বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলো সবই মানবাধিকার। এগুলোকে মৌলিক অধিকার বলা হয় এজন্য, যেহেতু সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ মৌলিক আইন এবং সংবিধানে সংযোজিত অধিকারগুলোও মৌলিক আইনের অংশ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সুরক্ষিত হয়েছে। কোনো অংশ পরিবর্তন করতে হলে সংবিধানকে সংশোধন করার দরকার হয়।
আমাদের সংবিধানে ১৮টি অধিকার অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৪ মোট ১৮টি অধিকার ভোগের বর্ণনা রয়েছে যা সিভিল এবং রাজনৈতিক অধিকারের। এগুলোর বৈশিষ্ঠ্য দুই প্রকারের।
ক. রাষ্ট্রীয় এবং বিদেশী নাগরিকদের অধিকারঃ এগুলো আবার ৬ বৈশিষ্ট্যের!
১. অনুচ্ছেদ ৩২ এ রয়েছে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা
২. অনুচ্ছেদ ৩৩ এ গ্রেপ্তার এবং আটক সম্পর্কে
৩. অনুচ্ছেদ ৩৪ এ জবরদস্তি করে শ্রম নিষিদ্ধের
৪. অনুচ্ছেদ ৩৫ এ বিচার এবং শাস্তি সম্পর্কিত
৫. অনুচ্ছেদ ৪১ এ ধর্মীয় স্বাধীনতা
৬. অনুচ্ছেদ ৪৪ এ নাগরিকের সাংবিধানিক প্রতিকার।
খ. সংবিধানে ১২টি মৌলিক অধিকারের দেশের নাগরিকদের জন্য অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪২, ৪৩ বর্ণিত।
১৮ টি মৌলিক অধিকারঃ
১. অনুচ্ছেদ ২৭ এ নাগরিক অধিকারের সাম্যতা
২. অনুচ্ছেদ ২৮ এ ধর্মীয় কারণে বৈষম্যের কথা।
৩. অনুচ্ছেদ ২৯ সরকারি নিয়োগে সাম্যনীতি
৪. অনু ৩০ এ বিদেশী খেতাব গ্রহণে নিষিদ্ধকরণের বিধি।
৫. অনুচ্ছেদ ৩১ এ নাগরিকদের আইনি আশ্রয়লাভের অধিকার
৬. অনুচ্ছেদ ৩২ এ ব্যক্তিজীবনের অধিকার
৭. অনুচ্ছেদ ৩৩ এ গ্রেফতার আটক সম্পর্কে
৮. অনুচ্ছেদ ৩৪ এ নাগরিকদের জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে।
৯. অনুচ্ছেদ ৩৫ এ বিচার এবং দন্ডবিধি
১০. অনুচ্ছেদ ৩৬ এ চলাফেরার স্বাধীনতা
১১. অনুচ্ছেদ ৩৭ এ সমাবেশের স্বাধীনতা
১২. অনুচ্ছেদ ৩৮ এ সংগঠন করার স্বাধীনতার
১৩. অনুচ্ছেদ ৩৯ এ চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতার বিধান,
১৪. অনুচ্ছেদ ৪০ এ পেশা এবং বৃত্তির স্বাধীনতা বর্ণিত হয়েছে।
১৫. অনুচ্ছেদ ৪১ এ ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে
১৬. অনুচ্ছেদ ৪২ এ সম্পত্তি ভোগের অধিকার
১৭.অনুচ্ছেদ ৪৩ এ গৃহ এবং যোগাযোগের সুরক্ষা
১৮. অনুচ্ছেদ ৪৪ এ মৌলিক অধিকার বলবৎ সংক্রান্ত!
২য় ভাগে রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনুমোদিত অধিকারগুলোর স্বীকৃতি। যেমনঃ
১. অনুচ্ছেদ ১১ এ মানবাধিকার,
২. অনুচ্ছেদ ১৪ এ কৃষক শ্রমিকদের মুক্তি
৩. অনুচ্ছেদ ১৫ এ মৌলিক প্রয়োজসমূহের ব্যবস্থা
৪. অনুচ্ছেদ ১৬ এ গ্রামীণ উন্নয়ন এব কৃষি
৫. অনুচ্ছেদ ১৭ এ অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা
৬. অনুচ্ছেদ ১৮ এ জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতা
৭. অনুচ্ছেদ ১৯ সমান সুযোগের নীতিমালা
৮. অনুচ্ছেদ ২০ এ কাজের অধিকার সংক্রান্ত
৯. অনুচ্ছেদ ২৩ এ সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকারগুলো মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে ঘোষিত না হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে নেয়া যা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। কারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সমুহের বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাষ্ট্রের সম্পদ ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায়। রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হলে অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করবে। যদি কোনো ব্যক্তির অন্ন-বস্ত্রের অভাব থাকে, বা শিক্ষার অধিকার ভোগ করতে না পারে কিংবা চিকিৎসার অধিকার না পায় সে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না এবং আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়।
এবার সংবিধানের আলোকে করোনাকালীন ঈদ
প্রসঙ্গে বলা যাকঃ
এ বছর ঈদের ঠিক আগে আগে আমাদের দেশ বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ইতিমধ্যেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ভয়াবহতার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে চলছে কঠোর লকডাউন। এমতাবস্থায় বড় ধরনের উৎসব, জনসমাগম, গণচলাচলের কারণে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। বিষয়টি স্মরণে রেখে আসছে ঈদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
ঈদে যে যেখানেই থাকুক পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা এদেশের পলিমাটির সন্তানদের কাছে অন্যরকম অনুভূতি। তারপরেও আমাদের মনে রাখতে হবে, চলমান বৈশ্বিক মহামারীর ভয়াবহতার কথা। আমরা আমাদের অবাধ্য অবেগের কারণে প্রিয় স্বজনদের যেনো ঝুঁকিতে ফেলে না দেই। বরং আমরা যে যেখানে আছি সেখানেই সীমিতভাবে ঈদ করাই হবে আজকের নাগরিক কর্তব্য।
এতদিন দেশের গ্রামাঞ্চল আক্রান্ত না হলেও বর্তমান চিত্র গ্রামের জন্য ভয়াবহতা রূপ নিচ্ছে। দেশের বাস্তবতায় আমাদের জাতীয় পর্যায়ে স্মরণযোগ্য উন্নয়ন হলেও চিকিৎসা সুযোগের এখনো সার্বজনীন প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়নি।
বয়স্ক, রোগবালাই আছে এমন যাঁরা তাঁরা বাড়িতেই নামাজ আদায় করতে পারেন। বাড়ির কাছে মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি মেনেও নামাজ আদায় করা যেতে পারে। ভিড় এড়িয়ে অজু করে, জায়নামাজ হাতে নিয়ে মাস্ক পরে যাওয়া উচিত হবে। হাতে হাত মেলানো বা কোলাকুলি করা থেকে বিরত থাকাটা সকলের নিরাপত্তার জন্যই ইতিবাচক।
জামাতের জায়গা জীবাণুমুক্ত করে, দূরত্ব বিবেচনায়রেখে সারিবদ্ধভাবে মসজিদে প্রবেশ এবং নামাজ সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ করার দিকে যতœবান হতে হবে।
আত্মীয়দের নিমন্ত্রন না করে পরস্পরের মধ্যে টেলিফোন ভিডিও কলে যোগাযোগের মাধ্যমে কুশল বিনিময় করাই হবে বুদ্ধিমানের পরিচয়।
উৎসব যেহেতু সীমিত পরিসরে পারিবারিক ভাবে করতে হচ্ছে তাহলে পোষাক ক্রয়ের জন্য শপিংমল বা দোকানপাটে না গিয়ে নিজেদের যে পোষাক আছে তাই নিয়ে খুশি থাকাটাই আজকের দেশপ্রেম। জনসমাগম মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। শুধু অত্যাবশকীয় জিনিস ছাড়া কোনো কিছু কেনাকাটা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
যেহেতু অনলাইন কেনাকাটায় ব্যপক প্রতারণা হচ্ছে। এদের সহযোগিতা নেয়ার পরিবেশ এখনো রাষ্ট্র দ্বারা সুরক্ষিত নয়।
আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি দূরত্ব বজায় রাখি তবে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, যদি সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আক্রমণ করে তা আরও মারাত্মক হতে পারে।
প্রাপ্তির সুযোগ থাকলে অবশ্যই টিকা নিতে হবে। যতদিন দেশের জনগণের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত না হয় ততদিন আমরা ঝুঁকিতে রয়েছি।
পরিশেষে বলবো, সংবিধান বা আইন মানুষের জন্য, মানুষ সংবিধান বা আইনের জন্য নয়।
আদিম সাম্যবাদী সমাজে আইন ছিলনা। কালের বিবর্তনে মানুষের প্রয়োজনে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছে এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে আইনের সৃষ্টি করেছে। জীবনসত্য যখন যেভাবে দাবি করে আইন এগিয়ে যায় সেই পথ ধরে। আইনের উৎস সাধারণ জ্ঞান। সুতরাং আজকের পৃথিবী যখন ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে, সেকারনে আজকের বাস্তবতায় যেটা প্রয়োজন সেটাকেই আইন বিবেচনা করতে হবে এবং বিবেকচালিত আইনের সুদক্ষ প্রয়োগই কেবল রক্ষা করতে পারে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। তৈরি করতে পারে এক শান্তিময় পৃথিবী শান্তিময় স্বদেশ।
পশ্চিমা বিশ্বের ভয়াবহতা মোকাবেলা করতে আনবিক শক্তধর দেশগুলিতে সুদীর্ঘ সময় মানুষকে ঘরবন্দি দেখেছি। নিথর রাত্রির মতো থমকে দাঁড?িয?ে ছিলো সভ্যতার লোকারণ্য। সেই মৃত্যুর ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে মোড়লবিশ্ব পথ চলে আজকে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে তারা। সুতরাং সেইসব শিক্ষাগুলো মাথায় রেখেই আসুন ঈদের উৎসবে সংযত হই। আমরা প্রমাণ করি প্রতিযোগিতার পৃথিবীর জন্য আমরা তৈরি হচ্ছি।
লেখক: রাজনীঅতিবীদ ও কলামিস্ট, সাবেক সংসদ সদস্য।