• Thu. Nov 21st, 2024

করোনা উত্তর সম্ভাব্য সামাজিক বিপর্যয় (রণেশ মৈত্র)

প্রায় দেড় বছর যাবত বিশ্বব্যাপী চলমান করোনা বিপর্যয় সমাজে নানাবিধ সংকটের সৃষ্টি করে চলেছে। এই সংকটগুলির অনেকগুলি দৃশ্যমান ও আলোচিত হলেও একটি বিপর্যয় নিয়ে আজতক কোন আলোচনা চোখে পড়ে নি। এই সংকট দ্বিবিধ:

                এক. গোটা পৃথিবী জুড়েই করোনায় মৃত্যুও মোট সংখ্যা নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যু ঘটছে দ্বিগুণ। আরও দু” বছর যদি এমনটা চলে তবে সমাজে নারী-পুরুষের সংখ্যা ভারসাম্য চিত্রটি হবে এবং সে ক্ষেত্রে করণীয়।

                দুই. করোনাকালে মানুষের যে কোন মৃত্যু ঘটতে পারে এমন আশংকা বৃদ্ধির সাথে সাথে বহু পরিবারে, বিশেষত: প্রাচ্যের বিশাল জনসংখ্যা সম্বলিত দেশগুলিতে বাল্য বিবাহের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়াতে অকাল মাতৃত্ব, প্রসবকালীন জটিলতা বৃদ্ধি এবং পরিণতিতে  মাতৃত্ব ও শিশু মৃত্যুও উদ্বেগজনক বৃদ্ধির আশংকা।

                 টেলিভিশনের একাত্তর চ্যানেল প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষিত করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ঘোষণাকালে মোট মৃত্যুর সংখ্যার মধ্যে পৃথকভাবে নারী-পুরুষের মৃতের যে সংখ্যা দেড় বছর ধরে প্রচারিত হয়ে আসছে তা দেখেই আমার মনে এমন আশংকা বৃষ্টি হয়েছে। অপরাপর চ্যানেলেও হয়তো বা এই ভাবে নারী-পুরুষের মৃত্যুর সংখ্যা প্রচারিত হচ্ছে। তবে বিদেশী কোন নিউজ চ্যানেলে, যেমন সিএনএস, বিটিসি বা কলকাতা নিউজ জাতীয় জনপ্রিয় চ্যানেলগুলিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন প্রচারিত হলেও নারী-পুরুষের সংখ্যা পৃথকভাবে প্রকাশ করতে একদিনও দেখিনি।

তাই বাধ্য হয়ে গুগলস্ সার্চের স্মরণাপন্ন হলাম। সেখানেও কোন দেশের মোট মৃত্যুর সংখ্যা পেলেও, নারী-পুরুষ এর সংখ্যা আলাদা করে পাওয়া গেল। তবে সাধারণভাবে নারীর মৃত্যুর সংখ্যা পুরুষের চাইতে অনেক কম বলে উলে­খ করা হয়েছে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক শিক্ষিকা, গবেষক ইতোমধ্যেই কেন এমন ঘটছে তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে বেশ অনেকদিন হলেও তবে কোন সম্বলিত ফল তাঁরা আজও এ ব্যাপারে প্রকাশ করেন নি। শুধুমাত্র সাধারণভাবে নারীর দৈহিক কাঠামোগত বৈচিত্রের ফলে এমন ঘটনা ঘটছে এটা সকলেই উলে­খ করছেন যে এটিই একমাত্র কারণ বলে মনে করাটা ভুল হবে। তাই অক্সফোর্ডসহ পাশ্চাত্যেও নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলাফল জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।মৃত্যুর সংখ্যা জনসংখ্যা এর সাথে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হলেও সকল দেশেই নারী মৃত্যুর সংখ্যা পুরুষের চাইতে অনেক কম ঘটছে। একটি বিষয়ে নারী-পুরুষ মৃত্যুদের মধ্যে মিল আছে আর তা হলো উভয় ক্ষেত্রেই মৃতদের বয়স বেশী। কম বয়সীদের মৃত্যুও সংখ্যা তুলনামূলক নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই কম।

কিন্তু তবুও এ কথা সকল দেশেই সত্য যে, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যুবক-যুবতীরাও যথেষ্ট সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন এবং তাঁদের মধ্যে মৃত যুবতীদের সংখ্যা যুবকদের সংখ্যার তুলনায় ৩০ ভাগ মাত্র।

জটিলতা, আশংকা এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং সকল আঞ্চলিক যুদ্ধেও একতরফাভাবে কি সেনা সদস্যের ক্ষেত্রে, কি সিভিলিয়ানদের ক্ষেত্রে উভয় ক্ষেত্রেই বিশাল সংখ্যক পুরুষের মৃত্যু ঘটায় নারী-পুরুষের  সংখ্যাগত যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল এবং ঘোষিত— উভয় ক্ষেত্রেই জীবিত নারীর সংখ্যা বিশেষত: জীবিত পুরুষের সংখ্যা, বিশেষ করে যুব সয়সের ক্ষেত্রে অনেক কম হওয়ার ফলে একাধিক যুবতী মাত্র একজন যুবকের সাথে ঘর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের অনেক বছর লেগেছিল অধিকহারে সন্তান জন্ম দিয়েনারী-পুরুষের সংখ্যার ক্ষেত্রে মোটামুটি ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে।

কিন্তু এই সব যুদ্ধে তো পৃথিবীর সকল দেশ ও সকল অঞ্চল কখনও লিপ্ত হয় নি। হয়তো বড় জোর ২০/২৫টা দেশে যুদ্ধেও কবলে পড়ে যুব মৃত্যু অস্বভাবিক সংখ্যায় ঘটেছিল। ফলে এ সব দেশে একদিকে বিধবা যুবতী  ও অপরদিকে অবিবাহিত যুবতী উভয়ের সংখ্যাই অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সামাজিক ভারসাম্য, সামাজিক শৃংখলা ও সামাজিক বৈষম্য ও এর ফলে মারাতœকভাবে বিপর্যস্ত হয়।

কিন্তু দেড় বছর যাবত করোনা মহামারির কবলে পড়ে প্রতিটি দেশেই প্রতিদিন অসংখ্যা মানুষের প্রাণহানি ঘটছে- তাই বিপর্যয় ঘটবে পৃথিবীর সকল দেশেই। করোনা-উত্তরকালে এর প্রকৃত চিত্র এবং নানা দেশে সৃষ্ট নারী-পুরুষের ভারসাম্যের সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে তবে সেই সময়টা কতদিনে আসবে, কতদিনে বিশ্বের দেশগুলি করোনামুক্ত হবে- কোন দেশের কোন বিশেষত্বই আজ অবধি সে বিষয়ে কোন ভবিষ্যবাণী করতে পারেন নি।

বিশ্বেও করোনা পরিস্থিতি এই মুহুর্তে বৈচিত্রময়। কোন দেশে সংক্রমিতের ও মৃত্যুর সংখ্যা কমছে- কোন দেশে তা বাড়ছে।  আবার কোন মাসে যে দেশে বাড়ছে- সে দেশে পরের মাসে কমছে। আবার প্রতিদিনের সংখ্যাও অনির্দিষ্ট। ফলে যতই করোনার মেয়াদ বাড়ছে, সামাগ্রিক অর্থে বিশ্বে ততই সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। ফলে সর্বত্র মানুষের মনে আতংক, উৎকণ্ঠা উদ্বেগের সীমা-পরিসীমা নেই। আজ যে সধবা- কাল সে বিধবা। আজ যার স্ত্রী জীবিত-কাল সে একা। পরিণতিতে পারিবারিক দূর্যোগে সন্তানদের দেখাশুনা, পড়াশুনার  ব্যবস্থা বহু পরিবারেই বিপর্যস্ত।

দুই. এই পরিস্থিতিতে আইন কানুন, ঐতিহ্য, শিক্ষা-দীক্ষার তোয়াক্কা না করে বাল্য বিবাহের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। স্বামী হারা স্ত্রী ভাবছেন তাঁদের মেয়ের অসহায়ত্ব- তাই তার বয়সের  দিকে না তাকিয়ে, লেখাপড়া বা ভবিষ্যত জীবন কেমন হবে এসব না ভেবেই অতি অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। তেমনই আবার মাতৃহারা শিশুকন্যার দেখাশুনা, দৈনন্দিন  জীবনের প্রথম খেয়াল করার সুযোগ হারিয়ে যাওয়ায় মেয়ের অল্প বয়সেই মেয়েকে পাত্রস্থ করেন। আবার মেয়ের শ্বশুর মারা যাওয়ায় শ্বাশুড়ি দ্রুত তাঁর নাবালক ছেলেকে বিয়ে দিচ্ছেন সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়।

সামাজিক এই বিপর্যয়ের মূখে পড়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীর- অনেকটা চোখ বুজে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনার কারণে বিয়ে, বৌভাত প্রভৃতি অনুষ্ঠানে অতি নিকটজন ব্যতীত কাউকে নিমন্ত্রণ না জানানোর কারণে এ ধরণের বাল্য বিয়ের ঘটনাগুলি খুব  একটা জানাজানিও হচ্ছে না।

সর্বোপরি করোনার দীর্ঘ মেযাদের কারণে সকলদেশেরই নাগরিক জীবনে যে আর্থিক বিপর্যয় নেমে এসেছে- তার অভিঘাতে দরিদ্র পরিবারগুলি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সন্তানদের উপযুক্ত বয়স হওয়ার, বা বিদ্যাশিক্ষা অর্জনের বা চাকুরি-বাকরির সন্ধান পাওয়ার তোয়াক্কা না করে তাদের বিয়ের পিড়িতে বসাচ্ছেন।

সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। অকাল মাতৃত্ব , অপরিপক্ক শিশুর জন্মদান, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু নির্ঘাত বৃদ্ধি পাবে যা সমাজে অনুভূত হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।

এ ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে যে চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে তা অকল্পনীয়। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের পর বাহাত্তরে যে অটো প্রমোশন দেওয়া হয়েছিল তার পরিণতি ভাল হয় নি- তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এবার সমগ্র পৃথিবীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ৮/১০টা দেশ বাদে- দেড় বছর যাবত বন্ধ এবং আরও কতদিন তা বন্ধ রাখতে হবে তা নেহায়েতই অনুমান সাপেক্ষ। ফলে মেধার বিকাশ ঘটছে না। নতুন  নতুন সুশিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা, বা শিক্ষক, সাহিত্যক, বুদ্ধিজীবী তৈরী হচ্ছেন না- ভাল জনদরদী মানসম্পন্ন সরকারি আমলা কর্মচারীর ক্ষেত্রেও সংকট আসন্ন। আগামী দশক থেকেই সংকট তীব্র ও দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।

 যে হারে দারিদ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে- তার গতি দ্রুত রোধ করতে না পারলে সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ারও আশংকা।

আর্থিকভাবে দুর্বল দেশগুলির পরনির্ভরতা নিশ্চিতই বৃদ্ধি পাবে। আবর একই এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ধূর্ত ধনিক শ্রেণী আরও বেশী করে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হবে এবং তা ইতোমধ্যেই অন্তত: আমাদের দেশে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

এ পরিস্থিতিতে উৎপাদনশীল অর্থনীতি, ক্ষুদ্র শিল্প, কুটির শিল্প, সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন-এগুলিই হতে পারে সর্বাধিক সংখ্যক বেকারত্ব দূরীকরণ ও অর্থনীতি চাঙ্গাকরণের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। একই সাথে কৃষি ক্ষেত্রে নানাভাবে ভর্তুকি প্রদান-বছরের বর্ষকালের শুরু থেকে অন্তত: ছয়মাস প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকের জন্য স্বল্প মূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করাও প্রয়োজন।

একই সাথে করোনা ভ্যাকসিনের ব্যাপক প্রয়োগ (বিনামূল্যে) নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

এভাবে বহুমুখী তৎপরতাই কেবল পারে সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক,

সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *