• Thu. Nov 21st, 2024

কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা সেন : জীবনী ও প্রাসঙ্গিক তথ্য (মোহাম্মদ কামরুজ্জামান)

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। তিনি পাবনার গর্ব, পাবনার অহঙ্কার। সুচিত্রা বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর মুখ, ডাগর চোখ। এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সপ্তপদী’র রীনা ব্রাউন, ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির ইন্দ্রাণী, ‘দীপ জে¦লে যাই’-এর রাধা কিংবা ‘পথে হল দেরী’র মলি­কা। অভিনেত্রী হিসেবে সুচিত্রা অদ্বিতীয় এবং অনন্য।
১৯৩১-এর ৬ এপ্রিল সুচিত্রার জন্ম। পিতা করুণাময় দাশগুপ্ত আর মাতা ইন্দিরা দেবীর নিবাস পাবনা শহরের পুরাতন টেকনিক্যাল স্কুল সংলগ্ন হেমসাগর লেনে। পিতা পাবনা মিউনিসিপ্যালিটি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এখানে কাজ করার সময় পৌরসভা চত্বরে তিনি একটি পাম বৃক্ষের চারা রোপন করেছিলেন। কালের সাক্ষী হয়ে তা এখনো বিরাট মহীরুহ রূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুচিত্রার মূল নাম রমা। ডাক নাম কৃষ্ণা। সুচিত্রার নামকরণ অনেক পরের ঘটনা। সুচিত্রা নাম রেখেছিলেন নীতিশ রায়। তিনি ছিলেন পরিচালক নীরেন লাহিড়ীর সহকারী। সুচিত্রারা তিন ভাই, পাঁচ বোন। ছোট ভাই বোনরা তাঁকে রাঙাদি বলে ডাকত। সুচিত্রার মামা তাঁকে ডাকত কৃষ্ণা নামে। অমন যার গায়ের রং তার নাম কৃষ্ণা হলো এটাই বিস্ময়ের বিষয়। এমনও হতে পারে সুভাষণ রীতিতে কৃষ্ণা নাম রাখা হয়েছে যাতে মেয়ের ওপর কারো চোখ না লাগে। সুচিত্রার দাদারা থাকে নাগপুরে। মামার বাড়ি পাটনায়। মাঝে মাঝে আসে কলকাতায়। শোনা যায়, সুচিত্রার বাল্যকালে কিছুটা সময় কেটেছে যশোরে। তাঁর হাতে খড়ি হয় সেখানেই। পাটনায় মামা বাড়ি থেকেছেন কিছুদিন। এরপর পড়াশুনা করেছেন পাবনার মহাকালী পাঠশালা ও পাবনা টাউন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে।
ব্রিটিশ অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার নোয়াখালি ও বিভিন্ন এলাকার ১৯৪৬-এর দাঙ্গা, পারিপাশির্^ক পরিবেশ এবং এই পরিবেশ ক্রমশ পরিবর্তিত হওয়ায় এবং কিছু কিছু উঠতি বয়সের যুবকের আচরণের প্রেক্ষিতে তিনি পাড়ি জমান পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। রমা যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা যান তখন কিশোরী বয়স। তখনো তিনি ফ্রক পরতেন। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরতে না ধরতেই বিয়ে হয়ে গেল ১৯৪৭ সালে। পাত্র দিবানাথ সেন। এরপর নামের সঙ্গে যুক্ত হলে সেন। দিবানাথের সঙ্গে একাধিকবার গেছেন লন্ডনে। বিবিসি’র অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। বিয়ের পর অবস্থান ৩২ নং বালিগঞ্জ, কলকাতায়।
পাবনা থাকাকালীন রমা দু’একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। চলি­শের দশকে মেয়েদের অভিনয় দুঃসাহসিক বলা যায়। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক বিমল সেন তাঁর পরিবারের আত্মীয়। সুচিত্রা সেনের শ্বশুর বিমল সেনের বোনকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে সুযোগ এলো অভিনয় করার। এক্ষেত্রে উৎসাহ যোগালেন স্বামী দিবানাথ সেন। শেষ পর্যন্ত শ^শুর আদিনাথ সেনের অনুমতিক্রমে চিত্রজগতে অভিনয় করতে পারলেন রমা। এ সময় নীতিশ রায় নামটি পরিবর্তন করে রাখেন সুচিত্রা সেন।
সুচিত্রা অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা দীর্ঘ। ১৯৫৩ সালে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদী’ এবং শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘প্রণয় পাশা’। এরপর আর কোনো ছবির জন্য তিনি চুক্তিবদ্ধ হননি। ‘প্রণয় পাশা’ রিলিজ হয় ১৯৭৮ সালের ৯ জুন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ এই দীর্ঘ ২৫ বছরে সব ছবির পরিচিতি স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা দুরুহ। চলচ্চিত্র অভিষেকের প্রথম দশ বছরে তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা ৪৩টি। তুলনামূলকভাবে ষাটের দশকে অভিনীত চিত্রের সংখ্যা নয়। আর সত্তরের দশকে এ সংখ্যা নয়।
পঞ্চাশের দশকে সুচিত্রা অভিনীত ছবির সংখ্যা ৪২টি। এগুলো হল- ‘সাত নম্বর কয়েদী’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘কাজরী’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘অ্যাটম বোম’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘ঢুলি’, ‘মরণের পরে’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘বলয়গ্রাস’, ‘সাঁঝের প্রদীপ’, ‘ভালোবাসা’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শুভরাত্রি’, ‘একটি রাত’, ‘ত্রিযামা’, ‘আমার বউ’, ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরী’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘রাজল²ী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘দীপ জে¦লে যাই’, ‘হসপিটাল’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘বোম্বাইকা বাবু ও ফরহাদ’।
ষাট দশকে সুচিত্রা নয়টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেগুলো হল ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সন্ধ্যা দীপের শিখা’, ‘মমতা’, ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’ ও ‘ মেঘকালো’।
সত্তর দশকে সুচিত্রার অভিনীত নয়টি ছবি হলো ‘নবরাগ’, ‘ফরিয়াদ’, ‘আলো আমার আলো’, ‘হার মানা হার’, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘আঁধি’, ‘দত্তা’ ও ‘প্রণয় পাশা’।
তিনি উত্তম কুমারের বিপরীতে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। এগুলোর মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো- ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘মরণের পরে’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’, ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘সাঁঝের প্রদীপ’, ‘শাপমোচন’, ‘বিপাশা’, ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’, ‘আলো আমার আলো’, ‘নবরাগ’, ‘হার মানা হার’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়া-পাওয়া’ ও ‘প্রিয় বান্ধবী’। মহানায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি হয়েছেন মহানায়িকা। উলে­খ্য, সুচিত্রা-উত্তমের মতো জনপ্রিয় রোমান্টিক জুটি চলচ্চিত্রে বিরল।
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রায় সব নায়কের সঙ্গে তিনি অভিনয় করেছেন। তাঁদের মধ্যে অশোক কুমার, প্রদীপ কুমার, নির্মল কুমার, বসন্ত চৌধুরী, উৎপল দত্ত, বিকাশ রায়, অসিত বরণ, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, প্রশান্ত কুমার, রবীন মজুমদার, সমর রায়, দীপক মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত মলি­ক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের নাম করা যেতে পারে।
তিনি বাংলার পাশাপাশি সাতটি হিন্দী ছবিতে অভিনয় করেছেন। এগুলো হলো ‘দেবদাস’, ‘মুসাফির’, ‘চম্পাকলি’, ‘বোম্বাই কা বাবু’, ‘সরহদ’, ‘মমতা’ ও ‘আঁধি’। ভারতের জরুরি অবস্থার সময় ‘আঁধি’ ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। বিমল রায়, রাজ খোসলা, অসিত সেন, গোলজার প্রমুখ বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। হিন্দি ছায়াচিত্রে যেসব বিখ্যাত নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন তাঁরা হলেন দিলীপ কুমার, শেখর, ভারত ভূষণ, দেব আনন্দ, অশোক কুমার, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জীব কুমার।
সুচিত্রা অভিনীত বাংলা ছবি ৫৩টি আর হিন্দী সাতটি সহ চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৬০। ‘অগ্রদূত’, ‘অগ্রগামী’, ‘যাত্রিক’, অজয় কর, অসিত সেন, সলিল সেন, চিত্ত বসু, দীনেশ গুপ্ত, সুশীল মজুমদার প্রমুখ বিশিষ্ট চিত্র পরিচালকদের চিত্রসমূহ বক্স অফিস সফলতা লাভ করে। সুচিত্রা অভিনীত ছবি ‘সপ্তপদী’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘হার মানা হার’, ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘সবার উপরে’, ‘হারানো সুর’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’, ‘দীপ জে¦লে যাই’, ‘পথে হল দেরী’ ইত্যাদি অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। চিত্রজগতে অভিনয়ের জন্য সুচিত্রা সেন বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছেন। বি এফ জে-এর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন ‘সপ্তপদী’ ১৯৮৩, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ১৯৬৩, ‘আলো আমার আলো’ ১৯৭২, ‘আঁধি’ (হিন্দী) ১৯৭৫।
১৯৬৩ সালে প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে ফিল্মস ফেয়ার পত্রিকার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনীত হন ‘মমতা’ (হিন্দী) চলচ্চিত্রের জন্য, ১৯৮৩ সালে দিল­ীতে অনুষ্ঠিত নবম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব জুরি হিসেবে আমন্ত্রিত হন; কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির জন্য তাঁর যোগদান করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ১৯৫৮ সালে লন্ডন বিবিসি’র বাংলা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথিরূপে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং বক্তব্য রেখেছিলেন।।
ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। সুচিত্রার মতো বড় মাপের শিল্পীর সব সময় জন্ম হয় না। এর জন্য জন্মান্তর অপেক্ষা করতে হয়। ২০০৫-এ তাঁকে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। বিশেষ কারণে শিল্পী পুরস্কার প্রত্যাখান করেন। সুচিত্রার ওপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য ফিচার, নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। আগামীতে বাংলা চলচ্চিত্রের গ্ল্যামার হিরোইন সুচিত্রার ওপর আরো অনেক কিছু লেখা হবে। এখনো তাঁকে ঘিরে মানুষের মনে অসীম কৌতুহল, অন্তহীন আশা। সুচিত্রার নিজের কোনো স্মৃতিকথা নেই। এজন্য তাঁর জীবনের অনেক অজানা তথ্য অজ্ঞাত রয়ে গেল।
ছোটবেলায় রমা সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন। পরবর্তীতে সে চর্চা অক্ষুন্ন থাকেনি। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার রচিত ‘আমার গানের নিমন্ত্রণে আসবে কি?’- এ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। গানটি মোটামুটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সঙ্গীত চর্চা করলে এক্ষেত্রেও তিনি সুনাম অর্জন করতে পারতেন।
সুচিত্রা সেন হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। ‘তাঁর মধ্যে ছিল সহজ বাঙালিয়ানা। চলন-বলন, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার, যাপিত জীবন, পূজা-পার্বণ, বিশ^াস-সংস্কার, মূল্যবোধ, প্রেমের উপলদ্ধি সব কিছুতেই ছিল বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির ছাপ।’ সুচিত্রা সেনের পরিধেয় বস্ত্রের মধ্যেও ছিল আভিজাত্যবোধ। শাড়ি ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পোশাক। তাঁর শাড়ি পরার একটি নিজস্ব স্টাইল ছিল। সেকাল এবং একালেও তা অনুকরণযোগ্য।
চিন্তা-চেতনায় সুচিত্রা সেন ছিল আধুনিক। ধর্মের আনুষঙ্গিক দিক তিনি মেনে চলতেন। তাঁর মধ্যে কোনোরূপ গোঁড়ামি ছিল না। বারো মাসে তেরো পার্বণ তিনি পালন করেছেন। তাঁর শয়ন কক্ষের পাশে ঠাকুর ঘর। এখানে কাঠের এবং সিমেন্টের বেদীর ওপর পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ এবং মা সারদার ছবি। এখানে ধূপকাঠি এবং পঞ্চপ্রদীপ জ¦ালিয়ে গলায় আঁচল দিয়ে ধ্যানমগ্ন হতেন সুচিত্রা সেন। এটা ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। বেলুড় মঠ, রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি স্থানে যেতেন। ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাই তাঁকে এক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে। বেলুড় মঠে তিনি মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
সুচিত্রা সেন সাধারণ খাবার পছন্দ করতেন। মাছ-ভাত ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করে চলতেন। এছাড়া তাঁর পছন্দের খাবার ছিল নারকেলের নাড়–। ফলের তালিকায় শীর্ষে ছিল পেয়ারা। শ্যুটিং-এর ফাঁকে মাঝে মাঝে পেয়ারা খেতেন। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সর্ম্পক। বই পড়া ছিল তাঁর অন্যতম শখ। শোবার ঘরে আলমারিতে ছিল রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের রচনাসমগ্র। তাঁর বইয়ের তাক ইংরেজি সাহিত্যের সম্ভারে পূর্ণ। শেক্সপিয়র ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় নাট্যকার। বই পড়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন চিত্রকলায় অনুরক্ত। তাঁর শয়ন কক্ষের দরজার দুই পাশে বিশিষ্ট শিল্পী যামিনী রায়ের ছবি শোভা পেত। মেয়ে মুনমুন সেনকে চিত্রশিল্পী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। আর এ কারণে দিয়েছিলেন পরিতোষ সেনের মতো শিল্পীর কাছে।
ফুল ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে তাঁকে অভিহিত করা যায়। কলকাতার বাড়িতে জানালার পাশে শিউলি ফুল। বাড়ির বারান্দার দু’দিকে মাধবীলতা। এসব গাছে প্রজাপতি, ফড়িং আর পাখির অবাধ বিচরণ। শালিকের কলরোল, চড়াই আর বাবুই পাখির কিচিরমিচির অনুষঙ্গ তাঁর মন জুড়ে। এদেরকে নিয়েই তাঁর সময় কাটত। মাঝে কিছুদিন জাপানিজ স্পারো পুষেছিলেন, এই তালিকায় ছিল টিয়া পাখিও।
বাংলা ছায়াছবির খ্যাতির শীর্ষে তিনি উঠেছিলেন। সমালোচকের ভাষ্য : “সুচিত্রার চলচ্চিত্র জয়ের আয়ুধ হিসেবে এক অপার সৌন্দর্যময়ী নারী রূপকে প্রধান বলে বিবেচনা করতে চাই, যে রূপ আবার নৃত্যের দিক থেকে বাঙালি মানসের নন্দন পরিসীমার কেন্দ্রে। তাঁর সৌন্দর্য একাধারে মানবী, আবার যুগপৎ প্রতœপ্রতিমা যেন তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর সৌন্দর্যে বিমোহিত, ফলে সহজেই প্রমাণ করা যায় লাবণ্য, আর ভারতীয় আলঙ্কারিকেরা যাকে বিবেচনা করেন মুক্তা ফলের আভা বলে, সুচিত্রার সৌন্দর্যের পরিচায়িকা।”
অভিনয়ের দক্ষতার কারণে সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র জগতে বিশেষ ইমেজ সৃষ্টি করেছিলেন। চিত্রজগতে মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর যে ভূমিকা, তা এককথায় বলা যায় অনন্য। এ সর্ম্পকে বিশিষ্ট কবি মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “সুচিত্রার আগে নায়িকাদের ইতিহাস তো তাঁদের প্রতি তঞ্চকতা, বিশ^াসহানি আর শোষণের ইতিহাস। সিনেমা, নাটকের পেছনে মেয়েদের আত্মত্যাগের কাহিনী উজ্জ্বল হয়ে আছে বিনোদিনীর জীবনী পাঠে। আর্থিক শোষণ তো ছিলই, ছিল মানসিক এবং এমনকি শারিরীক হেনস্থার দীর্ঘ ইতিহাস। ছবিতে, নাটকে পুরুষ প্রাধান্য থাকবে, এটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল। সুচিত্রার এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন তীব্র প্রতিবাদ। মাধবী মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই দিকটির কথা উলে­খ করেছেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রে আর্থিক কৌলিন্যের ধারাবাহিকতা নিয়ে এলেন তিনি। আর পুরুষ সর্বস্বত্বার বিরুদ্ধে দ্রোহ।’
অভিনয়শৈলীর দিক থেকে সুচিত্রা সেন অনন্য। দেশে তো বটেই, দেশের বাইরে বিশ^নন্দিত নায়িকাদের পাশে তাঁর অবস্থান। এদের মধ্যে এলিজাবেথ টেলর, সোফিয়া লরেন, অড্রে হেপবার্ন, ব্রিজিত বার্দোত, গ্রেটা গার্বো প্রমুখের নাম করা যেতে পারে। উপরিউক্ত নায়িকাদের মধ্যে গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে মিল দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে। গ্রেটা গার্বো খ্যাতির শীর্ষে উঠে অভিনয় থেকে বিরত ছিলেন। সুচিত্রাও তাই। দু’জনেই অসম্ভব জনপ্রিয় এবং সাক্ষাৎকার দেওয়া পছন্দ করতেন না।
সত্তর দশকের শেষের দিকে সুচিত্রা সেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন চলচ্চিত্র ত্যাগ করার। সে সময় ছায়াচিত্র জগৎ তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক কিছু প্রত্যাশা করছিল, সেই সময় ঘটল ছন্দপতন। সকলকে বিস্মিত করে চিত্রজগৎ থেকে ইতি টানলেন। দিবানাথ সেনের সঙ্গে শেষের দিকে টানাপোড়ন চলছিল। ‘মেঘকালো’ ছবির শ্যুটিং চলাকালে দিবানাথের মৃত্যু হয়। সব পেয়েও না পাওয়ার বেদনা, এমন একটি শূন্যতার আর্তি রয়েছে সুচিত্রার জীবনে।
দিবানাথ সেনের তিরোধান, একটি পুত্র সন্তানের জন্ম, স্বল্পায়ু এই সন্তানের মৃত্যু, বন্ধুভাবাপন্ন নায়ক সঞ্জীব কুমারের অকাল প্রয়াণ, কিছু মানুষের আচরণ জীবন সর্ম্পকে তাঁর মনে এক বিষণœতার সৃষ্টি হয়। আর এই বিষণœতা থেকে মুক্তিকল্পে মহানায়িকার চিত্রজগৎ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। শেষ জীবনে শান্তি প্রত্যাশায় বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ^রে আশ্রয়। এভাবে সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মহানায়ক উত্তম কুমারের তিরোধান, ভারতনেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে তিনি মুষড়ে পড়েন। মোহময়ী মহানায়িকা অতঃপর হলেন পূজারিনী।
সুচিত্রা সেন রূপালি জগৎ ছাড়েন ১৯৭৮ সালে। শেষবারের মতো লোক সম্মুখে এসেছিলেন ১৯৮৯ তে। নিজের চারদিকে গড়ে নেয়া রহস্যময়তার ঘেরাটোপেই থাকলেন দীর্ঘ ৩৫ বৎসর।
২০১৩ সালের শেষের দিকে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দেয় সুচিত্রা সেনের। বয়সজনিত শারিরীক ক্লেশ ও ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তে ভর্তি হন কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে। প্রথম দিকে সামান্য উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সুচিত্রা সেন প্রয়াত হলেন ১৭ জানুয়ারি ২০১৪-এর শুক্রবার, সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে। সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য অনন্য মাত্রার শোক, গাম্ভীর্য, রাষ্ট্রীয় সম্মান, জনসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলাবোধের অনবদ্য প্রকাশ।
সুচিত্রা সেন এক কিংবদন্তী, সুচিত্রা সেন এক ইতিহাস। তাঁর মতো শিল্পীর আগে জন্ম হয়নি। আগামীতেও হবে কিনা সন্দেহ। কোনো উপমা দিয়েই তাঁর গুণ ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। সুচিত্রা সেনের ভুবন ভোলানো হাসি এখনো চোখে ভাসে। মাঝে মাঝে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলে ভেসে ওঠে, ‘সবার উপরে’, ‘পথে হল দেরী’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ কিংবা ‘হারানো সুর’-এর সুচিত্রার মুখ যা এককথায় বলা যায় অনন্য। পঞ্চাশের দশকের এই শিল্পীর অভিনয় কত লোকের রাতের ঘুম যে কেড়ে নিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। সুচিত্রাকে ভোলা যায় না, ভোলা যাবে না কোনদিনই। তাঁর অভিনয় প্রত্যেকের মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে রইবে চিরদিন, চিরকাল।


তথ্যসূত্র: সূচিত্রার কথা- গোপালকৃষ্ণ রায়।
সূচিত্রা সেন- ড. এম আব্দুল আলীম ‘ভারত বিচিত্রা’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *