• Thu. Nov 21st, 2024

করোনার দাপটে
রুদ্ধবাসের পহেলা বৈশাখ’১৪২৮

সম্পাদকীয় ডেস্ক: জানা যায়,
চন্দ্র সন হিজরিকে সৌর গণনা হিসেবে এনে মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সনের উদ্ভব ঘটে। তবে সন গণনার দিন থেকে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বিভিন্ন অমিল দেখা দেয়। এ কারণে ১৯৫২ সালে ভারতের জ্যোতি পদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহা ভারতে প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জির বিজ্ঞান ভিত্তিক সংস্কার করেন। এর মাধ্যমে ইংরেজি তারিখ ১৪ এপ্রিল বাংলা বৈশাখ মাসের প্রথম দিন নির্ধারিত হয়। ড. মেঘনাদ সাহার এই পঞ্জিকা সংস্কারকে সমর্থন করেন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কিন্তু দীর্ঘদিন ওই বর্ষপঞ্জিকা কার্যকর হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সংস্কার করা সেই বিজ্ঞান ভিত্তিক পঞ্জিকাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন। ফলে পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল নির্ধারিত হয়। সেই থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় ১৪ এপ্রিল।
পুরনোকে বিদায় জানিয়ে ৩০শে চৈত্র রাত পোহালে-সকালেই আসবে ১লা বৈশাখের নতুন সূর্য। নতুন ভোর, নতুন আলো। নতুন প্রত্যাশা, করোনা মহামারী ও কঠোর বিধি-বিধান যুক্ত সোনালি দিন। হাসি-খুশিতে আলোকোজ্জ্বল ভরা জীবন। অতীতের সব গ্লানি, ব্যর্থতা, বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির প্রত্যাশা থাকবে সবার মনে। এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চৈত্র সংক্রান্তিতে পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুনকে বরণ রীতিমতো ঘরোয়া আয়োজনে সীমাবদ্ধ ছিল। তারপরও প্রত্যাশা থাকবে, নতুন বছর বয়ে আনবে সুখ, শান্তি ও করোনামুক্ত উজ্জ্বল দিন। কবিগুরুর সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আজ আমরা গেয়ে উঠি বর্ষ হয়ে আসে শেষ, দিন হয়ে এল সমাপন/চৈত্র অবসান/গাহিতে চাহিছে হিয়া পুরাতন ক্লান্ত বরষের/সর্বশেষ গান। শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে নতুন বছরের অপেক্ষায় থাকা ব্যবসায়ীদের বিশেষ আয়োজন, লাল মলাটের হালখাতা করোনা মহামারীর কারণে ইচ্ছে করলেও এবার জৌলুসপূর্ণ পরিবেশে চৈত্র সংক্রান্তি বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সুযোগ ছিল না।তারপরও সীমিত পরিসরে শত বছরের ঐতিহ্য-রেওয়াজ পালন করেছেন ব্যবসায়ীরা। ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
প্রতিবছর ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, ঋষিজ ও গানের দল সুরের ধারা। এ বছর সে রকম কোনো আয়োজন ছিল না। তবে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার আয়োজন এ বছরও হয়েছে অনলাইনে। অনলাইনে একটি অনুষ্ঠান করছো সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট, যেটি সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে। অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছিল মানুষের মঙ্গল কামনা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে উজ্জীবনী গান, বাণী ও কথন দিয়ে। বাংলা নববর্ষ ১৪২৮-এর প্রথম দিন, অর্থাৎ ইংরেজি ১৪ এপ্রিল সকাল সাতটায় বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রায় ঘণ্টাখানেকের ধারণকৃত সংকলনটি সম্প্রচার করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চৈত্রসংক্রান্তির আয়োজনটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব কামাল বায়েজিদ। প্রতিবছর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র প্রাঙ্গণে রাতভর চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠানের পর হাজারো কণ্ঠে এসো হে বৈশাখ গেয়ে নতুন বছরকে বরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সুরের ধারার অনুষ্ঠানটি। এ বছরও সে অনুষ্ঠান হয় নি। তবে ৩০ চৈত্র- চৈত্রসংক্রান্তির ও বৈশাখের প্রথম দিনের জন্য ধারণকৃত এক ঘণ্টার দুটি অনুষ্ঠান চ্যানেল আইতে প্রচার করেছে সুরের ধারা, জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। অন্যদিকে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ফকির আলমগীর বলেন, পয়লা বৈশাখ সকাল ৯টায় ঋষিজের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি একটি আয়োজন হয়েছিল তাদের।তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও ডিজিটাল বাংলাদেশের আশীর্বাদে অনলাইনে বর্ষবরণ হোক নিজস্ব সংস্কৃতি আর আনন্দের রূপকার।
বাংলা নববর্ষ ১৪২৮ উপলক্ষে গণমাধ্যমকর্মীসহ দেশে ও বিদেশে বসবাসরত সকল বাংলা ভাষাভাষীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ তার শুভেচ্ছাবার্তায় বলেন, বাংলা নববর্ষবরণকে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। পৃথিবীর সকল ভাষাভিত্তিক জাতি ও জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সার্বজনীন উৎসব-পার্বণ রয়েছে। চীনাদের চীনা নববর্ষ, ইরান থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত নওরোজ, ইংরেজি ভাষাভাষীদের ইংরেজি নববর্ষ, ঠিক তেমনই পয়লা বৈশাখ বাংলা ভাষাভাষীদের সার্বজনীন উৎসব। । ড. হাছান বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধযুদ্ধে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তার সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে। স্বাস্থ্যরক্ষায় সরকারি নির্দেশনা ও বিধি যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে মহামারির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখা হোক নতুন বছরের অন্যতম অঙ্গীকার।
‘এবার রঙহীন পাহাড়ের উৎসব বৈসাবি’। এ উৎসবের অনেক নাম। পাহাড়ে বসবাসরত ১১টি জনগোষ্ঠির ১০ ভাষাভাষির মধ্যে ত্রিপুরা বলে বৈসুক, মারমা-রাখাইনরা বলে সাংগ্রাই, চাকমারা বলে বিজু, তঞ্চঙ্গ্যারা বলে বিষু এবং অহমিয়ারা (আসাম) বলে বিহু। আর এসব কিছুর সংমিশ্রণে বলা হয় বৈসাবি। ৩০শে চৈত্র থেকে শুরু হয়ে চার দিনব্যাপী এ উৎসবটি পালনের শেষ দিনে জলকেলি (পানি খেলা) ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা ছিলো কিন্তু এ বছর জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে করোনা মোকাবিলায় উৎসব পালন করা হয় নি।
জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, মুছে যাক গ্লানি এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি। আবহমান বাংলার চিরায়িত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে হয় এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন।
কথিত আছে চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় উৎসব। বাংলা বর্ষপঞ্জীর প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। এই দিনটির অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। বছরের প্রথম দিনটিকে স্মরণ করতে প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
তবে এ বছর করোনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং লকডাউন বিবেচনা করে পহেলা বৈশাখে ঢাবি ক্যাম্পাসে সশরীরে কোনো মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় নি বলে জানিয়েছেন ঢাবি কতৃপক্ষ। একইসঙ্গে ক্যাম্পাসে কোনো ধরণের মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গণজমায়েত করা হয় নি। তবে প্রতীকী কর্মসূচি হিসেবে চারুকলা অনুষদের শিল্পীদের তৈরি মঙ্গল শোভাযাত্রার বিভিন্ন মুখোশ ও প্রতীক ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রদর্শন ও সম্প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। দিবসটিকে সামনে রেখে চারুকলা অনুষদের সামনের প্রাচীরে রং তুলির খোঁচায় আঁকা রং-বেরঙের আল্পনা। এসব কার্যক্রম চারুকলা চত্বরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সবাইকে ঘরে বসে বৈশাখ উপভোগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন,করোনা মহামারীর উ™ূত পরিস্থিতিতে সকলকে ধৈর্য ও মনোবল ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব করোনামুক্ত হোক, এই কামনা করে তিনি করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকল সদস্যসহ দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, মাস্ক পরিধান এবং সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার অনুরোধ জানান। “১৯৮৫ সালে যশোরে প্রথম শুরু হয় এ শোভাযাত্রা। পরে আস্তে আস্তে এটি উৎসবে পরিণত হয়। এ দিনটি এলেই সবাই মেতে উঠে পান্তা ভাত আর ইলিশ খেতে। বৈশাখ এলেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একাকার হয়ে যায়। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
আগামী বছরটা যেন হয়ে উঠে করোনাভাইরাসমুক্ত নতুন বিশ্ব নতুন বালাদেশ। বাংলাদেশসহ বিশে^র বাঙালিরা করোনা মহামারি থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই ৩০শে চেত্র ১৪২৭ পুরনো বছরকে বিদায় আর পরের দিন নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *