• Thu. Nov 21st, 2024

সুকান্তঃ বাংলা কবিতায় একটি নতুন আত্মপ্রত্যয় (মন্টু দাস)

একবিংশ শতকের বিশ্বসাহিত্যে বাংলা কবিতা বিশিষ্ট আসনে উপবিষ্ট। একদা পাল যুগে বাংলা কবিতার সারা ভারতে বিস্তার ঘটলেও কালের কঠিন পদপেষণে সেই স্বরূপ কোথাও অবশিষ্ট রইল না। যা কিছু রইল তা ঐ লোকশ্র“তিতে আর চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে। মন্থর গতিতে হলেও চর্যাপদের পর বিকশিত হলো মধ্যযুগের কাব্যধারা।
কয়েকশত বছরের ব্যবধানে ভারতচন্দ্রের বিদগ্ধ রচনা শৈলী বাংলা কাব্যে নতুন রূপ বৈচিত্র্যকে হাজির করল যাÑ ধীরে-ধীরে শতাব্দীর ব্যবধানে আধুনিকত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেল। আর আমরা এই ধারায় ঈশ্বর গুপ্তকে পেলাম। যার পূর্ণতা বিহারী-রঙ্গলালের হাত ধরে বিপ্লব সাধিত করল মধুসূদনের স্পর্শে।
রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব বাংলা কাব্য শুধু নয়, সামগ্রিক সাহিত্যকে মহীরূহে পরিণত করে, ফুলে ফলে সজ্জিত হয়ে দিগন্ত বিস্তারী রূপ নিল। ‘গীতাঞ্জলি’র নোবেল পুরস্কার বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠা এনে দিল। এরপর থেকে এই সময় পর্যন্ত আমরা রবীন্দ্র যুগ থেকে খুব একটা বেরিয়ে যেতে পারিনি। সাড়ম্বরে ‘কলে­াল গোষ্ঠী’ রবীন্দ্রগন্ডী অতিক্রম করার বিরামহীন চেষ্টা চালালেও ‘গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা’ সাঙ্গ হল। তথাপি রবীন্দোত্তরকালে জীবনানন্দ, অচিন্ত্য কুমার, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ভাস্বর। বাংলা কবিতার এই গতিধারায়, সমাজ বিকাশের পর্যায়ে সমাজ ও জীবন ভাবনার স্বতন্ত্র স্বরূপকে কাব্যরসে সিঞ্চিত করলেন কবি নজরুল উল্কার মত।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির শেষ পর্যায়ে যে বিশেষ পথ চলার ধারণা দিয়েছিলেন, নজরুলের গগন বিস্তারি চারণ কথকতায় যার সুপুষ্ট ব্যাপ্তি বিপুল সার্থকতায় প্রোজ্জ্বলÑ সেই ধারারই সার্থক প্রতিফলন আছে সুকান্তের সৃষ্টিতেÑ যা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্বরও নতুন প্রত্যয়ে বিভূষিত। এ বিষয়কে স্পষ্ট করে দেয়া যায় রবীন্দ্রনাথের আকুল আর্তিতে...

কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
প্রাক চলি­শের বাংলা কবিতার যুগ, সুপার স্ট্রাকচার ও ইলিউশানের নামে শিল্পগত উৎকর্ষতা বাড়াতে জীবন বিমুখ ভাবনার পুষ্টিসাধনে ব্যস্ত সৃষ্টির মাঝে। রোমান্টিক ভাবনার বিলাসিতায় রির্লিপ্ত অবয়বদানে যখন বাংলা কাব্য সংসার ব্যস্ত, তখন ‘গণ’ নামের একটা নতুন ভাবনাকে কাব্য সংসারে ঢুকিয়ে দেয়ার দুঃসাহসিকতায় বাংলা কবিতায় একটি নতুন ভাবনার জন্মদান করে যে কবিকুল স্বতন্ত্রতা নিয়ে ভাস্বর, সেই বিশেষ পথের সার্থক ও উজ্জ্বল জ্যোতিঙ্ক কবি সুকান্ত। যিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা, মহামারী, মড়ক, মন্বন্তরসহ মানুষের নিদারুণ জীবন যন্ত্রণাকে খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা মানুষের উপর সংগঠিত তীব্র অত্যাচারকে হৃদয়ে জারিত করে তার রচনায় প্রকাশ করেছেন। শত-সহস্র বছরের শোষণ-যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মানুষের যন্ত্রণাকে, তাদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদকে মর্ম স্পর্শী ও বলিষ্ঠ ভাষায় প্রকাশ করেছেন ‘বোধন’ কবিতায়Ñ
শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়Ñ
সুকঠিন-কঠোর আত্মপ্রত্যয়ে শুনিয়েছেন প্রতিজ্ঞতার বাণীÑ
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজন হারানোর শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।
আশি শতাংশের উপরে এদেশের মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে। কোটি-কোটি মানুষ দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। খোলা আকাশের নীচে বাস করে কোটি-কোটি নিরন্ন মানুষ। স্বাধীনতার ছাপ্পান্ন বছর পরও তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না। একদিকে আলোর রোশনাই আর অন্য দিকে মূর্তিমান অন্ধকারÑ দু’টোই পাশাপাশি। তাই কবি যথার্থই বলেছেনÑ
হে মহাজীবন আর এ কাব্য নয়
…………………………………
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
দ্বা›িদ্বক সমাজ কাঠামোর ভোগ সর্বস্বতা গোটা দুনিয়ার যৌবনকে বিধ্বস্ত করেছে। যৌবনের সুখ ঐশ্বর্য, মাদকময়তা অবহেলার নির্লিপ্ত-পথে এগিয়ে চলেছে। অসম বিকাশ নির্ভর দেশে যৌবনের শুকিয়ে যাওয়া আর্তিকে মর্মস্পর্শী ভাষায় বিবৃত করেছেন কবি,Ñ যেখানে ক্ষুধাই বড় বেশি প্রকট। কবির ভাষায়Ñ
‘আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়’। কত নির্মম উদঘাটিত এই ক’টি কথাতে।
‘লেনিন’, ‘বোধন,’ ‘রাণার,’ ‘১৯৪৬’-ইত্যাদি একেকটি মাইল স্টোন। সামন্ততান্ত্রিক শোষণ বঞ্চনার অত্যাচারিত, নিপীড়িত কৃষক শ্রেণীকে হতাশার প্রাচীরে মাথা না কুটে আশার আলোর বর্তিকা জ্বালাতে কবি বলেনÑ
অসি নাই থাক, হাতে তো আমার কাস্তে আছে
আবার কবির কিছু সৃষ্টিতে রোমান্টিকতা প্রশ্রয় পেলেও তা কখনো জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। ‘প্রিয়তমাসু’তে কি সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে বাস্তব উপলব্ধি। শ্রেণী চেতনায় সচেতন কবি তাঁর সৃষ্টির সর্বজনীনতায় শ্রেণী সীমানার বাইরেও অবলীলায় নিজের আসনকে স্থায়ী করতে পেরেছেন। এখানে বারবার মায়াকভস্কি কিংবা নাজিম হিকমতকে মনে পড়ে। আবেগমথিত ভাষায় নির্মম সত্যকে কবি তুলে ধরেছেনÑ
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি চরম দায়বদ্ধতাকে কবে এভাবে স্বীকার করে প্রত্যয় রেখেছেনÑ
চলে যাবÑ তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এভাবে গণচেতনা ও দায়বদ্ধতাকে বাংলা কাব্যধারায় এমন ভাবে নিয়ে এসেছেনÑ যা কাব্য মূল্য থেকে সামান্য বিচ্যুত না হয়ে সর্বজননীনতা পেয়ে এক নতুন মাত্র সংযোজিত হয়েছে। সুকান্তের সৃষ্টি বাংলা কবিতায় নতুন প্রত্যয়।
লেখক: কবি, গল্পকার প্রাবন্ধিক, ত্রিপুরা, ভারত।

প্রকাশনা জগতে পাবনায় অপ্রতিদ্বন্দি ও বিশ্বস্ত নাম
আপনার সাহিত্য সাধনার ফসল অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিটি সযতেœ আন্তরিকতার সাথে গ্রন্থাকারে প্রকাশের ও বৃহত্তর বাঙালি সাহিত্য পরিমন্ডলে পরিচিতির ব্যাপ্তি ঘটাতে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ২৯ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নির্ভরশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
যাবতীয় কম্পিউটার কম্পোজ, ম্যাগাজিন, ভিজিটিং কার্ড, পত্রিকা, শুভ্যেনির, গাইড প্রকাশ সহ ফটোকপি, কালার প্রিন্ট, লেমিনেশন করা হয়।
নবাব সিরাজউদৌলা রোড, বানী/ বীণা সিনেমার পাশে, পাবনা।
ফোনঃ ০১৭১২-৫৮৩৩৭০/০৭৩১-৬৪৮৫০।
E-mail: rupamprokasony@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *