• Thu. Nov 21st, 2024

চন্দ্র (আরেফিন শিমুল)

বেশ উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে চন্দ্র (ছদ্ম নাম)। বাবা বড় গৃহস্থ। দুই ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে সে পঞ্চম। তাঁর বড় ভাইটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তখন সে খুব ছোট। খুব বেশি বুঝতো না। তবুও ভাই হারানোর বেদনা তাকে বেশ কষ্ট দেয়।
ধীরে ধীরে কষ্টের ক্ষত শুকোতে থাকে। নদীর পাড়ের মেয়ে সে। নদীর মতোই ছলছলিয়ে কলকলিয়ে তাঁর বেড়ে উঠা। নাম যেমন চন্দ্র তেমনি চন্দ্রের মতোই তাঁর রূপ। যেন একটি চন্দ্রমলি­কা। এ বাড়ি ও বাড়ি টইটই করে বেড়ানো তাঁর স্বভাব। বাড়ির কাছেই মেজো বোনটির বিয়ে হয়। বোন জামাই আগে থেকেই আত্মীয়। বোন আর বোন জামাইয়ের সে ছিল নয়ণের মণি। খুব নান্দনিক মনের মেয়ে সে। তাঁর অনেক ভাগ্নেভাগ্নি। সবার প্রিয় মেজো খালাম্মা। খুব বেশি লেখাপড়া করেনি। স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠেই ধুমধামের সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে গেলো ঢাকা শহরে। একবুক স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলো। যে মেয়েটি লাউয়ের লতার মতো লকলকে, জলের মতো স্বচ্ছ, শিশুর মতো সরল আর পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল সে আজ ভিন্ন পরিবেশে এসে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো। এই প্রথম সে জানতে পারলো কোন কোন পুরুষ নাকি নারীর প্রতি আসক্ত থাকে না। তাদের রুচিবোধ ভিন্ন। হায় নিয়তি! জোড়াতালি দিয়ে আর কয়দিন অন্যের কাছ থেকে নিজের এই দ্বিখণ্ডিত সম্পর্কটাকে আড়াল করা যায়? শেষ পর্যন্ত কয়েক মাসের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে এলো। কিছুদিন বেশ চুপসে ছিল। পরবর্তীতে মা-বাবা আর ভাই-বোনের ভালোবাসায় সে এই ধাক্কাটা কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। চলছে জীবন আগের মতোই। পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো। বোনের বাড়ি গিয়ে আড্ডা দেয়া। ভাগ্নেভাগ্নি নিয়ে হৈচৈ করার মধ্যেই তাঁর সকল আনন্দ। এরই মধ্যে সে একটা চাকুরিও জোগাড় করে। খুব সাজুগুজু আর টিপটপ থাকাই বড় সখের কাজ। চন্দ্রের বড় ভাই তো অনেক আগেই চলে গেছেন। তাই তাঁর সকল আবদার বা বায়না মেজো বোনের জামাইয়ের কাছে। হঠাৎ এলো আর এক কালবৈশাখী। সেই বোন জামাইও হুট করে চলে গেলেন। আর একটা বড় ধরণের ধাক্কা চন্দ্রের গায়ে লাগলো। কোনরকম নিজেকে সামলিয়ে বোন আর তার সন্তানদের পরম মমতায় নিজের আঁচলতলে আগলে রাখলো। বোন বলতো এ যেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া সেই ভাই। কারণ সে বোন হয়েও ভাইয়ের মতো দায়িত্ব পালন করছে। এভাবে দিন, মাস, বছর যায়। মানসিকভাবে চন্দ্র বেশ সাহসী হতে লাগলো। এর মধ্যে সে বাবা মা সবাইকে হারায়। তার জীবনে কাছের সম্পর্কগুলো বিয়োগ হতে লাগলো। তবুও চন্দ্র ভেঙে পড়েনি আর। ভাই বোন আর ভাগ্নেভাগ্নি আঁকড়ে ধরেই তাঁর বেঁচে থাকা। আবার বিয়ের গুঞ্জন। একসময় তাঁর বিয়ে হয়ে গেলো মোটামুটি বেশ ধনী ছেলের সাথেই। বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। কাছাকাছিই তাঁর শ্বশুর বাড়ি। সবাই ভাবলো এবার বুঝি চন্দ্রের সুখের সীমা থাকবে না। কিছুদিন বেশ ভালোই কাটলো। স্বামীর এত টাকা পয়সা সে ভাই বোন ভাগ্নেভাগ্নিদের পেছনে দেদারসে খরচ করতো। চন্দ্রের সুখ দেখে কেউ কেউ হিংসে করতেও লাগলো। এবার নতুন সমস্যা। চন্দ্র যে মা হতে পারছে না। এত এত ভাগ্নেভাগ্নি তাকে মেজো খালাম্মা বলে জান দেয়, মায়ের মতো ভালোবাসে তবুও তাঁর নিজে মা হওয়া চাই। এ তো প্রতিটি নারী মনের তৃষ্ণা। ঠিক ওই সময়েই তাঁর প্রিয় এক ভাগ্নির বিয়ে হয়ে গেলো। এদিকে চন্দ্রের শ্বশুর বাড়ির প্রচুর চাপ। সে বড় বউ। বংশ রক্ষায় সন্তান উৎপাদন করতেই হবে। নিন্দুকেরা বলে বেড়াতো এ মেয়ে বাজা। তাইতো আগের সংসার টিকেনি। কেউ জানে না। চন্দ্র তাঁর স্বামীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো। পরীক্ষা করে ডাক্তার জানলো সমস্যা চন্দ্রের নয়, তাঁর স্বামীর। এবার আর চন্দ্র মানুষ রইলো না, কেবল মেয়ে মানুষ হয়ে গেলো। স্বামীর কড়া নির্দেশ এ কথা কাউকে বলা যাবে না। এমন কি বাপের বাড়িতেও না। সন্তান না হওয়ার অক্ষমতা স্ত্রী হিসেবে তাকেই বইতে হবে। স্বামীতো পুরুষ। পুরুষ কখনো অক্ষম হতে পারে না। চন্দ্র মেনে নিলো। সবাইকে জানিয়ে দিলো সে কোনদিন মা হতে পারবে না। যে বোনকে সে বন্ধুর মতো জানতো তাকেও বললো না। একাকী সব কষ্ট সইতে লাগলো। আসলে কষ্ট সহ্য করাই ছিল তাঁর নিয়তি। এদিকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন ছেলের জন্য নতুন বউ খুঁজতে লাগলো। চন্দ্র তাঁর বাবার বাড়ি, বোনের বাড়ি আসা কমিয়ে দিলো। কেউ ফোন করলে বলতো, শরীর ভালো না তাই বাড়ি থেকে বের হয়না। চন্দ্রের স্বামীর আর বেশিদূর গিয়ে বউ খুঁজতে হলো না। সে তো ঘরেই আছে। তাদের কাজের মেয়ে। তিন বাচ্চার মা। অল্প বয়সী বিধবা। কিন্তু শরীরে যৌবন যেন উপচে পড়ে। ওই লোভাতুর পুরুষটির চোখ পড়লো তার উপরেই। এ নিয়ে সংসারে অনেক ঝগড়া। চন্দ্রকে খুব মারধরও করলো। হায় ভালোবাসা! এই পুরুষটি কিন্তু পাগল হয়ে এলাকার গণ্যমান্য লোকজন ধরে চন্দ্রকে বিয়ে করেছিল। কারণ কেউ রাজি ছিল না এই বিয়েতে।
হঠাৎ চন্দ্রের সেই বিয়ে হয়ে যাওয়া ভাগ্নি বাবার বাড়ি গিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়েই নিজের স্বামীকে নিয়ে মেজো খালাম্মার বাড়িতে উপস্থিত। সেদিন চন্দ্র খুব অসুস্থ। শরীরে ভীষণ জ্বর। কপাল ফুলে ছিল। ভাগ্নি জিজ্ঞেস করাতে সে বললো, কল তলায় পড়ে গিয়ে কপাল ফুলে জ্বর এসেছে। বুঝার উপায় ছিলনা ওদের কোন সমস্যা চলছে।
একদিন চন্দ্র কিছু না জানিয়েই বোনের বাড়িতে এক কাপড়ে এসে উঠলো। কিছুই ছিল না তাঁর সাথে। এত এত শাড়ি, সোনার গয়না, এত টাকা-পয়সা সব রেখে একটা কালো রঙের তাঁতের শাড়ি পরেই চলে এলো। বলল, আজ থেকে সে এখানেই থাকবে। তখনো তাঁর মুখে হাসি লেগেছিল। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না, কাউকে কিছু বলছেও না। কিছুদিন পর খবর এলো চন্দ্রের স্বামী নাকি অনেক আগেই সেই কাজের মেয়েকে বিয়ে করেছে। একটা বড় টিনের ঘর, একটা পুকুর, তিন ছেলেমেয়ের জন্য তিন লাখ টাকা দিয়ে তারপর। বুঝা গেলো মাঝে মাঝে মূর্খ মেয়েরাও খুব বুদ্ধিমতী হয়। সেই প্রথম চন্দ্র বোনের গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো। তাঁর স্বামী ভয়ে কিছুদিন লুকিয়ে ছিল। কিন্তু চন্দ্র চায়নি স্বামীর বিচার হোক। একটাই চাওয়া ছিল, সে এসে ক্ষমা চেয়ে কাজের মেয়েকে ছেড়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সবসময় যে চাওয়ার সাথে পাওয়ার মিল হয়না তা বোকা চন্দ্র বুঝেনি। সে নাকি বাড়ির পাশে রেললাইনে মরতেও গিয়েছিল রাত তিনটায়। তাঁর দেবর তাঁকে উদ্ধার করে পরদিন বোনের বাড়ি পাঠায়। এমন কত ঘটনা চন্দ্র চেপে গেছে জানা যায়নি। সে কিন্তু মাটির ঘরে থাকতো। প্রথমদিকে স্বামী প্রবাসে থাকায় সে পার্শ্ববর্তী বাজারে নিজে পাঁচতলা বাড়ি বানায়। সে বাড়িতে আর চন্দ্রের উঠা হয়নি। ওখানে এখন তাঁর কাজের মেয়ে আর স্বামী নামক নরপশুটা থাকে। গল্পের এখানেই সমাপ্তি নয়। লোকটা তার পৌরুষ প্রমাণ করতে ওই কাজের মেয়েকে দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে টেস্টটিউব বেবি নেয়। দিন দিন সে চরম সাহসী হয়ে উঠে। এবার সে চন্দ্রকে ফিরিয়ে নিতে চায় তাদের বেবিকে দেখার জন্য। এ ছিল চরম অপমান যা চন্দ্র মেনে নিতে পারছিল না। ধীরে ধীরে মানসিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কিছুদিন তাঁর ভাই চিকিৎসা করালো। এবার সে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পেলো। প্রিয় বন্ধুর মতো বোনটিও হারিয়ে গেলো জীবন থেকে। আর কত সইবে সে? পাগলের মতো আচরণ করছিল। এখন তাঁর চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল। ভাইটি থেমে গেলো। অথচ চন্দ্রের বাবা তো কম রেখে যাননি। মুসলিম আইনে সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। এমন কি চন্দ্রের মায়ের রেখে যাওয়া বিরাট সম্পত্তির ছিটেফোঁটাও সে পায়নি। নুন্যতম মৌলিক অধিকারটুকুও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। সারাজীবন যে ভাই বোন ভাগ্নেভাগ্নিদের জন্য সে এত করলো তারা কেউ এখন ফিরে তাকায় না। তাঁর প্রতি যে অন্যায় হচ্ছে এর প্রতিবাদটুকুও কেউ করে না। চন্দ্র কিন্তু তালাকপ্রাপ্ত নয়। সেই কুলাঙ্গার তো আর খবরও নিলো না।
চন্দ্র এখনো বেঁচে আছে। তবে মানুষ হিসেবে নয়, একজন পাগল হিসেবে। সবাই অপেক্ষা করছে তাঁর মৃত্যুর…

(জীবন থেকে নেয়া।
আমার লেখা প্রথম ছোট গল্প। সম্পূর্ণ বাস্তব ঘটনা। বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেই আমি এটা লিখেছি। কেউ অসন্তুষ্ট হলে আমার কিছু করার নেই।)
লেখক: কবি ও আবৃত্তিশিল্পী, কুমিল­া, বাংলাদেশ।

আগামী যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বিজ্ঞপ্তি

মহান স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সাহিত্য সংগঠন বাংলাদেশ কবিতা সংসদ, প্রধান কার্যালয়, পাবনা থেকে সৃজনশীল সাহিত্য সাধনায় উদ্বুদ্ধ করতে আগামী অক্টোবর’ ২০২১ এ প্রকাশ হচ্ছে ‘নির্বাচিত বাংলা কবিতা সংকলন।’ বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি কবিগণ সমবায় ভিত্তিতে লেখা প্রকাশে আগ্রহী হলে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর’২১ এর মধ্যে ডাক/কুরিয়ার/ ইমেইলযোগে ৫/১০টি রুচিশীল কবিতা, ছবি জীবনীসহ প্রেরণ করুন। প্রকাশনা অন্তে সংশ্লিষ্ট কবিগণ ২/৫ কপি করে বই পাবেন, বিস্তারিত তথ্য জানতে কার্যালয়ে যোগাযোগ করুন। সভাপতি, বাংলাদেশ কবিতা সংসদ, প্রধান কার্যালয়, পাবনা।
মুঠোফোনঃ ০১৭১২-৫৮৩৩৭০ (সার্বক্ষণিক) টেলিফোনঃ ০৭৩১-৬৪৮৫০/
E-mail: bkspabna2014@gmail.com , , বিকাশ নং: ০১৭১২-৫৮৩৩৭০ / ০১৭৪২৪১৭৪৫০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *