‘এটাই শেষ মহামারি নয়। ফিরে ফিরে আসে মহামারি”: ১৩বার ‘ইনফ্লয়েন্জা’ (খৃষ্টপূব্ ১১৯৪ সাল থেকে ১৯৬৮-৬৯ খৃষ্টাব্দ); ৫বার ‘প্লেগ’ (খৃষ্টপূবর্ ৪৩০ সাল থেকে ১৮৫৫-১৯৫০খৃষ্টাব্দ); ৬বার ‘ফ্লু’ (১৯১৮ -২০১০খৃষ্টাব্দ); ৭বার ‘কলেরা’ (১১৬৮ -১৯৬১খৃষ্টাব্দ তন্মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী সময় ১৮৮৯ -১৯২৩); ‘টাইপাস’(১৫০১ -১৫৮৭খৃষ্টাব্দ); মার্স (২০০২-২০০৩ খৃষ্টাব্দ); মার্স (২০১১-২০১২খৃষ্টাব্দ);১৯৮১ থেকে শুরু হওয়া ‘এইচ আইভি এইডস’ এবং ‘কোভিড-১৯’ মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটলো ২০২০ সালে। মহামারী যা এককালে ছিল এন্ডেমিক-এপিডেমিক, তাই সভ্যতার হাত ধরে প্যান্ডেমিক-এ পরিণত হয়েছে। কোন মহামারিই রাতারাতি শেষ হয়নি। দুই-তিন বছর, এমনকি একাধিকবার আঘাতসহ যুগ যুগ ধরে চলেছে এর প্রকোপ। তবে সব মহামারিই একদিন শেষ হয়েছে। কোভিড-১৯-ও একদিন শেষ হবে। অতীতের অন্য মহামারির চেয়ে কোভিড-১৯ এক দিক থেকে আলাদা। কেননা প্রযুক্তির বিকাশে শুরু থেকেই আমরা এই মহামারির ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। যা অতীতের মহামারির ক্ষেত্রে ছিল অজানা। তাই আধুনিক বিজ্ঞান ও মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে এ মহামারি আগের মহামারিগুলোর চেয়ে দ্রত থামানো যাবে এই আস্থা ও বিশ্বাস রাখাই যায়। তবে চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস এর কাছে নিপতিত আজকের মানব সভ্যতা। কারও কারও মতে, পাপাচারের পরিণতি স্থিরকারী স্রষ্টার অভিশাপ এমন সব মহামারি। কেউ বলছেন জলবায়ু বিপর্যয় আর পরিবেশ বিনষ্টের প্রতিক্রিয়া। কারও কারও ভাষ্য মতে, হাত ফসকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসা মানবসৃষ্ট কোনও জীবাণু অস্ত্রের রসদ এই ভাইরাস। আরব, ভারত এবং বাংলাসহ পৃথিবীর মহামারীর অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো। ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে সেসব ছবি যদি মনের ক্যানভাসে ভাসিয়ে রাখতে পারি, তবে অনেক পথনির্দেশনা পাওয়া সম্ভব; এ সংকটকালে যা আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে আসতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ সালে প্রাচীন এথেন্স শহরে সম্ভাব্য টাইফয়েড (সালমোনেলা টাইফি ব্যাক্টিরিয়া-ঘটিত) এবং/বা এবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ, ১৬৫-১৮০ খ্রিস্টাব্দে স্মলপক্সে কবলে পড়ে সমগ্র রোম সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন, ইয়ারশ্নিয়া পেস্টিস নামক ব্যাক্টিরিয়া সংক্রমিত বিউবনিক প্লেগের কারণে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে বিপর্যয় (৫৪১-৫৪২ খ্রিস্টাব্দ), এমনকি প্রায় ৮০০ বছর পরেও (১৩৪৬-১৩৫৩), ঐ প্লেগ সংক্রমণেই ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার জীবনাবসান, যা ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত। অনুমিত মধ্য বা পূর্ব এশিয়া থেকে সিল্ক পথ ধরে জাহাজে বসে ইঁদুরের গায়ে বেঁচেবর্তে থাকা জীবাণুবাহী মাছি পৌঁছে গিয়েছিলো সুদূর ইউরোপের এক বন্দরে। বাকিটা ইতিহাস। এইভাবে ষোড়শ শতকে (১৫১৯-১৫৩২) স্মলপক্স-এর প্রাদুর্ভাবে আমেরিকার অ্যাজটেক ও ইনকা সভ্যতা ধ্বংস, লন্ডন (১৬৬৫-১৬৬৬) ও ফরাসী বন্দর মারসে শহরের (১৭২০-১৭২৩) ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ, ফিলাডেলফিয়ায় (১৭৯৩) দাস ব্যবসার পথ ধরে আফ্রিকার মশাবাহিত ভাইরাস ঘটিত পীত জ্বর বা ইয়েলো ফিভার, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মারণ কামড়ে রাশিয়া, ইউরোপ সহ পৃথিবীর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু (১৮৮৯-৯০)। আমেরিকায় পোলিও (১৯১৬) এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন (১৯১৮-১৯২০) ইনফ্লুয়েঞ্জা জনিত স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত ৫০ কোটির ৫ কোটি বিশ্ববাসী মারা পড়েছিলেন। চীন থেকে উদ্ভূত এভিয়ান ফ্লু (১৯৫৭-৫৮), এবং ১৯৮১ থেকে আজ পর্যন্ত আফ্রিকার শিম্পাঞ্জী থেকে মানুষে সংক্রমিত ভাইরাস ঘটিত এইডস মহামারীতে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের প্রাণ গেছে। ২০০২ সালে সার্স, ২০০৯ সালে মেক্সিকো থেকে উদ্ভুত শুয়োর বাহিত সোয়াইন ফ্লু (প্রতিষেধক আবিষ্কৃত), পীত জ্বর (২০১৩), ২০১৪-২০১৬ সালে বাদুড়-বাহিত ইবোলা ভাইরাস এবং ২০১৫ থেকে বর্তমান সময় আক্রান্ত মশাবাহিত (এডিস) মারন ভাইরাস জিকার প্রাদুর্ভাবে আমরা স্তম্ভিত। ভারত বর্ষে মূলত দুটি প্যান্ডেমিক মহামারী উল্লেখযোগ্য। এক-কলেরা ও দুই-ইনফ্লুয়েঞ্জা। কলেরা মহামারী তিন শতক ধরে আটবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে, এবং অদ্যাবধি কাটেনি তার প্রকোপ। ভারতে ৫ কোটির বেশী প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কলেরা। ১৯ শতকের কলেরা ছাড়াও, বম্বের প্লেগ (১৮৯৬), ২০ শতকের ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যান্ডেমিক (১৯১৮) সহ পোলিও (১৯৭০-১৯৯০), বসন্ত (১৯৭৪), সুরাতের প্লেগ (১৯৯৪) এবং ২১ শতকে ঘটে যাওয়া উত্তর ভারতের প্লেগ(২০০২), ডেঙ্গু (২০০৩), সার্স (২০০৩), মেনিঞ্জাইটিস (২০০৫-২০০৬), চিকুনগুনিয়া (২০০৬), ডেঙ্গু (২০০৬), গুজরাটে জন্ডিস (২০০৭-২০১০), এইচ১এন১ জ্বর (২০০৯), ওড়িশায় জন্ডিস (২০১৪), সোয়াইন ফ্লু (২০১৫), নিপা ফ্লু (২০১৮) এবং কোভিড-১৯ (২০১৯-২০) সংক্রমণে মৃত্যুর আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ গেছে লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার। হজ্জ্ব মুসলমানদের অবশ্যপালনীয় ইবাদত। মহামারির কারণে যে কয়বার হজ্জ্ব বন্ধ ছিল তার মাঝে রয়েছে ১৮৩১ সালের প্লেগ। এই প্লেগের উৎসভূমি ভারত। সেখান থেকে সংক্রমিত হয়ে আসে মক্কায়। প্লেগে তিন-চতুর্থাংশ হজ্জ্বযাত্রীর মৃত্যু হলে সেবার হজ্জ্ব বাতিল করতে হয়। ১৮৩১ সালের পর ১৮৩৭ সালে আবার মহামারি দেখা দেয়। এ প্লেগের আঘাতে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত লাগাতার হজ্জ্ব বন্ধ থাকে। তার পাঁচ বছর পর ১৮৪৬ সালে কলেরা মহামারি শুরু হয়। তাতে পনের হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এ মহামারি ১৮৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১৮৫৮ সালে আরেকটি বৈশ্বিক কলেরা মহামারি মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে। মিশরীয় হজ্জ্বযাত্রীরা এতে লোহিত সাগরে পালিয়ে যায়। সেখানেই তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তারপর বিরতি দিয়ে আবারো ১৮৬৫ ও ১৮৮৩ সালে ফিরে আসে কলেরা। এ জন্য বারবার হজ্জ্ব স্থগিত রাখতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে মহামারির কারণে মক্কার হজ্জ্ব প্রায় চল্লিশ বার বাতিল করতে হয়েছিল। অবশ্য প্রতিবারই মহামারির কারণে যে বাতিল হয়েছে তা নয়। রাজনৈতিক সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহের কারণেও বাতিল হয়েছিল।
আরব ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে আরবভূমির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মহামারির বিভৎসতার চিত্র পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর আগে দুনিয়া শাসনকরা ফারাওদের মমিতে পাওয়া গেছে গুটি বসন্তের দাগ। এ থেকে গবেষকরা মনে করেন, মিশরে ফারাওদের ধ্বংসের পেছনে রয়েছে গুটি বসন্তের মতো মহামারির প্রভাব। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর ও গ্রিসে ছড়িয়ে পড়ে এথেনিয়ান মহামারি। টাইফয়েড জ্বরের এই মহামারিতে ওই অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়।
তারপর কয়েক শতাব্দী পর, ১৬৫-১৮৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে পৃথিবীতে হানা দেয় এন্টোনাইন প্লেগ। এন্টোনাইন প্লেগ মানুষকে এতোটাই প্রভাবিত করেছিল যে তারা ধর্ম বা নিয়মনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সমাজে শ্রদ্ধাবোধের রীতি বিনষ্ট হয়েছিল। মানুষ মৃত্যুভয়ে ছিল আড়ষ্ট। চীনে উৎপত্তি হয়ে এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও মিশর, গ্রিস, ইতালিসহ সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যে সৈনিকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। ধারণা করা হয়, এ মহামারির কারণ ছিল গুটিবসন্তের জীবাণু।
সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই সংক্রমিত হয় এন্টোনাইন প্লেগে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে মানুষের অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয় তখন। যার ফলস্বরূপ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের গোড়াপত্তনও হয় তখন থেকেই। মহামারি পরবর্তী সময়ে খুব দ্রুত নতুন নতুন কুসংস্কার আর নতুন ধর্মের বিস্তার শুরু হয় সেসময়। ২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় তিন শ বছর উত্তর আফ্রিকা, রোম ও মিশরে গেঁড়ে বসেছিল সাইপ্রিয়ান প্লেগ।
বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী এ মহামারিটি রাজপরিবার ও রোমান সাম্রাজ্যকে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। এ মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন চার্চের একজন যাজক। তার নামানুসারেই প্লেগের নাম হয় সাইপ্রিয়ান প্লেগ। দ্রুত হাড়িয়ে পড়া এ মহামারিতে রোগের উপসর্গ ছিল কিছুটা ইবোলা ভাইরাসের লক্ষণের মতো তীব্র জ্বর ও রক্তবমিসহ অল্প কয়েকদিনের মধ্যে রোগীর মৃত্যু। ধারণা করা হয় গ্রিসের এক-তৃতীয়াংশ মানুষই এ মহামারির সময় সংক্রমিত হয়। বেশি সংক্রমিত হয় ডাক্তার ও রোগীর সেবা প্রদানকারীরা।
৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মিশর থেকেই প্রথম ছড়িয়ে পড়ে জাস্টিনিয়ান প্লেগ নামের মানব বিধ্বংসী একটি মহামারি। সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামানুসারে এ রোগের নাম হয় জাস্টিনিয়ান প্লেগ। মিশর থেকে ফিলিস্তিন, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এ মহামারি। কেড়ে নেয় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় ইঁদুরবাহী এ রোগ। ইতিহাস বলে রোমান ও বাইজেন্টাইনের মতো প্রবল শক্তিধর সাম্রাজ্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্লেগ নামের বিভৎস ও ভয়ঙ্কর এক অসুখ। এ মহামারির জীবাণু ছিল ণবৎংরহরধ চবংঃরং’ নামক ব্যাকটেরিয়া; যা ইঁদুর ও একধরণের মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপলে। খুব ক্ষিপ্রবেগে ছড়িয়ে পড়া এ রোগের উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া ও রক্তবমি। মৃতের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে লোকালয়ে মানুষকে কবর দেওয়ার মতো জায়গা ছিল না! বিশালাকার গর্ত করে ৭০ থেকে ৮০ হাজার লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল।শেষ পর্যন্ত গর্তও সংকুলান না হওয়ায় শহরগুলির চারপাশে ভাগাড়ের মতো লাশের স্তুুপ জমে ছিল। রাস্তাঘাট মরুভূমির মতো জনশূন্যে পরিণত হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভীষণ খাদ্য সংকটে না খেতে পেয়ে অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল। শুরুটা ৫৪১ সালে হলেও বছরান্তে চক্রাকারে এ মহামারি চলতে থাকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মোট আড়াই কোটির বেশি মানুষ মারা যায় এ মহামারিতে। ধারণা করা হয় ইউরোপের অর্ধেক মানুষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এ সময়।
৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ তাউন আমওয়াস
আরবি ‘তাউন’ অর্থ প্লেগ। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ জেরুসালেম বিজয়ের দ্বিতীয় বছরে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সতীর্থ খলিফা ওমর এর তার শাসনামলে শামের উদ্দেশে বের হয়ে খবর পান শামে মহামারি দেখা দিয়েছে। খলিফা নবির বাণী ‘মহামারি আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করবে না’ স্মরণ করে শামে না গিয়ে ফেরত আসেন এবং শামের সিরিয়ার গভর্নর আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহকেও মদিনায় আসার নির্দেশ দেন।আবু উবায়দা তার সেনাবাহিনী ও জনগণকে ছেড়ে মদিনায় যেতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত এ মহামারিতে শামের বিশ হাজার বাসিন্দার সঙ্গে তারও মৃত্যু হয়। আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ ছাড়াও এ মহামারিতেআরো কয়েকজন বিখ্যাত সাহাবি ইন্তেকাল করেন। মুয়াজ বিন জাবাল, ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান, হারিস বিন হিশাম, সুহাইল বিন আমর, উতবাহ বিন সুহাইল প্রমুখ সাহাবির মৃত্যুর কারণে এ মহামারিটি ইতিহাসে সাহাবি ঘাতক মহামারি হিসেবে পরিচিত। প্যালেস্টাইনের আল-কুদস ও রামাল্লার মধ্যবর্তী একটি জায়গা ‘আমওয়াস’ থেকেই এই মহামারিটির শামে (সিরিয়ায়) ছড়িয়ে পড়ায় এটিকে ‘তাউন আমওয়াস’ বলা হয়।
১৩০০খৃষ্টাব্দ : বিউবনিক প্লেগ’ বা ‘ব্ল্যাক ডেথ’
আবার, প্রায় ৬০০ বছর পর ১৩২০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্লেগের প্রভাবে ১৩৪৬-১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের (ইউরেশিয়া) ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। যা ইতিহাসে বিউবনিক প্লেগ’ ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবে পরিচিত। এ মহামারির জীবাণুও ছিল ণবৎংরহরধ চবংঃরং’ নামক ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুর ও একধরণের মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিল। উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া, রক্তবমি ও নিউমোনিয়া। সংক্রমিত মানুষের প্রায় ৫০ শতাংশই মারা গিয়েছিল। ১৩৪৩ সালের দিকে মূলত বণিকদের জাহাজে বসবাস করা কালো ইঁদুর ও ইঁদুর মাছি নামক দুটি প্রজাতির প্রাণির মাধ্যমে এটি ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। শুরুটা চীনে হলেও মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশ পাড়ি দিয়ে ১৩৪৭ সালে প্রথম ইতালির সিসিলি হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। সারা বিশ্বে পঞ্চাশ বছর ধরে এ মহামারির তান্ডব চলে এবং ১৫০ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবী থেকে মুছে যায়! এই মহামারির কবলে পড়ে ১৪০০ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে কমে ৩০০ মিলিয়নে নেমে আসে। মৃত্যুভয় ও আতঙ্কে মানুষ বিভিন্ন কুসংস্কার আর ধর্মীয় কোন্দলে জড়িয়ে পরে। শ্রমিক সংকটে পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় থেমে যায়। ফলে সমাজে ধনী-গরিবের শ্রেণিবিন্যাস বদলে যায়। অনেক ধনী মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যায়। আবার অনেক গরিব মানুষ ধনী হতে শুরু করে। এভাবে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয় এ মহামারি-পরবর্তী সময়ে।ব্ল্যাক ডেথ’র সময় থেকেই কোয়ারেন্টিন ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়। এখান থেকেই সংক্রামক রোগের মহামারি নিয়ন্ত্রণে কোয়ারেন্টিনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বিশ্বব্যাপী।