• Thu. Nov 21st, 2024

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের
অপ্রত্যাশিত কালো অধ্যায়
(মানিক মজুমদার)

নজরুল ইসলাম জীবনকে দেখেছেন বাস্তবতার স্বচ্ছ আলোয়। কিন্তু সত্যবাদী ন্যায়পরায়ণ এই মানুষটিকে যৌবনে যেমন মোজাফ্ফর হোসেন, বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত, মিসেস এম রহমান প্রমুখ সজ্জনের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় চলার পথে এগিয়ে গিয়েছেন তেমনি আলী আকবর খান মোহিত লাল মজুমদার ও সজনীকান্ত দাস এর মতো কুচক্রী বন্ধুসম পরিচিতজনদের কারণে তাকে নানা বিড়ম্বনা সহ সজ্জনমহলে এবং ব্যক্তি জীবনে অনেক অপমানিত হতে হয়েছে। নজরুলের সরলতার সুযোগ নিয়ে আলী আকবর খান তার বিকৃত রুচির সাথে নজরুলকে জড়িয়ে নিজের দরিদ্র সুন্দরী ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন কে নজরুলের পিছনে লেলিয়ে দেন। নজরুল যুদ্ধে যাবার আগে থেকেই বাঁশি বাজাতে পারতেন। তাঁর বাঁশির আওয়াজে সৈয়দা খাতুনের হৃদয় নেচে উঠতো। গান, বাঁশি, স্বরচিত কবিতা পাঠ ইত্যাদির মধ্যে কয়েকদিনের মাথায় নজরুলের সঙ্গে সৈয়দা খাতুনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলো। নজরুল তখন সবে ২২ বছরের যুবক। এ বয়সে স্বভাবতই একজন যুবকের সুন্দরী যুবতীর প্রতি আকৃষ্টতা গড়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত উলে­খ্য কাজী নজরুল ইসলাম তার জন্মভুমি চুরুলিয়া গ্রামেরই আত্মীয়ের মেয়েকে বাল্যকাল থেকেই পছন্দ করতেন। যৌবনের শুরুতেই ভালোবেসেছিলেন। তাঁদের বাড়ির অতি নিকটেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাঁর আসা যাওয়া ছিল। মেয়েটির বাড়ি চুরুলিয়ার পাশ্ববর্তী নিমসা গ্রামে। মেয়েটি দেখতে শুনতে অপূর্ব সুন্দরী ছিল। ঐ মেয়েটিই নজরুলের জীবনের প্রথম প্রেমিকা। বাল্যকালের এই প্রণয়িনীকে তিনি করাচী থেকে ফিরে এসে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। নজরুল ঐ মেয়েটিকে জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসতেন। কিন্তু ভবঘুরে দরিদ্র কবির সাথে বিয়েতে মেয়ে বাড়ির প্রবল আপত্তি থাকায় এ বিয়ে হয়নি। নজরুলের ভালবাসার সার্থকতার জন্য তাঁর মা মেয়ের বাবার কাছে অনুরোধ নিয়ে গেলে তিনি নিমর্মমভাবে প্রত্যাখাত হয়েছিলেন। নজরুলের জননী জাহেদা খাতুন দরিদ্র ছিলেন কিন্তু প্রখর আত্মমর্যাদা জ্ঞান সম্পন্না এই রমণী কোনো অবস্থাতেই তাঁর বংশ মর্যাদাকে ধুলোয় লুণ্ঠিত হতে দেননি। তাই মেয়ের বাপের অর্থ ও বংশর দাম্ভিকতা শুনে তিনি ছেলেকে এ বিয়েতে আপত্তি জানান। নজরুল একরোখা ও প্রচন্ড জেদি। মায়ের নিষেধ অমান্য করে জিদ ধরলেন ঐ মেয়েকেই বিয়ে করে তাঁকে নিয়ে কোলকাতায় চলে যাবেন। ইতোমধ্যে মেয়ের বাবা একদিন প্রকাশ্যেই নজরুলকে গালমন্দ করলেন এবং তাঁর মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করার চেষ্টা করলে তার পরিণাম ভাল হবে না বলে শাসিয়ে দিলেন। মেয়ের মন নজরুলের হৃদয়ে বাঁধা থাকলেও তখনকার দিনে গ্রাম্য একটি অশিক্ষিত সাধারণ মেয়ের পক্ষে বাবার অবাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়ে করার সাহস ছিল না, তাই তার বাল্য প্রণয়িনীকে পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করে মনের দুঃখে চুরুলিয়া ত্যাগ করেছিলেন। এই বাল্য প্রণয়িনীকে নজরুল অনেকদিন মনে রেখেছিলেন। যুদ্ধে যাওয়ার সময় প্রেমিকার মাথার ১টি কাঁটা তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন। এই কাঁটাটি সযতেœ রেখেছিলেন অনেকদিন, পরবর্তীতে মুজফ্ফর আহমদের অসাবধানতার কারণে কাঁটাটি বালিশের নিচ থেকে হারিয়ে যায়। মেয়ের বাবা মেয়েটিকে অন্যত্র বিয়ে দেবার চেষ্টা করলে মেয়েটিও প্রথমদিকে ঘোর আপত্তি জানায়, পরে অবশ্য মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। কবি মনের এই অন্তর্বেদনা তাঁর ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থে উৎসর্গ পত্রে লিখেন-
‘মানসী আমার!
মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে
ক্ষমা করনি,
তাই বুকের কাঁটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’
কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ একই বাড়িতে নজরুল ও আলী আকবর খান পাশাপাশি বাস করতেন। সেখান থেকেই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই নজরুলের জীবনে অন্ধকারময় দিনের উদয় হবে কে ভেবেছিলেন। আলী আকবর খান পেশাগত জীবনে পুস্তক প্রকাশক ছিলেন। তার গোপন ইচ্ছা ছিল নজরুল ইসলামকে কৌশলে নিজ করায়ত্বে নিয়ে স্কুল পাঠ্য পুস্তকের ব্যবসায় সফলতা অর্জন করা। নজরুলের ‘লিচুচোর’ কবিতাটি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এই আলী আকবর খান এবং আফজালুল হকের পাল­ায় পড়ে নজরুলকে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। নজরুলের বিরহ জীবনের কাহিনী শুনে তার মনে কুবুদ্ধি আসে। সে সুযোগ বুঝে নজরুলকে নিয়ে কুমিল­া বেড়াতে আসেন। মুজফ্ফর আহমেদ নিষেধ করলেও নজরুল সেদিন ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে আলী আকবরের কথায় কুমিল­া চলে আসেন। সেখানে নিজের অজান্তেই ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন নজরুল। তারা যখন ভালোবাসার মোহে আবদ্ধ তখন আলী আকবর মিথ্যা সাজানো বিশেষণ দিয়ে নজরুলের পৈত্রিক পরিচিতি তুলে ধরে তাকে চুরুলিয়ার আভিজাত্য গৌরবে বিপুল গৌরবান্বিত আযমদার ও ‘মুসলিম বঙ্গের রবি কবি’ উলে­খ করে তার ভাগ্নির সাথে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র ছাপানো হয়। ‘মোহাম্মদী’ ও ‘বাঙালি’ পত্রিকাতেও ছাপা হলো সেই নিমন্ত্রণ পত্র। বিবাহের তারিখ ঠিক হয়েছিল ৩ আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ। পরিচিতজনদের কাছে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরণ করা হয়। নিমন্ত্রণ পত্র পড়ে মুজফ্ফর আহমেদের কপালে ভাঁজ পড়লো। প্রচন্ড মনোকষ্ট পেলেন নজরুলের সকল বন্ধু শুভানুধ্যায়ীগণ।
এতকিছুর পরেও বিয়ের আসরে কাবিনের শর্ত নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছিল, আলী আকবর খান সাহেব আগেই বুঝেছিলেন নজরুল বিয়ে সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ। এই অবস্থায় তিনি তার লোকজন দিয়ে কাবিননামায় দাবি করেছিল যে, বিয়ে হলেও নজরুল বউ নিয়ে যেতে পারবে না অন্যত্র, বরং নজরুলকেই শ্বশুরবাড়ি থাকতে হবে’। তখন নজরুল বুঝতে পারে আকবর সাহেব তার প্রকাশনা ব্যবসাকে জমিয়ে রাখতে নজরুলকে ভাগ্নির সাথে বিয়ে দিয়ে বন্দী করে রাখতে চেষ্টা করছেন। তাঁর বিধবা দিদি একা বাড়িতে থাকবেন এ অজুহাত দেখিয়ে নজরুলকে ঘরজামাই হয়ে দৌলতপুরে থাকতে হবে কাবিনের শর্ত আরোপ করায় সে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে বিবাহ বাসর ছেড়ে পলায়ন করেছিলেন। তবে একথা সত্য এক দু’মাসের পরিচয় হলেও নজরুল প্রকৃতপক্ষে সৈয়দা খাতুনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। নজরুল ছিলেন প্রেমের কাঙ্গাল। তাই প্রেম বিলোনেতে তাঁর কমতি ছিল না। সে সৈয়দা খাতুনকে ‘নার্গিস’ নাম দিয়ে তাকে নার্গিস বলে ডাকতো। অপরদিকে সৈয়দা খাতুন মাতুলের নির্দেশে নিপুণ অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। নজরুলের যোগ্য স্ত্রী হিসেবে সৈয়দাকে গড়ে তোলার নামে দরিদ্র বিধবা বোন আর ভাগ্নিকে তার বাড়িতে নিয়ে এসে শিক্ষা দীক্ষার নামে ঘন্টার পর ঘন্টা দরজা বন্ধ করে পরামর্শ করেছেন। তাঁর এসব উদ্ভট কর্মকান্ড দেখে নজরুলের কপালে ভাঁজ পড়তে লাগলো, সংসারের কর্ত্রী বড় বোন এসব দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেও কিছু বলার ক্ষমতা ছিলনা, তাতে বড়লোক ভাই অসন্তুষ্ট হয়ে ক্ষতি করবে। ভাবী স্ত্রীর এমন বেপরোয়া মনোভাব দেখে নজরুলের মন বিষিয়ে উঠেছিলÑ তিনি তখন এই চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসে সে বুঝতে পারে সৈয়দা খাতুন তাকে আদৌ ভালবাসে না- ভালোবাসার অভিনয় করে। ভালোবাসা নিয়ে অভিনয় নজরুলের অসহ্য, তাই মনটাকে শক্ত করে নজরুল নার্গিসকে প্রত্যাখান করেন। নজরুলের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন শৈলজানন্দ। তিনি একদিন তার সাথে দেখা করতে গেলে নজরুল নীরবে নার্গিসের পত্রটি বাড়িয়ে দেন। তিনি পত্রের উত্তর লেখার কথা বলতেই নজরুল লিখেন-
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে।
ভুলে যাও তারে, ভুলে যাও একেবারে
আমি গান গাহি আপনার দুঃখে তুমি কেন আসি দাঁড়াও সম্মুখে
আলেয়ার মত ডাকিওনা আর নিশীথ অন্ধকারে।’
শেষের পঙক্তিতে লিখলেন-
‘আমি কি ভুলেও কোনদিন এসে দাঁড়িয়েছি তব দ্বারে?
ভুলে যাও তারে, ভুলে যাও একেবারে।

প্রথম জীবনে মামার চক্রান্তে নজরুলের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করলেও পরবর্তীতে নজরুলের প্রতি গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল নার্গিসেরও। সে ভালাবাসা থেকে তিনি লেখক হিসেবে বেশ কিছু রচনা করে গ্রন্থও প্রকাশ করেছিল। মধ্য বয়সে সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে যখন আজীজুল হাকীমের বিয়ে ঠিক হয় তখনও পত্রে নজরুলের সম্মতি চেয়েছিলেন। বিচ্ছেদের প্রায় ১৬ বছর পর ১৯৩৭  সালে ১ জুলাই নার্গিস খানমকে একটি পত্রে নজরুল উলে­খ করেছেন- ‘তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি- তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না- আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’ তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম সে রূপ চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। তুমি ভুলে যেওনা আমি কবিÑ আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি, অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়...’।
এ পত্রে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় নজরুল তাঁর নার্গিসকে কতটা ভালবেসেছিল এবং কতটা ব্যথা পেয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল সেদিন।

কবি তাঁর মানসীকে নিখিল বিশ্বের যাবতীয় সৌন্দর্য রাশি দিয়ে নিটোল প্রতিমার মতো গড়ে তুলেছিলেন। প্রিয়ার অপরূপ প্রেমকে অবলম্বন করে তিনি যে মধুর সঙ্গীত রচনা করেছেনÑ সে সঙ্গীত অমর সঙ্গীত। কবির একদিন মৃত্যু হবেÑ তাঁর মানসপ্রিয়াকেও এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে কিন্তু তাঁর গান হাজারো কণ্ঠে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হবে। কবির মৃত্যু হলেও এ সকল গানের মধ্যে কবি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কবি তাঁর মানসীকে নিয়ে লিখেছেনÑ
‘তোমারে চাহিয়া রচিনু যে গান
কণ্ঠে কণ্ঠে লভিবে তা প্রাণ,
আমার কণ্ঠ হইবে নীরব, নিখিল কণ্ঠ মাঝে
শুনিবে আমারি সেই ক্রন্দন সে গান প্রভাত সাঁঝে”
১৯২২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে নজরুল ৪র্থবারের মতো কুমিল­ায় যান। কুমিল­ায় প্রায় ৪মাস অতিবাহিত কালে তার সঙ্গে আশালতা সেনগুপ্তের হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আশালতার ডাক নাম ছিল দুলি। নজরুল তার নামকরণ করলেন ‘প্রমীলা। আশালতার পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে তার মা শিশুকন্যার হাত ধরে দেবর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কুমিল­াস্থ কান্দিরপাড়ের বাসায় বাস করতেন। প্রমীলা তখন ১৪ বছরের যুবতী। নজরুল তার প্রেমে আপ্লুত হয়ে লিখলেন ‘বিজয়িনী’ কবিতা, সেটি ডাকযোগে কলকাতায় পাঠিয়ে মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশ করা হলো। কবিতাটি ছিলÑ
‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে’

 প্রেমের ব্যর্থতায় কবি হৃদয় যখন শুষ্ক মরুভূমির মতোই। কবির তাপিত হৃদয় খুঁজে বেড়ায় একটু সান্ত্বনার বাণীÑ একটু ভালোবাসার ছোঁয়া। প্রমীলার ভালবাসার সুগন্ধি মেখে কবিচিত্র আজ শান্ত, তাই কবি বলে উঠেনÑ

“আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিজয়িনী বিপুল দেউল তা হতে টলমল
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চুঁড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে…
কুমিল­ার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবার অনেক উদার ও অনেক বেশি অসা¤প্রদায়িক ছিলেন। বিরজাসুন্দরী দেবীর স্নেহ এবং গিরিবালাদেবীর মমত্ব ও ভালোবাসায় নজরুল এই পরিবারেরই একজন হয়ে উঠলেন। দেীলতপুরের সৈয়দা খাতুন নজরুলকে বিষ তুলে দিয়েছিলেন, নজরুল নীলকণ্ঠ হয়ে সেই গরলকে অমৃত বলে পান করেছিলেন। তাঁর দেওয়া বেদনাকে বুকে পেতে নিয়েছিলেন, সেই বেদনায় শান্তির প্রলেপ দিয়েছিলেন প্রমীলা দেবী। ব্যথাতুর কবির হৃদয়ের বেদনা যে কত গভীর, প্রমীলা দেবীর বয়স তখন অল্প হলেও তিনি তা পরখ করেছেন, তাই কবিকে বাঁচাতে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সকলের অগোচরে নজরুলকে তিনি হৃদয়ের রাজা করে মনে বরণ করে নিয়েছিলেন। দৌলতপুরে নজরুল হারিয়েছিলেন তার মানসপ্রিয়াকে আবার কাঁদিরপাড়ে তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর জীবনসঙ্গীনীকে। কিন্তু মুসলমানের ছেলের সাথে হিন্দু মেয়ের বিবাহ অনেকেই সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। এ নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে তুমুল বাকবিতন্ডা ও উত্তেজনা দেখা দিল। এমনকি নজরুলকে প্রাণনাশের জন্যও কেউ কেউ গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছিল। আশালতা ও নজরুলের বিয়ে শুনে মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী ও প্রমীলার কাকা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তও আপত্তি জানালেন। চারিদিকে বাধার পাহাড় সৃষ্টি হলেও কোন শক্তিই পারলো না তাদের প্রেমে মিলনের পথে বাধা হতে। একমাত্র মেয়ে প্রমীলার সুখ তার মনের আশা পূর্ণ করতে গিরিবালা দেবী বিয়েতে মত দিলেন। সবাইকে ছেড়ে তারা কোলকাতায় চলে গিয়ে নজরুলের মাতৃসমা মিসেস এম রহমান এর তত্ত¡াবধানে বিয়ে সম্পন্ন করলো। নজরুলের বয়স তখন মাত্র ২৩ আর প্রমীলার ১৬।
হিন্দু মুসলমানের বিযেতে উভয় স¤প্রদায়ের দিক থেকে প্রবল প্রতিবাদ ও গোলমালের আশঙ্কায় বিয়ের সঠিক তারিখ যথাসম্ভব গোপনে রাখা হয়েছিল। মিসেস এম রহমান সকল সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে নজরুলের বিবাহ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন। এই দুরূহ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নজরুল ‘বিশের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করলেন।
বিয়ে নির্বিঘেœ সম্পন্ন হবার পর সংবাদপত্র মারফত এই সংবাদ সকলে জানতে পেরেছিলেন। এই বিয়ে অনেক শিক্ষিত, বিদগ্ধজনেরাও মেনে নিতে পারেননি। হিন্দু রমণীকে বিয়ে করায় ব্রাহ্ম সমাজের মানুষও নজরুরের উপর ক্ষিপ্ত, প্রবাসী পত্রিকায় নজরুলের লেখা ছাপা বন্ধ করে দেয়া হলো। সজনীকান্ত দাস, হেমন্ত চট্ট্রোপাধ্যায়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার যোগানন্দ দাস প্রমুখ নজরুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় স্বনামে বেনামে নিবন্ধ ব্যঙ্গ কবিতা প্রকাশ হতে লাগলো নজরুলকে নিয়ে। শনিবারের চিঠি’র জন্মলগ্ন থেকেই নজরুলকে ব্রঙ্গ বিদ্রুপ করে কবিতা ছাপা হতে থাকে। ‘আবাহন’ নামে একটি কবিতায় লেখেন-
‘ওরে ভাই গাজিরে
কোথা তুই আজিরে
কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা!
নজরুলের ঐতিহাসিক গান ‘কান্ডারি হুশিয়ার’ এর প্যারোডি ‘বান্ডারি হুশিয়ার’ চরণ নিম্নরূপ ছিল ঃ
‘চোর ও ছ্যাঁচোর চিঁচকে সিঁধেলে দুনিয়া চমৎকার
তল্পি তল্পা, তহবিল নিয়ে ভান্ডারী হুসিয়ার..
আবার ১টি কবিতায় লেখেন-
‘কে উদাসী বনর্গা বাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে,
বাঁশী- সোহাগে ভিরমি লাগে, বর ভুলে যায় বিয়ের কনে।
সমাজের এমন অনেক জ্বালা যন্ত্রণা, ক্ষুধা-দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করেও নজরুল ছিলেন অকুতোভয সত্যেও পূজারী সাহিত্য সৈনিক। তিনি লিখেছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে জাতি ধর্ম, বর্ণ বৈষম্যকে তিনি কখনোই হৃদয়ে স্থান দেননি। তাই সকল ধর্মের বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন। একদিকে গজল লিখেছেন, আরেকদিকে শ্যামা সঙ্গীত। জাতিভেদেও নামে বজ্জাতিকে কোনোদিন বরদাস্ত করেন নি নজরুল। তাই তিনি লিখেছেন-
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব
জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে,
জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া’।
নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর অবদান নজরুল প্রমীলার সংসার যাত্রার পেছনে কম নয়। তিনি কন্যার ভালোবাসা এবং সন্তানসম নজরুলের প্রতি স্নেহপ্রবণ হযে স্বীয় সমাজ ত্যাগ করে নজরুলের বাড়িতে থেকেও হিন্দু আচার অনুষ্ঠান ও ধর্ম বিশ্বাস মতে জীবন যাপন করেছেন। নজরুলের জীবনের সকল সুখে দুখে তিনি পাশে ছিলেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ কবিকে তিনি মাতৃস্নেহে লালন পালন করেছেন। মুসলমান বাড়িতে থেকে হিন্দু ধর্ম পালন, গঙ্গায় স্নান করে পূজা করা এসব কারণে তাঁকে সমাজের কাছে নানারকম ভর্ৎসনা সইতে হয়েছে। যার কারণে অসহ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত হঠাৎ একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন আর ফিরে আসেন নি।
সারাটি জীবন সমাজের হীন মানুষদের কাছে কুচক্রিমহল ও সুবিধাবাদীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হলেও নজরুল মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন সবার উপরে মানুষ সত্য। তাই সমালোচক, কুচক্রিমহল অন্ধকারে বিলীন হলেও স্বীয় সাধনা ও মানবপ্রীতির বলে মৃত্যুঞ্জয়ী কাজী নজরুল মৃত্যুর ৩৭ বছর পরে আজও বেঁচে আছেন সদমে¢-স্বগৌরবে। বাঙালি সাহিত্য যতদিন থাকবে পৃথিবীতে. অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি অনন্তকাল মানুষের হৃদয় মন্দিরে। পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে আমৃত্যু জড় পদার্থের মতো বেঁচে থাকলেও কবির রচিত সাহিত্য সম্ভার তাঁকে সমুজ্জল রেখেছে। সারাটি জীবন মানবতার জয়গান তিনি গাইতে পারেন নি দুষ্টচক্র মানুষদের রোষানলের শিকার হয়ে। শেষ জীবন বধির হয়ে কাটলেও তাঁর সৃষ্ট চেতনার বাণীর জন্যই সাহিত্যানুরাগী সচেতন মানুষ চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।


তথ্যসূত্র: নজরুলের জীবন ও সাহিত্য; ড. সুশীল ভট্টাচার্য, কলিকাতা ভারত,
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক সম্পাদক, সদস্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *