জাতীয় পর্যায়ে গঠিত ‘হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক উদ্যোগ’ কোয়ালিশন এর আয়োজনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারে ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন’ সংস্কারের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তারা বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের উত্তরাধিকার আইন ১৯৩৭সালের হিন্দু আইন অনুযায়ী মেয়েরা কোন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়। তবে বিধবা হওয়ার পর সন্তান নাবালক থাকা অবস্থায় শুধু বসতি বাড়ির অধিকারী হয়। … বৈবাহিক সূত্রে স্বামীর বাড়িতেও স্থাবর-অস্থাবর কোন সম্পত্তির অধিকার নেই।’ ‘..হিন্দু নারীদের ঠিকানা নেই..’ ‘..নারীর উত্তরাধিকার শুধুই সম্পত্তির অধিকার বা অর্থনৈতিক অধিকার নয়। উত্তরাধিকার নারীর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় করে। এখানে সম্পত্তির পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে..’‘..পার্শ্ববর্তী হিন্দু দেশ ভারত এবং নেপাল দুই দেশেই তাদের নারী উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করেছেন। তাহলে বাংলাদেশের হিন্দু আইন এখনও কেন সনাতন প্রথা মেনে হচ্ছে? এ দেশের হিন্দু আইনে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন পাস হলেও তা সর্বত কার্যকর হচ্ছে না..’ ‘..সম্পত্তির অধিকার না থাকায় হিন্দু নারীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যের ওপর নির্ভর করে জীবন কাটাতে হয়। এ জন্য অনেক সময় মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়ে। তাই হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করা উচিত..’
আলোচনা সভায় প্রসঙ্গক্রমেই উঠে আসে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের কথা উল্লেখ না করে ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল আইন সহায়তা দিবসে উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন ও সংশোধন এর ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ২০১৮ সাল থেকেই হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে ‘হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক উদ্যোগ’কোয়ালিশন।
কোয়ালিশনের সদস্যবৃন্দ দীর্ঘ দুই বছর আলোচনার মাধ্যমে এই খসড়া আইনটি প্রণয়ন করেছে। দেশের ৭টি বিভাগে কর্মশালার মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের আইনজীবী, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, স্থানীয় পূজা উদ্যাপন পরিষদ,হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিন্দু নেতৃবৃন্দসহ সমাজের সকল শ্রেনী পেশার হিন্দু নারী-পুরুষ সবার মূল্যবান মতামত এর ভিত্তিতে এই খসড়া আইনটি পর্যালোচনা করে মতামত প্রদানের জন্য সম্মানিত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিনহাকে প্রদান করা হয় এবং তাদের মতামত খসড়া আইনটিতে যুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান-১৯৭২ এর ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯ এ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করেছে। যেখানে নারীর অধিকার ভোগ ও চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে।কিন্তু বর্তমান হিন্দু আইনে হিন্দু বিধবা নারীরা জীবনস্বত্বে যে সম্পত্তি পান, তা তিনি বিক্রি বা উইল করতে পারেননা। ভারত ১৯৫৬ সালে ”হিন্দু সাকসেশন এ্যাক্ট” পাশ করেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারী ও পুরুষের উক্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান অংশ নিশ্চিত করেছে। এবং পরবর্তীতে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে তারা আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে আরও যুগোপযোগী করেছে।
ওয়েবিনারে বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশ হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, সংসদ সদস্য আরোমা দত্ত, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খিস্টান মহিলা ঐক্য পরিষদের দিপালী চক্রবর্তী।
আলোচনা সভায় জানানো হয়, খসড়া হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি তৈরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন এই খসড়া আইনে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ ও হিজরা (তৃতীয় লিঙ্গ) ব্যক্তির সমান অধিকার এর কথা বলা হয়েছে।
‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন’ সংস্কারের খসড়া প্রস্তাবে আশা করা হয় যত শীঘ্র সম্ভব আইনটি বাস্তবে রুপ দিলে শুধু ধর্মের নাম দিয়ে হিন্দু নারীর অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাস্তা যেমন বন্ধ হবে তেমনি নারী সম্পত্তির সমঅধিকার পাবে, এটা হবে তার জন্য সবচেয়ে বড় অধিকার। সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই জায়গাগুলো অবশ্যই সমানে আনতে হবে।
“আলোচনার একটাই মূলকথা, সেটা হলো, হিন্দু আইন সংস্কার করে নারীদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে হবে”।