শরীফুজ্জামান। আমরা তাকে শরীফ নামেই চিনি। আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। বড়োই সুবোধ ছেলে ছিলো। লেখাপড়া, খেলাধুলা, আচার-আচরণ সবই ভালো। দোষ বলতে বিয়ের দু’বছর পর থেকে বাবা-মার সাথে কোনরূপ সম্পর্ক নেই। নানান রোগে-শোকে ভূগে বছর তিনেক পূর্বে বাবা গত হয়েছেন মা বেচারী বড় কষ্টে বুকে পাথর বেঁধে দিন গুজরান করছেন। ভাগ্যগুণে শরীফ বড় একটা চাকুরীও পেয়ে যায়! বিয়েও করেছে ধনীলোকের একমাত্র কন্যা দুলারিকে। চাঁদের মতো ফুটফুটে একটি সন্তান এসেছে কোলজুড়ে। কোনরূপ ঝুট-ঝামেলা নেই দেশীয় কালচারে, এক্কেবারে সুখী সংসার। ছবির মতো ছোটোখাটো ছিমছাম সুন্দর সংসার। আনন্দ-ভালোবাসায় ঘিরে থাকা পরিবার। ঢাকার অভিজাত এলাকায় নিজস্ব বিশাল প্রাসাদ! প্রাসাদের নাম “স্বর্গচূড়া”! টাকা-কড়ি, সোনা-দানার কোনো অভাব নেই। শুধু সুখ আর সুখ, আনন্দ আর আনন্দ…! স্বর্গীয় সুখ যেনো নেমেছে ধরায়! হঠাৎ এই সুখের ঘরে লাগলো আগুন, উঠলো ঝড়! এলো বিশ্বজুড়ে মরণব্যাধি করোনা! যার হিলোল কলোলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার “স্বর্গচূড়া”! শরীফের হলো করোনা! প্রাণ ভয়ে সন্তানসহ প্রাসাদ ছাড়লো সুখপাখি দিলারি। বিশাল প্রাসাদে প্রচণ্ড জ্বরে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে শরীফ! একমাত্র অনুগত চাকর নিমাই দূর থেকে দিয়ে গেলো পানি! শরীফ কাঁদে হায় এই দুঃসময়ে আজ কেউ নেই!! আহ্ কষ্ট, ভীষণ কষ্ট! ঘুমের ঘোরে মা মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠে শরীফ! নিমাই ছুটে আসে। স্যার খুব কষ্ট হয়? ভীষণ কষ্ট নিমাই, ভীষণ কষ্ট!! আর বুঝি বাঁচবো না। দূর থেকে মোবাইলটা দে তো নিমাই, আহ্ আর বাঁচি না! হ্যালো, হ্যালো মা, আমি তোমার হতভাগ্য ছেলে শরীফ, আমার করোনা হয়েছে মা, আমার ভীষণ জ্বর, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মা, আমি মরে যাবো মা! দুলারি মৃত্যু ভয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, ক্ষমা করে দিও মা…!! পরের দিন বিকেলে কার কোমল স্পর্শে ঘুম ভাঙে শরীফের। কে, কে তুমি, মা! মা তুমি এসেছো!! দূরে সরো, দূরে সরে যাও, আমার করোনা হয়েছে, তুমি মরে যাবে, সরে যাও… এসব কী বলিস তুই? আমার কলিজার টুকরা জ্বরে কষ্ট পাচ্ছে আর আমি দূরে যাবো তা কি করে হয়রে সোনা! মরণ এলে মা- ছেলে একসাথেই না হয় মরবো! মা, মাগো! আমায় ক্ষমা করো মা! আমি ভুল করেছি, তোমাকে ও বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি মা! মা স্নেহের হাত শরীফের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলেন- তুই আমার কোলে মাথা রেখে একটু পায়েসটা খেয়ে নেতো। তুই ভীষণ পছন্দ করিস তাই আসার সময় খুব তাড়াহুড়ো করে বানিয়ে এনেছি। একটু খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নে বাপ! তোর অসুখ সেরে যাবে। শরীফের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্র“ ঝরতে শুরু করলো… মা তার মমতার আঁচল দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো- তাড়াতাড়ি একটু মুখে দে বাজান, আমাকে আর কাঁদাসনে…. দাও মা, কতোদিন তোমার হাতের পায়েস খাইনি!! আহ্ কী তৃপ্তি, কী শান্তি!! মা আমি মরতে চাইনা মা, আমি বাঁচতে চাই মা, তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই মা….!! তোর কিছু হয়নি খোকা, তুই ভালো হয়ে যাবি, আমি তোর জন্যে আঁচল পেতে সারারাত দোয়া করেছি, তুই সুস্থ হয়ে যাবি বাজান, তুই সুস্থ হয়ে যাবি…। কয়েকদিন যেতে না যেতেই শরীফ অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। করোনা টেস্ট করে দেখা গেলো তার রেজাল্ট নেগেটিভ! ডাক্তার পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে জানালেন শরীফ সাহেব এখন অনেকটাই সুস্থ, তাঁর করোনা হয়নি, হয়েছিলো টাইফয়েড জ্বর। মা আলহামদুলিলাহ বলে জায়নামাজে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন আর শরীফ অবাক বিস্ময়ে অপলক চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকলো তার মায়ের দিকে…! আহারে! এই মাকে সে কতোই না অবহেলা করেছে, অবজ্ঞা করেছে! স্ত্রী-সন্তান পেয়ে যে মাকে সে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো সেই মা নিজের জীবন বিপন্ন করে যমদূতের হাত থেকে আজ তাকে ছিনিয়ে এনেছে। ভাবতে-ভাবতে শরীফ মায়ের পা জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলো। মা তার পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে অশ্র“ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন- তুই কাঁদিসনে বাজান, তোর কান্না আমি সইতে পারি না! শরীফ মা বলে চিৎকার দিয়ে ছোট্ট শিশুর মতো মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো…।
মুহাঃ জোহরুল ইসলাম
ভাইস প্রিন্সিপাল ,বিড়ালদহ ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা পুঠিয়া, রাজশাহী।