• Thu. Nov 21st, 2024

নজরুল কাব্যে প্রলয় (মুকুল কেশরী)

নজরুলকে নিয়ে ভাবি। ভাবনাগুলো সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়না। নজরুল এতো ব্যাপক অবস্থানে রয়েছে যে, তাঁকে চিন্তায় বা ভাবনায় প্রতিফলন সহজে ঘটানো সম্ভব নয়। নজরুল একজন কবিই শুধু নন, জ্ঞানতাপসও বটে। তিনি এতো সুন্দর করে বাংলা ভাষার সাথে বিদেশী ভাষার মিলন সেতু তৈরী করেছেন বুঝায় যায় না ওটা বিদেশী ভাষা। বাংলা সাহিত্যে আভিধানিক শব্দগুলো পাঠকের জন্য এমন সুন্দর করে ব্যবহার করেছেন, মনেই হয়না বাংলা শব্দগুলো বাংলা অভিধানে অনন্তকাল ধরে আবদ্ধ ছিল। পাঠকরা শব্দের মানে না জানলেও মানেটা লেখার ক্ষেত্রের মাধ্যমে অনুভব করতে পারে বলেই ডিকশনারীতে অর্থ খোঁজার প্রয়োজন হয় না ! এ ধরণের একটি শব্দ ‘প্রলয়’। নজরুল সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত এই প্রলয় শব্দ। নানাভাবে এ শব্দটা নজরুল বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন।
প্রলয় বাংলা শব্দমালার একটি শব্দ ! আভিধানিক অর্থ সৃষ্টিনাশ, কেয়ামত। নজরুল তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার নামকরণ করেছেন ঐ শব্দ দিয়ে। তা হলো প্রলয়োল­াস’। প্রলয়ের সাথে নিখুঁতভাবে উল­াস শব্দটা যোগ করে প্রলয়োল­াস করেছেন। এ কবিতাটিতে প্রলয় শব্দটার ব্যবহার চমকপ্রদ বটে।

‘আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল
সিন্ধু পারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্গল আগল’।
আবার ‘বিশ্ব মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর পর
হাঁকে ঐ জয় প্রলঙ্কর’।
অথবা ‘মাভৈঃ মাভৈঃ জগত প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে
জরায় মরায় মুমুর্ষূদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে \
তারপর ‘ধ্বংস দেখে ভয় কিরে তোর ? প্রলয় নতুন সৃজন বেদন
আসলে নবীন জীবন হারা অসুন্দর করতে ছেদনঃ

প্রলয়োল­াস শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সৃষ্টিনাশের আনন্দ, কেয়ামত হওয়ার উল­াস ধ্বংস বা বিনাশের জয়ধ্বনি। আর প্রলয়োল­াস কবিতায় বিদেশী বেনিয়া শাসকগোষ্ঠিদের সিংহাসন প্রকাশিত করার জন্য কবি প্রলয় নেশায় নৃত্য করেছেন। আবার একই কবিতায় ঐ সিংহাসন থেকে শাসককে হাটিয়ে দেয়ায় জন্য জয় প্রলয়োঙ্কর বলে ধ্বনি দিয়েছেন। অত্র কবিতায় দেশীয় জরা, মরা, মুমুর্ষূদের চাঙ্গা করে তোলার প্রয়াস চালিয়েছেন। এ কবিতাকেই তিনি নবীনদের আগামীর আশীর্বাদ মনে করে ‘প্রলয়’ শব্দটাকে চিরঞ্জীব করে তুলেছেন।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ‘প্রলয়’ শব্দটি কবি দু’বার ব্যবহার করেছেন।
‘আমি চির দুর্দম, দুর্বিনীত নৃশংস
মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন আমি ধ্বংস।’
এ দু’টো লাইনে আমি কে অবিনয়ী, দমন করা কঠিন অত্যাচারী এবং মহা প্রলয়ের নটরাজ বানিয়েছেন। যার অর্থ দাঁড়ায় নটেশ্বর, নর্তক শ্রেষ্ঠ। আরও তল­াশী করলে এ চরণ দু’টির ব্যাপক অর্থ পাওয়া যাবে। হিন্দ দেবতা শিব, তাণ্ডব নৃত্য করেনÑ কাজেই বলা যেতে পারে নটরাজ সেই শিব দেবতার আশীর্বাদ কবি তাঁর কবিতায় অনুরণন করেছেন। সাইক্লোন হচ্ছে সমুদ্র ঝড় বা ঘূর্ণিঝড়। আর ধ্বংস হচ্ছে বিনাশ। কবি এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন সর্বকালের সব ধরণের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। মহা প্রলয়ের আগমনে অনিয়ম নিয়মে পরিণতি হোক, অন্যায় অত্যাচার থেকে মানুষ মুক্তি পাক, এই প্রত্যাশায় কবি প্রলয়কে ব্যবহার করেছেন। প্রলয় ধ্বংস হলেও এখানে অত্যাচার কারীদের শত্র“ আর নিপীড়িতদের বন্ধু।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার অন্য দু’টো লাইন
‘আমি প্রাণ খোলা হাসি উল­াস,
আমি সৃষ্টি বৈরী মহাত্রাস
আমি মহা প্রলয়ের … রবির রাহুগ্রাস।’
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ইসমাইল হোসেন সিরাজী সহ যে ক’জন সাহিত্য স্রষ্টা কলমকে অস্ত্র করে ইংরেজ তাড়ানোর জন্য বাংলা শব্দমালাকে বারুদ হিসেবে ব্যবহার করেছিল, নজরুল তাঁদের অন্যতম। মুক্ত মনে ভারতের স্বাধীনতা কামনা করে তিনি প্রলয়োঙ্কারী বাক্যবান ছুঁড়ে মেরেছেন বিশ্বের শক্তিধর শোষকগোষ্ঠীর হৃৎপিণ্ডের উপর। বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন রোষানল এবং কারা শাস্তি। ভারতের বুদ্ধিজীবির কিছু অংশ কবিকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা উপহার দিয়েছিলেন এবং কাদের ও ম্লেচ্ছ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন এবং কাফের ম্লেচ্ছ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এতে কবি অনুশোচিতও হননি আবার ব্যথা পেয়ে কাতর হননি। যার হৃদয়ে মনে অনুশোচনা কাতরতা নেই, কেবল তিনিই পারেন প্রলয়ের সারথী হয়ে প্রাণখোলা হাসি উল­াস করতে এবং তিনিই পারেন অকল্যাণ সৃষ্টি রোধ মহা ত্রাসরূপী শিব হতে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সদস্য বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
সম্পাদক, অক্ষর, রাজশাহী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *