫১৯ সালে বর্তমান মেক্সিকোতে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়লে দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। ১৫২০ সালে ইউরোপিয়ানদের সাথে আসা একজন আফ্রিকান দাস স্মলপক্স নিয়ে আসলে গোটা এজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। উপনিবেশিক শক্তি গোটা আমেরিকা মহাদেশে শুধু তরবারি দিয়েই হত্যা করেনি। রোগ-বালাই নিয়ে এসেও মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানদের বয়ে আনা জীবাণুর কারণে আমেরিকা মহাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। আদিবাসীদের এই গণহারে মৃত্যু গোটা আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্য করার সুযোগ করে দেয়।
বাংলায় প্লেগ ও কলেরা ভয়াবহ মহামারী হিসেবে কয়েকবারই দেখা দিয়েছে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখক আবুল কাশিম ফিরিস্তার বর্ণনায় জানা যায়, ১৫৪৮ সালে বিহারে ভয়ানক প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আফগান সুলতানদের শাসন এর সময় রাজধানী গৌড়ে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। প্লেগের ধরন অনেকটা করোনার মতোই। জ্বর, মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি এবং ভীষণ ছোঁয়াচে; কিন্তু চিকিৎসা তেমন না থাকায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়।এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্লেগে গৌড়ে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যেত। এত শবদেহ দাফন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মরদেহ বিল-ঝিল আর ভাগীরথী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। এ সময় বাংলা জয় করতে এসেছিলেন সম্রাট আকবরের সেনাপতি খান-ই-খানান মুনিম খান। তিনিও প্লেগে আক্রান্ত হয়ে গৌড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
১৬০০ খৃষ্টাব্দ : স্মল পঙ্গ , ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাস মহামারি আনুমানিক ১৬২০ সাল নাগাদ লন্ডন দেখে মহামারির আসল রূপ। সে সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে কথিত আছে, মহামারির প্রলয় এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে, ‘ইউরোপের তুষারাচ্ছন্ন পর্বতের প্রতিটি প্রান্তে ফোটার আগেই মূর্চ্ছা যেতে থাকে প্রতিটিরক্তিম মে ফ্লাওয়ার।’ স্মল পঙ্গ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড এমন অজানা আরও একাধিক এ সময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, মৃতদেহ কবর দিতে খোড়া হয় একের পর এক গণকবর
সতের শতকে ইবনে সিনার সময়েও মহামারি দেখা দেয়
একই শতকে রাশিয়া ও পার্সিয়া ভয়ঙ্কর মহামারির মুখে পড়ে। দুই লাখ মানুষ মারা যাওয়ার পর পার্সিয়া অভিশপ্ত হিসেবে গণ্য হতো। ইউরোপ ও এশিয়ায় এক লাখ মানুষ কলেরায় মারা যায় ১০ বছরের ব্যবধানে। সে সময় কলেরা প্রতিরোধের কোনও উপায় খুঁজে পায়নি বিশ্ব। এছাড়া এ শতকে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ইয়েলো ফিভার মহামারি আকার ধারণ করে। এতে নগরের ১০ ভাগের এক ভাগ, প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়।
১৮০০ খৃষ্টাব্দ : ভারতবর্ষে কলেরা, যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েলো ফিভার এবং আরবে প্লেগ ও কলেরা
১৭০০ সালের প্লেগ প্রলয়ের ১০০ বছর পর ১৮২০ সালে শুধু ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় কলেরা রোগে মারা যায় কয়েক লাখ মানুষ। সময়ের সঙ্গে এই কলেরা মহামারি রূপ ধারণ করে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাংকক, ম্যানিলা, ইরান, বাগদাদ, সিরিয়া হয়ে জানজিবার পর্যন্ত। আর আফ্রিকা ইউরোপে বসন্Í রোগে মারা যায় প্রায় ৩৫ লাখ।তবে এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারিটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েলো ফিভার বা ইয়েলো প্লেগের প্রাদুর্ভাব। দেশটির ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে শুরু হওয়া ইয়েলো ফিভারের প্রাদুর্ভাব অল্প সময়ের মধ্যেই মহামারি রূপ ধারণ করে। এর প্রভাবে উচ্চ তাপমাত্রাসহ সারা দেহে সৃষ্টি হতো প্রচন্ড যন্ত্রণা। যার এক পর্যায়ে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ঘটতো ভয়াবহ মৃত্যু। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো এক প্রকার মশা এই রোগের জীবাণু পরিবাহী।
১৮৩১ সালের প্লেগ ইরাকের বাগদাদ ও বসরা নগরী দুটিকে প্রায় জনশূন্য করে ফেলেছিল। প্লেগের আঘাতে দেড় লাখ বাসিন্দার বাগদাদে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল মাত্র ২০ হাজার মানুষ। ৮০ হাজার নাগরিকের বসরা শহরে কোনো রকমে বেঁচে ছিল মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার বাসিন্দা। ইরাকের বহু শহর মনুষ্যহীন ভূতের নগরে পরিণত হয়েছিল। ঘরবাড়ি খালি পড়েছিল। দোকানপাট -কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রম দেওয়ার মতো শ্রমিকের খোঁজ পাওয়া যেত না। ক্ষেত-খামার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। আবাদীজমি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে। ইরাককে তার এই দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে কুড়ি বছরের বেশি সময় লেগেছিল। (ব্লাদিমির বরিসবিচ লাট্সকি, মডার্ন হিস্ট্রি অব দ্য আরব কান্ট্রিজ, ১৯৬৯, মস্কো)
১৯০০ খৃষ্টাব্দ : দ্য স্প্যানিশ ফ্লু :
স্প্যানিশ ফ্লুর সময় রিয়াদের এক বাজার, ১৯১৮
স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত ইনফ্লুয়েঞ্জার সবচেয়ে প্রাণঘাতী মহামারি দেখা দেয় ১৯১৮ সালে। এতে সারা বিশ্বে ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।অনেকটা আজকের এই নতুন মহামারি করোনাভাইরাসের মতোই রোগীকে আলাদা করে রাখা কিংবা কঠোর কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে এই ইনফ্লুয়েঞ্জার বিস্তার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। ১৯১৮ এবং ১৯২০ সালের মধ্যে পর পর দুটি মহামারির পর ঐ ভাইরাসের প্রকোপ কমে আসে। কিন্তু এর একটি কম মারাত্মক জীবাণু এখনও প্রতি বছর বহাল তবিয়তে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে, প্রতিটি মহামারির সঙ্গে পরবর্তী মহামারির শুধু এই ধারাবাহিক সময় চক্রের নয়, মিল রয়েছে সংক্রামিত ব্যাধির ক্ষেত্রেও।
করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ (কোভিড-১৯)
২০১৯ সালের শেষ নাগাদ এই ভাইরাসের সংক্রমণে অজ্ঞাত রোগের প্রাদুর্ভাব সৃষ্টির কথা প্রথম জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ব্যাধিটির সাধারণ লক্ষণ-উপসর্গগুলি হল জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। ব্যাধিটি জটিল রূপ ধারণ করলে প্রথমে ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) হতে পারে এবং আরও গুরুতর রূপ ধারণ করলে তীব্র শ্বাসকষ্টমূলক রোগ লক্ষণ সমষ্টি প্রকাশ
পেতে পারে। ঝুঁকির কারণ: প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না
করা হলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে; প্রতিরোধ: সঠিকভাবে হাত ধোয়ার পদ্ধতি অনুসরণ, কাশি শিষ্টাচার, অসুস্থ মানুষ বা সাবক্লিনিক্যাল বাহকের সাথে সংস্পর্শ এড়ানো রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি; জজঞ-চঈজ পরীক্ষা, ইমিউনিঅ্যাসে, সিটি স্ক্যান, মৃতের সংখ্যা: ৩০,০৭,৮৩৮ (নিশ্চিত রোগীর ২%) [১৮এপ্রিল২০২১], পুনরাবৃত্তির হার:১৪,০৪,০৪,৬০৮ জন নিশ্চিত রোগী, চিকিৎসা :উপসর্গবিশিষ্ট এবং সহায়তামূলক। এই ব্যাধির চিকিৎসাতে মূলত উপসর্গসমূহের উপশম করা হয় এবং সহায়ক চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যাতে রোগী নিজে থেকেই ধীরে ধীরে সেরে উঠতে পারে। ব্যাধিটি প্রতিরোধের জন্য অন্য ব্যক্তিদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশি দেবার সময় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মুখ ঢাকা, হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা, পর্যবেক্ষণে রাখা এবং সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আত্ম-পৃথকীকরণ (সঙ্গনিরোধ) করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ভাইরাসটির বিস্তার প্রতিরোধের প্রচেষ্টাতে ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা, সঙ্গনিরোধ (কেয়ারেন্টিন), সান্ধ্য আইন (কারফিউ), অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া বা বাতিল করা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ফলে প্রায় সকল দেশের ১২০ কোটি ছাত্রছাত্রীর জীবনে এর প্রভাব পড়েছে।
এই বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়েছে। বহু ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে যা হয় রহিত করা হয়েছে। অনেক দেশে দ্রব্যের (যেমন খাদ্য বা ঔষধ) জোগানের স্বল্পতার ব্যাপারে ব্যাপক ভীতি থেকে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের কেনাকাটার আধিক্যের সৃষ্টি হয়েছে । ভাইরাসটিকে নিয়ে ভুল বা মিথ্যা তথ্য ও ষড়যন্ত্রমূলক তত্ব ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া চীন, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ ও বিদেশীভীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ যেমন বহুকালের, সংক্রামক রোগের মহামারির ইতিহাসও সেরকম অনেক প্রাচীন।নতুন করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি জটিল, কারণ উপসর্গ দেখা যায় না এমন রোগীদের মাধ্যমে এটা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এই সঙ্কট সমাধানে বিশ্বব্যাপী যে ‘অসাধারণ প্রচেষ্টা’ চলছে তা একদিন সাফল্য বয়ে আনবেই। যেমন ১৯২০-১৯৩৯ এর মধ্যে ডিপথেরিয়া, পারটুসিস, ও টিটেনাস (ডিপিটি) ভ্যাকসিন, যক্ষা ভ্যাকসিন (১৯৫১), পোলিও (ওপিভি, ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন, ১৯৬৭), হাম বা মিজলস (১৯৮০), হেপাটাইটিস ডিএনএ ভ্যাকসিন (১৯৯৭), নভেল ফ্লু ভাইরাস ভ্যাকসিন (২০০৯), ওরাল কলেরা ভ্যাকসিন (২০১০) ও মেনিঞ্জাইটিস এ ভ্যাকসিন (২০১০) এবং সর্বোপরি জাপানি এনকেফালাইটিস ভ্যাকসিন (২০১২) আবিষ্কার ও প্রয়োগে আমরা বহু মহামারীর হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। ‘সংক্রমণের বিস্তার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা’, ‘জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে প্রচারণা’ এবং ‘নতুন ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা পদ্ধতি’- এসব কিছুর সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়েই করোনাভাইরাসের বর্তমান মহামারিসহ আগামীর যেকোন মহামারিকে জয় করা সম্ভব হবে।
তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে বিশ্বের জনসংখ্যা আগের চেয়ে যেমন বেড়েছে তেমনি অতীতে মহামারির কারণ হয়েছে যেসব রোগ-জীবাণু সেগুলো এখনও আমাদের মধ্যে রয়েছে। মহামারির অবসান হয়তো ঘটেছে, কিন্তু সেই ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি এখনও কমেনি। জনগণের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে করোনাভাইরাসের সাথে বসবাসের উপায় খুঁজে বের করাই হবে সবচেয়ে ভাল পথ।

আর ‘পরবর্তী মহামারির জন্য বিশ্ববাসীকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে’ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান।

সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, গবেষণাপত্র, জনস্ হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ; ভিজ্যুয়াল জার্নালিজম টিম-বিবিসি, chapaibarta24.com অনুপম দেব কানুনজ্ঞwww.dw.com; www.tbsnews.net/bangla-আরবে মহামারি: যুগে যুগে মহাঘাতকের ছোবল; মহামারীর ইতিবৃত্ত, এবং মানবজাতির আবহমানকালের লড়াই- ডাঃ অসিত রঞ্জন ঘোষ, প্রাক্তন বৈজ্ঞানিক-আইসিএমআর bengali.indianexpress.com বাংলায় মহামারীর ইতিহাস ও আজকের বাস্তবতা-ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, shahnawaz7b@gmail.com,https://www.jugantor.com 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *