• Thu. Nov 21st, 2024

‘এক বঙ্গবন্ধু এক রাষ্ট্র’

অনন্য কথা ডেস্ক: অপারেশন সার্চলাইট চলছে। ঘুমন্ত নিরীহ নর-নারীর উপর কাপুরুশুচিত আক্রমন শুরু হল। বিপর্যস্ত মানুষের আর্তচিৎকার ভেদ করে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বাণী তরঙ্গে ভাসছে
পরক্ষণেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন।
করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা
পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও”
“ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ হইতে ।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ দিবাগত রাতটি ছিল ভিন্ন ধরণের। আকাশবাণী কলকাতার বেতার কেন্দ্র থেকে বরাবরই প্রচার করা হচ্ছিল যে রাত ১০ টার পর একটি বিশেষ সংবাদ প্রচার করা হবে। রাত ১০ টায় শব্দসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতেজ ও মসৃণ কণ্ঠে উচ্চারিত হলো শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবাদটি। তিনি বললেন-“স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের নতুন এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর সরকারের প্রধানমত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও আবু হেনা এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথ তলার এক আম্রকাননে। সেই সময় ভারত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বেতার সংস্থা আকাশবানীর সাংবাদিক-প্রযোজক উপেন তরফদারের বরাদ দিয়ে বি বি সি বাংলায় তার পূএবধু দেবযানী আইচ বলেন “অন্ধকার রাতে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চলার পরে যখন প্রায় ভোর হচ্ছে, সেই সময়ে তারা একটা বিরাট মাঠে পৌঁছলেন। প্রচুর মানুষ অস্ত্র হাতে সেখানে হাজির, বাংলাদেশের একটা পতাকা আছে। একটা মঞ্চ গড়া হয়েছে। জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছিল মুজিবনগর”, সেদিনই মুজিবনগর সরকারের পত্তন হয়েছিল, যার সাক্ষী থেকেছিলেন উপেন তরফদারের মতো হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাড়ে ৭কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে বাংলার বীরেরা তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করছে। অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে বিষ্ময়কর ভাবে কাঠের চৌকি পাতানো মঞ্চে শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণাকরা হলো। সেদিন কোরআন তেলাওয়াতের জন্য কোনো ইমাম, মুয়াজ্জিনকে পাওয়া যায়নি। তাই উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা ভিড়ের মধ্যে থেকে মেহেরপুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র বাকের আলীকে তুলে আনলেন ক্বেরাত পড়তে। তার মিষ্টি ক্বেরাতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। অবশ্য এই ক্বেরাত পড়ার জন্য পাক হানাদাররা পরবর্তীতে তার গায়ে গুড় মাখিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে শরীরে পিঁপড়ার বাসা ঢেলে দিয়েছিল। বীরত্বের সাথে দেশি, ভারতীয় ও বিদেশি ৫০ জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হয়।এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর দীর্ঘ ভাষণের একটি চুম্বক অংশে বলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে”। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেন, “আজ এই আম্রকাননে, একটি জাতি জন্ম নিল”।
মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের পর
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে
গার্ড অব অনার দেয়া হচ্ছে
সেই প্রবাসী সরকারকে একটি ভবন দিয়েছিল ভারত সরকার। সেখানে বাড়িটি এখনও রয়েছে- ৮ নম্বর থিয়েটার রোড, যার এখনকার নাম শেক্সপিয়ার সরণী। তবে সেখানে নেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনও স্মৃতি, নেই কোনও নাম ফলকও। ওই বাড়িটি আসলে ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর অরবিন্দ ঘোষ, যিনি পরবর্তীতে ঋষি অরবিন্দ, তারই মামা বাড়ি। সেখানেই জন্ম তার। এখন ওই ৮ নম্বর বাড়িটি অরবিন্দ ভবন। যুদ্ধের সময়ে নিয়মিত ওই বাড়িতে খবর সংগ্রহ করতে যেতেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। “বাড়িটার চারদিকে বিএসএফ পাহারা দিত, আর ভেতরে থাকত প্রবাসী সরকারের নিজস্ব প্রহরীরা। বাড়িটার ঠিক উল্টোদিকে নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেল। ওই হোটেলে পাকিস্তানের চর এসে ওঠে,” বলছিলেন মি. দাশগুপ্ত। “উপর থেকে বাড়িটির ছবি নিয়ে তা পাকিস্তানের সব খবরের কাগজে প্রকাশ করা হয়। বলা হয়েছিল কোথাও কোনও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না।কিছু মানুষ কলকাতার একটি বাড়িতে বসে ভারতের রক্ষীদের প্রহরায় এসব মিথ্যা রটাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নামে।” সেই ভবনটির অনেক স্মতি রয়েছে সুখরঞ্জন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, সেনা প্রধান কর্ণেল ওসমানি, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলি – এরা বসতেন। তাজউদ্দিন আহমেদের পরিবার থাকত অন্য মন্ত্রীদের পরিবারের সঙ্গে ইন্টালি অঞ্চলে। “কিন্তু মি. তাজউদ্দিন কোনও দিন সেখানে যান নি। ওই নয় মাস তিনি বোধহয় ঘুমোন নি – এত পরিশ্রম করতেন। শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেব এই বাড়িতে বসতেন না। তার আলাদা একটি দপ্তর ছিল কাছেই।”
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার আদর্শের অনুসারীরা কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের এই অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারের সঙ্গে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের গঠিত সরকারের তুলনা করা যায়, যার সদর দফতর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিংয়ে ছিল; কোনো কোনো সময়ে থাইল্যান্ডেও ছিল। অন্যদিকে সরকার কাঠামোর বিচারে মুজিবনগর সরকার ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। ৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
সরকারে বঙ্গবন্ধুর পরই উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্থান নির্ধারণ করা হয়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাম নয়। সুতরাং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় কারণ মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারে নীতি নির্ধারণমূলক সিদ্ধান্তসমূহ সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে সংসদ সহজে আহ্বান করা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে রাষ্ট্রপতি সংসদকে না ডেকেও শুধু মন্ত্রীসভার অনুমোদন নিয়ে যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
তাই স্বল্পতম সময়ে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতির হাতে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। তবে উপ-রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেন । মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনে মুজিবনগর সরকারের ভুমিকা চিরঅম্লান এবং ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনীর সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অসামান্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, জয় বাংলা পত্রিকা, সরকারের পক্ষে বিভিন্ন পোস্টার, লিফলেট ও প্রামাণ্য চিত্র তৈরি প্রভৃতি বিষয়গুলো মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপ দিয়েছে। “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসাবে কাজ করে”। এ মন্ত্রণালয়ের আর্ট ও ডিজাইনার হিসেবে কামরুল হাসান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং ও মাপ নির্ধারণ করেন এবং এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। আমাদের বর্তমান পতাকাও সেটিই। তাঁর অংকিত ইয়াহিয়া খানের ব্যঙ্গচিত্র ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে-এর মাধ্যমে ইয়াহিয়ার প্রতি মুক্তিকামী মানুষের আক্রোশকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ থেকে আসা নাম না জানা মানুষ যেমন আশ্রয় পেয়েছেন কলকাতার মানুষের কাছে, তেমনই ঢাকা থেকে যেসব লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা সাময়িক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন, তাদেরও থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে এই শহরেই। সেরকমই একদল লেখক শিল্পী প্রকৌশলী ঢাকা আর চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসে চালু করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেই ভবন এখন অবশ্য আর অবারিত দ্বার নয় – বাড়িটির বর্তমান মালিক কাউকে প্রবেশ করতে দেন না। কিন্তু ৭১ সালে সেটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
কবি ও প্রাবন্ধিক জিয়াদ আলি বলছিলেন, ” ওই বাড়িটা সংস্কৃতি কর্মীদের একটা মেলামেশার বড় জায়গা হয়ে উঠেছিল। দেখেছি অনেক সময়ে খবর লেখার জন্য সাদা কাগজও পেতেন না তারা। সংবাদপত্রের পাশে যে সাদা অংশটা, সেখানে খবর লিখে সম্প্রচার করতেন।”বেতার চালু হওয়ার কয়েক মাস পরে এলেন কামাল লোহানী। বার্তা সম্পাদক হয়ে যোগ দিলেন তিনি। একদিন কথায় কথায় আমার এক পাড়াতুতো দাদা কামাল আহমেদকে বললেন যে তারা সম্প্রচারের জন্য ভাল উদ্দীপক দেশাত্মবোধক গান পাচ্ছেন না।
কামাল আহমেদ লোহানীভাইকে বললেন যে গোবিন্দ হালদার দাদা অনেক গান লিখেছেন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম নিয়ে।
তার গানের খাতা আপনাকে দেব,” বলছিলেন জিয়াদ আলি। জিয়াদ আলি গোবিন্দ হালদারের ওই গানের খাতাতেই যেমন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে গানটি ছিল, তেমনই ছিল মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি বা এক সাগর রক্তের বিনিময়ের মতো কালজয়ী গান। জিয়াদ আলি বলছিলেন মি. হালদার হয়তো বিখ্যাত গীতিকারদের পর্যায়ে পড়তেন না, কিন্তু তার গানে যে আবেগ, দেশপ্রেম ছিল, সেটাই রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করত। সমর দাস ওই খাতায় লেখা কয়েকটি গানের সুর করলেন আর আপেল মাহমুদ গাইলেন। গোবিন্দ হালদারের গানগুলোর মতোই আরেকটি গান মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণ উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠ…।’ প্রখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এক চায়ের দোকানের আড্ডায় বসে গানটি লিখে ফেলেছিলেন — সঙ্গেই ছিলেন শিল্পী অংশুমান রায়। তিনি গানটিতে সুর বাঁধতেই আড্ডায় হাজির আরেক ব্যক্তিত্ব – উপেন তরফদার – গানটি রেকর্ড করে নেন। তার সংবাদ বিচিত্রা অনুষ্ঠানে ৭ই মার্চের রেসকোর্সের ভাষণের একটা টেপ যখন মি. তরফদারের হাতে আসে বেশ কিছুদিন পরে, তার সঙ্গেই এই গানটি মিশিয়ে দিয়ে পরিবেশন করেছিলেন বেতার প্রযোজক মি. তরফদার। তার পুত্রবধূ দেবযানী আইচ বলছিলেন, “একটা সংবাদ ভিত্তিক অনুষ্ঠানে গানের সঙ্গে একটা ভাষণ যে মিশিয়ে দিয়ে পরিবেশন করা যায়, সেটা তখন কেউ ভাবতেই পারেননি। প্রথমে সবাই বাবাইকে বারণ করেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ যখন অনুষ্ঠানটা সম্প্রচারিত হয়, তখন সকলেই উচ্ছসিত।”
“১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে চারশ’ চৌষট্টি শব্দে রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটিই হলো “স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল-যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি। প্রজাতন্ত্রের সূচনালগ্নে এই ঘোষণাপত্রটি রাজনৈতিক বৈধতার শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করেছে”। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তার গৌরব বহন করে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবের প্রেক্ষাপট,পাকিস্তানিশাসক গোষ্ঠীর সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন-বঞ্চনা,অর্থনৈতিক -রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্ব অভিব্যক্ত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। ঘাষণাপত্রে গণপ্রজাতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-এই তিনটি বিশেষ শব্দ চয়ন করা হয়, যাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে থাকি। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই ঘোষণাপত্র তথা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সরকার ছিল সম্পূর্ণ বৈধ একটি সরকার-যা না হলে জনগণ যতই প্রশংসা করুক না কেন আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কূটনৈতিক তৎপরতা, গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য সে সময় মুজিবনগর সরকার গঠন ছিল যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত হয়। বাংলার ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণ দু’টি তাৎপর্যময়িত ঘটনা। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননের বিপ্লবী মুজিবনগর সরকার তাই স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য বাঙালির দীর্ঘকালের স্বপ্নের রূপায়ন। ক্ষুদ্র কলেবরে মাত্র ৬ জন সদস্য নিয়ে এই সরকার গঠিত হলেও জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ও বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায় করে অত্যন্ত সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে দেয় এই সরকার।
১৬ই ডিসেম্বর১৯৭১, তার দুদিন পরে, ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা ছেড়ে নিজেদের দেশের দিকে রওনা হয়েছিলেন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা। কিন্তু কলকাতার আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তারা ভোলেন নি। যুদ্ধ শেষের পরে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই পশ্চিমবঙ্গকে জানিয়ে ছিলেন কৃতজ্ঞতা। “আমি যদি মিসেস গান্ধী, ভারতের জনসাধারণ, ভারতের সামরিক বাহিনী, কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ, আসামের জনসাধারণ, ত্রিপুরার জনসাধারণ, মেঘালয়ের জনসাধারণকে মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। তাদের আমি আপনাদের পক্ষ থেকে, সাত কোটি দুখি বাঙালির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এক কোটি লোককে তারা আমার খাবার দিয়েছে,” বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, আধুনিক, গণতান্ত্রিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ও ’৭০ এর দশকের তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা মুছে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন এখন আমাদের সামনে। আর এই দিনবদলের সংগ্রামের পথ চলায় বাঙালি জাতিকে মশালের মত পথ দেখাবে এপ্রিল ১৯৭১এর ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের সংগ্রামী স্মৃতি ।
সৌজন্য:-তিতাস মিয়া,প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, নেত্রকোণা সরকারি কলেজ, নেত্রকোণা ,অমিতাভ ভট্টশালী, ববিসি বাংলা, কলকাতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *