• Thu. Nov 21st, 2024

“কোভিড ১৯” ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা (অধ্যাপক ডাঃ ইফতেখার মাহমুদ)

সমস্ত পৃথিবীকে আর্থ-সামাজিক ও ব্যাণিজ্যিক ভাবে ওলট-পালট করে দিয়ে করোনা ভাইরাস নামক একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বিগত এক বৎসরের বেশি সময় ধরে সদর্পে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে।
মহামারির ইতিহাস বলে প্রতি শতকে একটি করে সর্বগ্রাসি অতিমারি আমাদের সাজানো ধরণীকে তছনছ করে দিয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে “প্লেগ মহামারিতে” সমসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর পরই ১৯১৮-২০ সালে “স্প্যানিস ফ্লু”তে আক্রান্ত হয়ে তিন থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ সংহার হয়।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, যেহেতু আমাদের গড় আয়ু কখনই একশো বছর হয়নি সেহেতু এক মহামারি থেকে পরবর্তী মহামারির অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। তৎকালীন সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক জ্ঞান তেমন বিকশিত হয়নি বিধায় রোগ ও চিকিৎসার ধরণ, তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ সঠিকভাবে করা যায়নি।
চীনের উহান শহর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম চিহ্নিত ভাইরাস ও রোগটির নাম “কোভিড ১৯”দেয়া হয়েছে। ভাইরাসটির অতি দ্রুত গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। যেমন কোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, অগ্নুৎপাত, তুষার ঝড় একটা সুনির্দিষ্ট এলাকায় তান্ডব চলায়। কিন্তু “কোভিড ১৯” গোটা পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের আবাসস্থল সাতটি মহাদেশের ২২২টি দেশ প্রায় সমানভাবে সংক্রমিত করেছে।
আমাদের মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, একবিংশ শতাব্দীতে আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তিতে বিষ্ময়কর উৎকর্ষ অর্জন করেছি। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছি। তথাপিও কোভিড ১৯ নামক রোগটির সাথে পৃথিবীর অতি উন্নত দেশগুলোও তেমন সুবিধা করতে পারছে না। ইতিমধ্যে “কোভিড ১৯” এ আক্রান্ত হয়ে ২৯ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, প্রায় ২১ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে গরিব, অনুন্নত দেশের তুলনায় উন্নত দেশগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। স্মরণকালের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে জীবনহানি ও সম্পদ ধ্বংসের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ, এককথায় অনস্বীকার্য।
এখন মনে হচ্ছে “কোভিড ১৯” সংক্রমণ মানব সম্পদ, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও প্রাণহানির দিক থেকে মানব সভ্যতা ধ্বংসের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তি, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব বিকাশও এই দ্রুত সংক্রমিত রোগটিকে বাগে আনতে পারছে না।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, নির্বিচারে বন উজাড়, নদী দূষণ, বায়ু দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি কারণে ওজন স্তরের ক্ষতিসাধন করছি। প্রকৃতি এ সকল বিরূপতায় রুখে দাঁড়িয়েছে ও তার প্রতিশোধ নিতে দ্বিধাবোধ করছে না।
করোনা ভাইরাস একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। আক্রান্ত রোগীর হাঁচি কাশি, করমর্দন, কোলাকুলি ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে অতি দ্রুত এক থেকে অপরে ছড়ায় রোগটি। নাক ও মুখ দিয়ে শ্বাসতন্ত্রে পৌঁছে প্রদাহ সৃষ্টি করে। জ্বর, মাথা ব্যাথা, বমি, শরীর ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট হয় ও শরীরে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। মানবদেহের অন্যান্য অত্যাবশ্যক অঙ্গ যেমন হৃৎপিণ্ড, লিভার, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনি এর উপর ব্যাপক আক্রমণাত্বক প্রভাব ফেলে এবং দ্রুত এই সকল অঙ্গের কার্য্যক্ষমতা বিনষ্ট করে।
বয়ষ্ক মানুষ বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব ও যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত যেমন: হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত তাদের বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।
কয়েকটি অতি সাধারণ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমরা অনেকটাই ভালো থাকতে পারবো, যেমন: সঠিকভাবে ও সঠিক মাপের মাস্ক ব্যবহার, সঠিকভাবে হাত ধৌতকরণ, ক্ষারযুক্ত সাবান, স্যানিটাইজার দিয়ে বাড়ির বাইরে গেলে শারীরিক দূরত্ব, একে অপর থেকে অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, বৃহৎ জন সমাবেশ এড়িয়ে চলা, জ্বর, কাশি, গলা ব্যাথা, শরীর ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ।
আমাদের গর্বের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের প্রতিরোধ (Preventive) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম রোল মডেল। এই সুনিপুণ ব্যবস্থার মাধ্যমে স¤প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
করোনা টিকা শরীরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা (Antibody)) তৈরী করে এবং ভবিষ্যতে করোনা হতে রেহাই পেতে সাহায্য করে। মনে রাখতে হবে বর্তমানে টিকাই একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা, সাথে সাথে মাস্ক পরিধান, হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্বকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
আমরা আশাবাদী ২০২১ সালের মধ্যেই বিশ্ববাসী একটি করোনামুক্ত পৃথিবী দেখবে।

লেখক: অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক (মেডিসিন),
অধ্যক্ষ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ। (অবঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *