• Thu. Nov 21st, 2024

অদম্য রণেশ মৈত্রের
রোমাঞ্চকর জীবনকথা
অজয় দাশগুপ্ত

বীর মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান সাংবাদিক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রিয় শিক্ষক, উদ্যমী সমাজসেবীÑ কতই না পরিচয় রণেশ মৈত্রের। এখন বয়স নব্বই বছর ছুঁতে চলেছে। ১৯৭১ সালে সাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু তিনি দেশের টানে, প্রিয় বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার সংকল্প থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সশস্ত্র সংগ্রামে। তরুণ বয়সেই ভাষা আন্দোলনে নিজেকে সপে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন। আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির হাল ধরেছেন। করোনাকালে একাত্তরের মতো ছোটাছুটির সুযোগ নেই। কিন্তু বয়স যাই হোক, অমিততেজী তো বটেই। মনের জোর রয়েছে সেই ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক থাকার সময়ের মতো। ভয়ঙ্কর ভাইরাস কভিড-১৯ কী করে থামাবে তাকে? করোনাকালে তিনি লিখে ফেললেন তিনশ’ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী।
এ গ্রন্থের ভূমিকায় খ্যাতিমান রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী, ছায়ানট সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুন লিখেছেন, ২০২০ সালের মার্চ মাসে সূচিত মহামারির বিভীষিকায় আমরা স্বাভাবিক জীবনাচারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেমন থমকে রয়েছি। চারদিকে কেমল মহামারির প্রেতনৃত্য চলছে যেন। এরই মধ্যে প্রবীণ এবং প্রাজ্ঞ দেশসেবক রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা) ব্যতিক্রমী আচরণ করে আমাদের শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের উদ্রেক করেছেন। চতুর্দিকের স্থবিরতাকে আগ্রহ্য করে এই সময়ে তিনি অনন্যমনে আত্মজীবনী রচনা করেছেন (যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ করেছে অনুপম প্রকাশনী)।’
এতে পঞ্চাশ দশকের রাজনীতি ও সংস্কৃতি, ১৯৫৪ মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার জীবন এবং পাকিস্তান সরকারের নিদের্শে তার আকস্মিক অবসান , সাংবাদিকতার বর্ণাঢ্য জীবন, আইন পেশা, বিদেশ ভ্রমণ, পারিবারিক জীবন, ষাটের দশকে পাবনায় ভুট্টা আন্দোলন, জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের দশকের ভূমিহীন কৃষক আন্দোলন এ সব রয়েছে গ্রন্থটিতে। চলার পথে যাদের সান্নিধ্যে এসেছেন তাদের কথাও বলেছেন বিভিন্ন স্থানে।
১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করা রণেশ মৈত্রের দেশসেবা শুরু হয়েছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। ১৯৫০-এ ‘শিখা সংঘ’ গঠন করে তাঁরা কাজে নেমেছিলেন। এই সংঘের প্রথম কাজই ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœ রাখা। তারপর থেকে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যে কোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে এগিয়ে গেছেন।
সন্জীদা খাতুন আশা প্রকাশ করেছেন, লেখকের আদ্যন্ত সংগ্রামী জীবনের এই ইতিবৃত্ত ভবিষ্যৎ স্বেচ্ছাসেবী সব দেশপ্রেমীকে পথচলার নির্দেশনা দেবে। নবপরিণীতা রূপসী বধূকে ঘরে রেখে আদর্শের টানে দেশের কাজে আত্মনিবেদন করার নির্দশনাও আমরা এই গ্রন্থ থেকে পাব। মূল্যবান অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ আত্মকথাটি ঘরে ঘরে পঠিত হলে তার প্রভাব দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
লেখক প্রত্যাশা করেছেন পাঠকতুষ্টি। আমার প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের কাছেÑ সুদীর্ঘ একটি সময়ের কথা জানার জন্য রনেশ মৈত্রের ‘আত্মজীবনী’ পাঠ করুন গভীর মনোযোগ সহকারে। তাকে তুষ্ট করার জন্য নয়, বরং নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্য। ২০২১ সালটি পালিত হচ্ছে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবর্ণ জয়ন্তী হিসেবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ১৯৬৬ সালের ১১ জুলাই লিখেছেন, ‘আজ পাবনার রনেশ মৈত্রের সাথে আমার হঠাৎ দেখা হলো। ল’ পরীক্ষা দিতে পাবনা থেকে আনা হয়েছিল। দুই একদিনের মধ্যে চলে যাবেন এখান থেকে। বললামÑ আপনার ছেলেমেয়ের কি খবর? বললেন, কি আর খবর, না খেয়েই বোধ হয় মারা যাবে। স্ত্রী ম্যট্রিক পাশ। কাজকর্ম কিছু একটা পেলে বাঁচতে পারতো। কিন্তু উপায় কি! একে তে হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, তারপর রাজবন্দি, কাজ কেউই দিবে না। একটা বাচ্চা আছে। বন্ধু-বান্ধব সাহায্য করে কিছু কিছু, তাতেই চালাইয়া নিতে হয়। গ্রামের বাড়িতে থাকার উপায় নাই। মৈত্র কথাগুলি হাসতে হাসতে বললেন। মনে হলো তাঁর মুখ দেখে এ হাসি বড় দুঃখের হাসি।’ [পৃষ্ঠা ১৫৭]
১৬১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘যদি পাবনা জেলে যান তবে বন্ধু মোশতাককে বলবেন, চিন্তা না করতে। আমাদের ত্যাগ বৃথা যাবে না।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের খুব কমই জীবনের কথা লিখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ব্যতিক্রম। যেমন তথ্যবহুল, তেমনি সব-শ্রেণি ও পেশার এবং সব বয়সের পাঠকের উপযোগী সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তা লেখা। যুগ যুগ ধরে তা আমাদের জানার বাইরে ছিল। একইভাবে হিমাগারে লুকিয়ে রাখা ছিল তাকে নিয়ে পাকিস্তানের দুই যুগের গোয়েন্দা প্রতিবেদন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এ সব গোয়েন্দা প্রতিবেদন এখন উন্মুক্ত। কী সাহসী ও ত্যাগের সংগ্রামে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, সে সব জানার সুযোগ হয়েছে আমাদের। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার বার বার ‘বন্ড’ দিয়ে মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অদম্য।রনেশ মৈত্রও অদম্য। পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের চাকরি গেছে পাকিস্তানের গণবিরোধী শাসকদের চাপে। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের চক্রান্তে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, তাকে গোটা পরিবার নিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে বলেছেন ‘জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার খবর পেয়ে পাবনার রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীÑ একযোগে অমিত বিক্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ের যুদ্ধে জয়ী হয়। এ সময়ে আরও অন্ত্র সংগ্রহের জন্য পাবনার সে সময়ের জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের ৩০ মার্চ শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন ও রনেশ মৈত্রকে পাঠান ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। যাওয়ার পথে মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। কিন্তু তিনি যে অদম্য! পাবনা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্ব পালনরত অবস্থাইে জানতে পারেন যে এলাকাটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন নতুন পর্যায়ের লড়াইÑ গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করা, তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশে পাঠানো। তিনি নবউদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্ত্রী পুরবী বসু ও সন্তানরা কোথায় জানেন না। দু’জনের দেখা জুলাই মাসের শেষ দিকে। চার মাস কেউ কারও খবর জানেন না। স্ত্রী বিয়ের আংটি পর্যন্ত জলের দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। চৌদ্দ দিন একটানা হেঁটেছেন একটি নিরাপদ স্থানে পৌঁছার জন্য। রণেশ মৈত্র লিখেছেন, ‘পূরবীর দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। … যে চেহারা দাঁড়িয়েছিল আজও ভাবতে শিউরে উঠি। শিশুরা শুকিয়ে হাড় জিরজিরে।… অনেক দিন এক কাপড়ে থাকায় সেগুলো পরিষ্কার হয়নি। তেলবিহীন চুলের দিকেও তাকানো যায় না, চোখগুলো কোঠরাগত। [পৃষ্ঠা ২৭৮-২৭৯]
শিক্ষকতার মতো বাংলাদেশে সাংবাদিকতা জীবনেও রণেশ মৈত্র সফল। অর্থের জন্য নয়, এ পেশাও নিয়েছিলেন সত্য খবর তুলে ধরার জন্য। তাঁর পাঠানো কিছু খবর ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হতো, যা সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখতে পেরেছে।
রণেশ মৈত্র আরও পাঁচটি বই লিখেছেন। সংবাদপত্রে লিখছেন নিয়মিত। করোনার মধ্যেও যোগাযোগ রাখেন বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে। তাঁর সুস্থ্য জীবন কামনা করি। এ ভয়ঙ্কর ব্যাধি এখনও বিদায় নেয়নি। কিন্তু তিনি আশাবাদীÑ করোনা বিদায় নিলে তিনি যাবেন প্রিয় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে। গল্প করবেন নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সাথে।
আমাদের আশা থাকবেÑ অনাকাক্সিক্ষত ও অভাবনীয় করোনা-সময় নিয়েও তিনি লিখবেন। সবার প্রতি অনুরোধÑ রণেশ মৈত্রের লেখা আত্মজীবনী গ্রন্থটি নিজে পড়–ন এবং অপরকে পড়তে উৎসাহিত করুন। যে পথ তিনি অতিক্রম করেছেন, তার পরতে পরতে এত চিত্তাকর্ষক ঘটনাÑ তা জানার পাশাপাশি নিজের পরিচিত অনেক মানুষ এবং অনেক এলাকার কথাও চোখের সামনে ভেসে উঠবে। গ্রন্থে যাদের কথা রয়েছে, তারা হয় আপনারই অতি আপনারজন কেউ, যাদের ত্যাগ-সংগ্রামে পেয়েছি প্রিয় বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *