বাজারের বাইরে আবার আকাশটা মেঘলা হয়ে আসছে ক্রমশঃ। বাদলা বাতাস দিচ্ছিল। হয়তো আজ সারা দিনই এমনি খেপে খেপে বৃষ্টি হবে। চড়া রোদ্দুর ছিল একটু আগে, এখন তা ক্রমশঃ নিঃস্তেজ হয়ে আসছে। আকাশ জুড়ে একটা সাজ-সাজ রব যেন। একটানা ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হতে হতে যখন প্রাণটাই আই ঢাই করছে তখন কাল শেষ রাতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছিল। টানা এক ঘণ্টা অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেছে বাড়ির ছাদে, বাড়ির প্রাচীরের গায়ে এবং ফুল বাগানে। ঘুম ভেঙে দেখি, জানালার বাইরে আলোর ঝলকানি, পলকে-পলকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘ ডাকছে কড়কড় করে। জলের ঝাপটা ঘরের মধ্যে চলে আসছে সটান। আলো জ্বেলে নিয়ে জানলা বন্ধ করলাম। কেননা জলের ঝাপটার বিছানা বালিশ ভিজে যাবে। ঘরের মধ্যে জল ঢুকে পড়েছে একটু একটু করে। একেই বলে বোধহয় ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টি। পাগলা ঘোড়ার মতো যেন নেমে পড়েছে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। পাশের বাড়ির টিনের ছাউনিতে শব্দ করে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে। মেঘের ডাক মাঝে-মাঝে পিলে চমকিয়ে দিচ্ছে। ঘুম আসছিল না, থেকে থেকে হাই উঠছে। খানিক পরে বৃষ্টির দমকা খানিকটা কমে এলেও একেবারে থেমে যায়নি। কান পাতলে এখনো বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শোনা যায়। আজ সকালে অনেকদিন পর হঠাৎ কি মনে করে অনুপমা এসেছিল। কাব্য করে বলেছিলÑ দুরন্ত বিশ্রামে তরে
আমি আজ একাকী এসেছি তোমার ঘরে।
আজ তার চেহারা আগের মতো নয় তবে খুব একটা স্বাভাবিকও নয়। কবিতা আওড়ে লাজুক চোখ করে হাসল। হাসলে ওর চোখ থেকে সলজ্জ ভাবটা যেন গড়িয়ে ঠোঁট পর্যন্ত নেমে আসে। ধব-ধবে দাঁতেও হাসিটুকু কেমন লেগে আছে। ভারী চমৎকার লাগছিল তখন দেখতে। আমরা দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকালাম। যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাই সরাসরি অনুপমাকে বললামÑ ‘কি ব্যাপার বলতো অনুপমা, খোলসা করে বল। ‘মালুম হোতা ডালমে জরুর কুছ কালা হ্যায়।’ খোঁচাটা হজম করতে সে রাজি ছিলনা। তার ইচ্ছে করছিল রীতিমতো জবাব দেবার। কেননা খোঁচাটার মর্ম উপলব্ধি করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি তার। তাই খোঁচার পরিণামে জল যে অনেক দূর পর্যন্ত গড়াবে তা জানা কথা। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলছিল ওর। মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আমি এখন ইচ্ছে করলে জোর করে ওকে আমার ঘরে আটকে রাখতে পারি। কিন্তু তেমন মতিচ্ছন্ন যেন আমার না হয়। গলার স্বরের ওঠানামা শুনেই আমি অন্তত বলে দিতে পারি নাটক কত দূর এগোল। কিংবা নাটকের পরিণতি ট্রাজেডি হবে কিনা তাও আন্দাজ করে বলে দেবার মতো ক্ষমতা আমি রাখি। অনুপমাকে আজ বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। বুঝতেই পারছি তার সর্বাঙ্গে ঝড় বইছে। অনুপমা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে একবার তাকালো। রুমাল দিয়ে ঘাড় ও মুখের ঘাম মুছল বারকয়েক। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই অনুপমা লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলল খানিক। তারপর হাতের আঙ্গুল খানিকটা আলগা করল। অনেকদিন পরে আমাদের বাড়িতে এসে অনুপমার যে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল তা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। জীবনের দূরন্ত নদী সাঁতার কেটে পার হতে গিয়ে ভাসতে হবে আমাকে সারাজীবন আমি তা ভালো করেই জানি। বেশি দিন দূরে-দূরে থাকলে মানুষ কেমন সব ভুলে যায়। মানুষের স্মৃতি এত ফিকে কেন ? মনতো ঠুনকো জিনিস নয় যে যাকে তাকে যখন-তখন দেওয়া যায়। আমি যে আমার মন অনুপমার বক্ষের পিঞ্জরে বাঁধা রেখেছি সেটা তারও ইচ্ছে অনুযায়ী সম্ভব পর হয়েছে। তা না হলে কোন দুঃখে আমি ওকে আমার মনটা দিতে যাবো। কিন্তু তাহলে বুক ঠেলে এত কান্না আসছে কেন আমার ? বুকের ভেতর টনটনানি হচ্ছে কেন ? অনুপমাকে আগে এত সেকি, এত আকর্ষণীয় কখনও মনে হয়নি। আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। আমি মুগ্ধ চোখে অনুপমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তা দেখে অনুপমা আমার দিকে জিরাফের মতো চোখ তুলে বললেÑ কি দেখছো তুমি অমন করে ?
আমি বললামÑ আমি দেখছি তোমাকে।
- কেমন দেখাচ্ছে আমাকে ?
- ফাইন, চমৎকার। এত সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে যে আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
- তোষামোদ করো না। আমার ভালো লাগেনা। সত্য কথা বলো।
- শপথ করছি সত্যবই মিথ্যা বলিব নাÑ যাহা বলিব সত্য বলিব।
আমার গলার স্বর অনুপমার কানে সুধা বর্ষণ করলো কিনা জানিনা, তবে সে কিছুক্ষণ পাথরের মতো পড়ে রইল। তারপর ফিসফিস করে বললÑ চমৎকার। আমি দু’হাতে অবলীলায় অনুপমাকে টেনে নিয়ে এলাম বুকে। আর তখনই অনুরাধা সশব্দে কেঁদে উঠল। কান্নাটা যত বাড়ছে তত বিব্রত বোধ করছি আমি। আমি বলার চেষ্টা করলামÑ মিছিমিছি কেঁদোনা অনুরাধা। আমি তো রয়েছি তোমার পাশে। আর কখনো ভুল হবেনা আমাদের। মানুষ তো ঠকে শেখে। আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে। দীর্ঘকাল তোমার অদর্শনের বেদনায় এক প্রকার দিশেহারা হয়েছিলাম এতকাল। আর নয়। প্লীজ তুমি কেঁদোনা। আর কেঁদে কি লাভ বলো ? যা হবার তা হয়েছে। এর জন্য মিছিমিছি কেঁদে আর শরীর মন খারাপ করো না। অনুপমা যেন কিছুই শুনছিল না। আমার চওড়া বুকের দেওয়ালে সে অসহায় ভাবে মাথা রেখেছিল। তার ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকায় দাঁত চিকচিকিয়ে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে তালিয়ে তালিয়ে মাথা নামাল অনুপমা। আমি আড়চোখে ওর মুখ দেখি। আমার কেমন জানি একটা নেশার মতো লাগছে। ভাল করে ওর দিকে তখনও তাকাইনি। আমি মুখখানি তুলে ধরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ওর গালে একটা চুমু খেলাম। অনুপমা প্রত্যুত্তর দিতে কসুর করল না। কোনও মেয়ের গায়ের গন্ধ আমি বহুকাল পাইনি। ও লতার মত বেঁকে আমার বুকে। শরীরটা তেমন ভারী নয় বলে অনেকক্ষণ অনুরাধা আমার বুকের ওপর পড়ে থাকলেও আমার তেমন কষ্ট হয়নি। আমি আস্তে-আস্তে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। মাথা থেকে হাত নেমে এল ওর মুখে। অনুপমা যেন প্রতিবাদ করতে জানে না। অনুপমা কোন যাদুমন্ত্রে এখন বাধ্য শিশুর মতো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত বললামÑ আমি তো তোমাকে বলেছিলাম অনুপমা, আমি শুধু তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব আমার এই প্রিয় শহরে। এ শহর ছেড়ে আমি যাবোনা কোথাও। তোমার যেদিন খুশি তুমি এসো আমার বাড়িতে। তোমার জন্য আমার হৃদয়ের দরজা চিরদিন খোলা থাকবে। তবে আমার স্বভাব কেমন তা তুমি ভাল করেই জানোÑ আমি জোর করে কারো কিছু কেড়ে নেওয়ার তত্তে¡ বিশ্বাস করিনা। আর তা বিশ্বাস করিনা বলেই তুমি নিশ্চয় অতীতে দেখেছো আমার চরিত্রে কখনো সংযমের অভাব ঘটেনি। আমি টের পেলাম অনুপমা আমার বা হাত আঁকড়ে ধরেছে। গলা নামিয়ে অনুপমা বললÑ দুরন্তর থেকে দূরত্ব বজায় রেখো। না হলে পরে ঠকবে। ওর ছায়া মাড়িওনা। আমি কথা বাড়ালাম না। চুপ থাকলাম। তার লম্বা কালো চুলের গোছা কাঁধ টপকে আমার বুকে লুটিয়ে পড়েছে। কয়েক মিনিটের জন্য আমি যতটুকু দেখা যায় ভাল করে অনুপমাকে দেখার চেষ্টা করলাম। একটা কালো পাড়ের শাড়ি পরে এসেছিল ও। গোলাপী রঙের জমিন শাড়িটায়। ব্লাউজটা ব্রাউন কালারের। মুখের ইতস্তত পাউডারের ছাপ বলে দিচ্ছে অত্যন্ত দ্রুততায় প্রসাধন পর্ব সারতে গিয়ে এই কাণ্ডটা ঘটেছে। মাথায় একটা সাদা প্লাষ্টিকের আধখানা চাঁদ যেন ঠাঁই নিয়েছে দিব্যি। তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে একটি কালো জালের ভেতর শ্যাম্পু করা চুল আট সাট করে বাঁধা। ডান হাতে লাল ডায়ালের ঘড়ি। এখন আমার একটা কথাই বড় বেশি করে মনে হচ্ছে তা হল জীবনে ঠেকে শেখার চেয়ে বড় পাঠ আর কিছুই নেই। তাইতো বলছি অনুপমা অতীতকে ভুলে যাও। তুমি ভুল করেছো নাকি আমি ভুল করেছি সে কথাও ভুলে যাও আজ। তোমার আমার মিলনের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম এই আমি না তুমি সে কথাও ভুলে যাও। আমি দায়ী না তুমি দায়ী সে কথাও আজ অবান্তর। ভুল আমাদের দু’জনেরই। সুতরাং সে ভুলের প্রয়শ্চিত্ত করতে হবে আমাদের দু’জনকেই। ‘আচ্ছা তাই হবে’ বলে অনুপমা আমার বুকে মুখ লুকালো। নিজেকে এখন আর আমার অসহায়, দূর্বল, অক্ষম বলে মনে হচ্ছে না। বুঝতে পারছি অনুপমা এখন আমার হৃদয় মন্দিরে নিজেকে বন্দী করে ফেলেছে। আর পথ নেই। পাখি এবার আপন নীড়ে ফিরেছে, যাবেনা উড়ে আর কোথাও।
লেখক, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক।
গবেষক, সাবেক সভাপতি, নজরুল একাডেমি, ভারত।
মাসিক অনন্য কথা পড়–ন, স্বজন প্রিয়জনদের পড়তে উৎসাহিত করুন। আপনার সৃজনশীল লেখাটি পত্রিকা দপ্তরে ইমেইলে প্রেরণ করুন। আপনার মূল্যবান মতামত, সুস্থ সমালোচনা আমাদের পথ চলার প্রেরণা।
মাহফুজ আলী কাদেরী, সম্পাদক, মাসিক অনন্য কথা, আতাইকুলা রোড, শালগাড়িয়া, পাবনা।