• Thu. Nov 21st, 2024

স্বাধীনতার ৫০ বছর,প্রত্যাশা ও ইদানীং বাংলাদেশ
রণেশ মৈত্র

১৯৭১ থেকে ২০২১। একেবারে যেন কাঁটায় মাপা ৫০ বছর। আমি যখন ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত হই এবং পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার করিমপুরে রিক্রুটিং ক্যাম্প বা ইয়ুথ ক্যাম্প (যুব শিবির) স্থাপন করে পাবনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ন্যাপ, সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নের তরুণদেরকে রিক্রুট করার কাজে নিয়োজিত হই তখন আমার বয়স ছিলো মাত্র ৩৯ বছর। চাইলাম প্রশিক্ষণ নিতে, সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে কিন্তু পার্টি নেতৃত্ব তাতে বাদ সাধলেন। তাঁরা বললেন যুদ্ধে যাবার চাইতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য যুবকদের রিক্রুট করা, অনুপ্রাণিত করা, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণে পাঠানোর ব্যবস্থাদি করার দায়িত্ব নিতে হবে। তাঁরা আরও বললেন, এই দায়িত্ব অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধকালীন শৃংখলাবোধ থেকে নেতাদের উপদেশকে আদেশ হিসেবে শিরোধার্য্য বলে বিবেচনায় নিয়ে করিমপুরে ন্যাপ-সি.পি.বি- ছাত্র ইউনিয়নের ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানেই ক্যাম্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলাম ১৯৭১ এর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের দু’তিন সপ্তাহ পর্যšত । ২৫ ডিসেম্বর ক্যাম্প ভেঙ্গে চুরে যারা তখন পর্যন্ত সেখানে ছিলাম সবাই একটি ট্রাকে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে গান গাইতে গাইতে মহা আনন্দে দেশে ফিরলাম বিজয়ীর বেশে। ঢাকাতে পাক-বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আতœসমর্পণ করলেও আমরা তৎক্ষণাৎ দেশে ফিরতে পারি নি মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী পাবনার এম মনসুর আলীর পরামর্শে। তিনি বলেছিলেন, পাবনাতে তো শুধু পাক আর্মিই নয়- নকশালরাও ছিলো অবরুদ্ধ পাবনাবাসীর জন্য মারাতœক ভীতি। ওদের দমন করতে আরও ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যেতে পারে। হিসেব করে তাঁকে বললাম আমরা তবে ২৫ ডিসেম্বর ভোরে রওনা হবো।
নয় মাস ধরে ক্যাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সহযোগি হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন পাবনা জেলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রসাদ রায়কে। অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বি¯তার যা আজ স্বপ্নের মত মনে হয়। আমরা যা শেখাতাম তা গেরিলা যুদ্ধের নীতি-কৌশল সংক্রাšত একটি বই থেকে, বলতাম অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ঢুকে ধনীর বাড়ীতে নয় গরীবের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে হবে তাদের মত বিছানায় রাতে ঘুমাতে হবে- একসাথে বসে খাবার ভাগাভাগি করে খেতে হবে। শত্রুর সন্ধান নিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে হবে। বিজয়ে উল্লাসিত না হয়ে পরবর্তী বিজয় অর্জনে আতœনিয়োগ করতে হবে- সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে শত্রু বলে বিবেচনা করতে হবে। এতে হাজারো ঝুকি থাকলেও এই পথই অবলম্বন করতে হবে যাতে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর দেশের ধনিকদের হাতে নয় গরীবদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা যায়- আমরা যাতে ক্রমান্বয়ে একটি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে পারি। আওয়ামীলীগ সম্পর্কে আমরা বলেছি তারা আমাদের মিত্র দল যদিও তাদের মধ্যে নানা রকমের শক্তির সংমিশ্রণ ঘটেছে। তবুও তারাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম দল-জনগণের আস্থাভাজন মধ্যবিত্ত প্রভাবিত একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী দল। তাই সর্বত্র তাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে-ক্ষেত্র বিশেষে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামও করতে হবে-তবে সতর্কতার সাথে অবশ্যই। দু:খজনক হলেও সত্য সেই চরিত্র আওয়ামীলীগ অনেক আগেই হারিয়েছে।
ক্যাম্পে বসে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণই নয়, নিজেদের রান্না নিজেদেরই করতে হতো, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়– দেওয়া, বিছানা পাতা প্রভৃতি সব কিছু। কাঁচা মেঝেতে শোওয়া, বালিশ নেই তাই ইট মাথায় দিয়ে ঘুমানো কতই না কষ্ট করতে হয়েছে সকলকে। কিন্তু আজ কি আমরা ঐ কথাগুলি ভাবতে পারি- সেদিন তরুণেরা মূলত: ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে কতই না হাসিমুখে কাজগুলি করেছে সকল ঝুকি সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্বেও। তাদের চোখে মুখে স্বপ্ন দেখেছি সুখী সুন্দর, সমৃদ্ধ, শোষণহীন ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তোলার। আজ তাদের বয়স কত ? নিশ্চয়ই কমপক্ষে ৬০ এবং উপরে ৭৫। তাদের অনেকেই আজ পরপারে বিগত এই পঞ্চাশটি বছরে কি স্বপ্ন দেখেছিলাম কিই বা ছিল দেশটাকে ঘিরে আমাদের কামনা ? পাকিস্তানী আমলের তাবৎ বিভেদ বৈষম্যমূলক ভাবনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক,, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিমুখী, আধুনিক-বিজ্ঞান সম্মত চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ, অর্থনৈতিক রাজনৈতিকভাবে বিদেশী আধিপত্যমুক্ত আয়-উপার্জনে বিরাজমান পর্বত-প্রমাণ বৈষম্য কমিয়ে এনে সেক্ষেত্রে একটি সামঞ্জস্য বিধান, দলীয়করণমুক্ত এবং মেধার স্বীকৃতি সম্পন্ন প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, ত্যাগী ও সংগ্রামী রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীত্বের পদ নিশ্চিত করা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশ গঠণ?এমন একটি দেশ বাস্তবে গড়ে তোলার জন্যে সে কী উম্মাদনা ! আপন স্বার্থকে গৌণ করে দেশ ও জাতির স্বার্থকে মুখ্য বিবেচনা করার যে প্রত্যয় সেদিন ঐ তরুণেরা দেখিয়েছিলো তার তুলনা মেলা ভার। বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ধ্বংশ প্রাপ্ত এই দেশে আমাকে তিন বছর সময় দিতে হবে। তিন বছরের মধ্যে কিছু দিতে পারবো না। কিন্তু শত্রুরা এই তিন বছর চুপ করে বসে থাকে নি। তারা মসজিদে মসজিদে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অজ¯্র মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণকে বিভ্রাšত করার চেষ্টা করেছে- ধীরে ধীরে তারা সাম্প্রদায়িক একটা আবহ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে এটাকে প্রকার স্তরে হিন্দু রাষ্ট্র বলেও প্রচার প্রচারণা চালিয়ে মুসলিম জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে প্রয়াশী হয়েছে। তদুপরি বিধ্বস্ত দেশে আমদানী-রাপ্তানী ঠিকমত না হওয়া,ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, সকল দেশের স্বীকৃতি অর্জনে কিছুটা সময় লেগে যাওয়া ইত্যাদি কিছুটা সময় লেগে যাওয়া ইত্যাদি কারণে জনমনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ক্ষোভ জমে উঠেছিল। বাজারে বহু পণ্যের প্রচন্ড অভাব পরিলক্ষিত হ্িচ্ছল যার ফলে বিক্ষুব্ধ হচ্ছিলো মধ্যবিত্তসহ সকল স্তরের মানুষ। আমেরিকা এহেন পরিস্থিতে বাংলাদেশের আভ্যšতরীণ সংকট আরও ঘনীভূত করে তুলতে তৎপর হয়। কারণ তারা চেয়েছিলো বাংলাদেশের অভ্যুদয় না ঘটুক-পাকিস্তানের অখন্ডতা অটুট থাকুক।
এ সকল পরিস্থিতির সুযোগে দেশে বিদেশে নানাস্থানে নানা ষড়যন্ত্রের হোতা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভারই সিনিয়র একজন সদস্য খোন্দাকার মোশতাক আহমেদ ও তাঁর অনুশারীরা। এই সব ষড়যন্ত্রের পরিণতিতেই স্বয়ং মোশতাকের নির্দেশে ঘটে যায় ১৫ আগষ্টের ১৯৭৫ রাত গভীরে সপবিারের বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যালীলা। কিছুদিন পরেই ঘটানো হয়, একই নেতার নিদের্শে, ১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর মর্মাšিতক জেল হত্যা। সেখানে গভীর রাতে অস্ত্র হাতে কারাগারে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধের চার অধিনায়ক, যারা বঙ্গবন্ধুর পাকি¯তানী কারাগারে আটক থাকায় মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে নেতৃত্বদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে এই গুরু দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলন সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশকে করে ফেলা হয় নেতৃত্বহীন।
বস্তুত: আমাদের স্বাধীনতার শত্রুরা এ সকল কাজগুলি করেছিলো একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। তারা তো পাকি¯তানের মদদপুষ্ট ছিলো। গোপনে এই পরিকল্পনা রচনায় জামায়াতে ইসলামীরও বিস্তার অবদান ছিল। কিন্তু দু:খজনক ঘটনা হলো পরবর্তীতে কোন আওয়ামীলীগ নেতা এ জাতীয় হত্যালীলা এবং বাংলাদেশকে পাকি¯তানী ভাবধারায় রূপাšতরিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানালেন না নিজেরাও নিজেদের বিশাল সংগঠনকে সেই মুহুর্তের সেই অত্যšত গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করলেন না- সম্ভবত: অধিকতর মারাতœক বিপর্য্যয় ঘটে যেতে পারে এই আশংকায়। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি জানি পুলিশ বাহিনী অপেক্ষা করছিলো একটি নির্দেশের, যুব-ছাত্র সমাজও অপেক্ষা করছিলো অনুরুপ একটি ইংগিতের। পরপর দু’দিন অপেক্ষা করার পর তারা ধরেই নিলো হয়তো বা এটা তাদেরই সরকার খোন্দকার মোশতাক আওয়ামীলীগ নেতাই তো ক্ষমতা নিয়েছেন- আবার কেউ হলো না।
কেউ কেউ প্রকৃত তথ্য জানবার জন্য ঢাকায় নেতাদের খোঁজে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন। টেলিফোন যোগাযোগও সম্ভব হলো না।
এই সুযোগে ওরা সংহত হলো। কিন্তু ১৫ আগষ্টের হত্যালীলা সাধনের পর তারা গণপ্রতিরোধের ভয়ে আতংকিত ছিলো-অকষ্মাৎ তারা ঐ ক্ষমতা গণ প্রতিরোধের ফলে হারাতে বাধ্যও হতে পারে এমন আশংকাও করছিলো। তদুপরি সেনাবাহিনী ঐ হত্যালীলার ব্যাপারে নানামতে বিভক্ত ছিলো। কাজেই কোন মহল থেকে ইংগিত পেলেই ওদের গণেশ উল্টে দেওয়া যেতো কিন্তু নেতারা সে সাহস দেখাতে ব্যর্থ হলেন। আজও সে দিনের সেই ব্যর্থতার মাশুল দিয়ে যেতে হচ্ছে জাতিকে। ব্যাকওয়ার্ড মার্চের শুরু সেখান থেকেই।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অকাল মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে যে বাকশাল গঠন নামে একটি মাত্র দল গঠন করেছিলেন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মানসে সেই দলে তো আওয়ামীলীগের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ (কতিপয় ব্যক্তিমাত্র বাদে), গোটা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, (মোজাফ্ফর) ও গোটা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও হাজী দানেশ প্রমূখ কতিপয় বর্ষীয়ান মাওপন্থী কমিউনিস্ট নেতাও যোগ দিয়েছিলেন যদিও কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল গঠন না করা সঙ্গত বলে তাদের মতামত অফিসিয়ালি জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতগুলি দল মিলিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাকশালের নামেও তো প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা নিতে পারে নি।
পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ নেতারা গোপন বৈঠক করে ৬ নভেম্বর দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিলের সিদ্ধাšত নিয়ে আওয়ামীলীগের বিশ্বস্ত নেতাদের জানিয়ে দেন তাঁরা যেন সম্মত ও হন। তাই গোপনে হলেও ব্যাপক প্রস্তুতিই চলতে থাকে ৬ নভেম্বর প্রতিবাদ মিছিল সবদিক দিয়ে সফল, করে তোলার জন্য। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এতোমধ্যে এলো মারাতœক ধরণের দ্বিতীয় আঘাত। ৩ নভেম্বর ভোররাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট মোশতাকের নির্দেশে কতিপয় সশস্ত্র সেনা দস্য গিয়ে পূর্ব থেকে কারাগারে আটক তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অত্যšত গোপনে। কিন্তু পরদিন কারাকর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট পরিবার পরিজনের হাতে লাশ ফেরত দেওয়ার ঘটনা থেকেই খবরটি মুখে মুখে সারা দেশে প্রচার হয়ে যায়। কোন মিডিয়াতে এই মর্মাšিতক খবর প্রকাশ করতে দেয় নি তৎকালীন অবৈধ সামরিক সরকার।তবুও বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনে নির্ধাতির কর্মসূচী অক্ষুন্ন রাখা হয় এবং তা যথারীতি, ঢাকা, পাবনা, কিশোরগঞ্জসহ ব্যাপক সফলতার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। তবে এ সব প্রতিরোধ আন্দোলনের কোন ধারাবাহিকতা না থাকায় প্রথম দিকে ক্ষমতা দখলকারীরা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও পরে, প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পেরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং তাদের দিয়ে স্বকীয়তাহীন বহুদলীয় রাজনীতি পুনরায় চালু করলেন।তবে দল পুনরুজ্জীবনে বিধিনিষেধ আরোপ করায় এবং আবেদন জানিয়েও তাতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে বাকশাল নামে কোন দল পুনরুজ্জীবন করা আর গেল না।
বাধ্যতামূলক করা হলো ছাত্র, যুব প্রভৃতি অঙ্গসংগঠন থাকতে হবে। নিজেও প্রথমে জাগদল নামে পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে নতুন দল গঠন করলেন। ঘোষনা দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এই দলে প্রাধান্য দেওয়া হবে কিন্তু তাঁরা তেমন একটা সাড়া না দেওয়ায় নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিমলীগ, জামায়াত প্রভৃতি ইসলামপন্থী দলের কিছু নেতাকে পরে বিভিন্ন দলের বহু সুবিধাবাদী নেতাকে নিয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে দলে উচ্চ মর্য্যাদা দিয়ে তবে সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত রেখে খিচুড়িমার্কা একটি তথাকথিত জাতীয়তাবাদী দল গঠন করলেন যারা জাতীয়তাবাদ হবে ইসলাম ভিত্তিক। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে বিসমিল্লাহ ছিল না তা যোগ করলেন, জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ ছিল সেগুলিকে সামরিক আইনে সংবিধান সংশোধন করে বৈধতা দিলেন। পাকি¯তানীকরণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে বেশ জোরে সোরেই শুরু হলো। শুরু হলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগমনের পরিবর্তে পশ্চাদগমন তথা ব্যাকওয়ার্ড মার্চ।
১৯৭৮ সনে তিনি জাতীয় সংসদের এক নির্বাচন দেন। এই নির্বাচনে বিরোধীদল মাত্র ৪০টির কাছাকাছি আসন পান অথচ নবনির্বাচিত এবং জনগণের কাছে আদৌ পরিচিত না হওয়া সত্বেও তাঁর দল দুই তৃতীয়াশের বেশী আসনে সুষ্পষ্ট কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করে। বহু রাজাকারকে এই নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে আনা হয় এবং বিরোধীদলের কাদেরকে বিজয়ী করে আনা হবে সে তালিকাও আগেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হলেন। সংসদের আদৌ কোন সার্বভৌমত্ব ছিল না সংসদটি ছিল রাবারষ্ট্যাম্প সংসদ। বাংলাদেশের উভয় স্বেরাচারী সামরিক শাসকই জিয়াউর রহমান ও এরশাদ রবার ষ্ট্যাম্প সংসদই পরিচালনা করেছিলেন। তাঁদের ইচ্ছা বা নির্দেশই ছিল সার্বভৌম।মর্মাšিতকভাবে নিজ বাহিনীর একদল কর্মকর্তা দ্বারা ১৯৮১তে চট্রগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া নিহত হলেন- বিস্মকর হলেও সত্য-তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় দুই দশক ধরে বিচারপতি সাত্তার ও বেগম খালেদা জিয়া মিলে দেশ পরিচালনা করলেও জিয়া হত্যাকান্ডের কোন বিচার তাঁরা করলেন না- কোন মোকর্দমাও দায়ের করলেন না। জিয়া গ্রেফতার করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হাজারে হাজারে বিনাবিচারে। অল্প কিছু নেতাকে দূর্নীতির মোকর্দ্দমা দিয়েও। এ ব্যাপারে তিনি দিব্যি আইউবের পদাংক অনুসরণ করেন। বিনা বিচারে আমাকেও গ্রেফতার করে এক সপ্তাহ পরে অন্য বন্দী কয়েকজনের সাথে আমাকেও পাঠানো হয় রাজশহিী কেন্দ্রীয় কারাগারে।। জেলের গেট খুলে আমাদেরকে অফিস রুমের পাশে অপেক্ষা করতে বলে মূল ভেতরের ফটকটা খুলে দেওয়া হলো। অনেক বন্দী যাঁরা মুক্তি পেলেন তাঁদেরকে বের করা হলো। পরে ডেপুটি জেলারকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, “বুঝতে পারলেন না, আপনারা মুক্তিযোদ্ধারা এবার জেল খাটবেন- রাজাকাররা মুক্তি পেতে শুরু করেছে।” ছবিটা বেশ উপভোগ করছিলাম সবাই। দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তণের ধারা এতে দিব্যি পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। দেড় বছর পর হাইকোর্টে রিট করে তবে মুক্তি পেলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে। আর বিনা রীটেই জিয়ার নেতৃত্বাধীন নতুন সামরিক সরকার রাজাকার আলবদরদের দিব্যি মুক্তি দিয়ে দিলেন। অত:পর তিনি হাত দিলেন সংবিধানে। বাহাত্তরের মূল সংবিধান আমরা সবাই জানি ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। অপরদিকে ধর্মের নামে রাজনীতি করা বা রাজনৈতিক দল গঠন করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ঐ সংবিধানের মুখবন্ধেও “বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম” লেখা ছিল না। সামরিক আইনের শক্তি খাটিয়ে জনগণের কোন অংশই এগুলি দাবী না করা সত্ত্বেও সংবিধান সংশোধন করে “বিসমিল্লিাহ” সংযোজন করা হলো, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির উপর থেকে সংবিধান কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলো, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিমলীগ প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দল পাকিস্তান আমলের মত বৈধ দলে পরিণত হলো আর জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম যাকে জিয়া সরকার পাকি¯তানী নাগরিক হিসেবে পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন দিব্যি ঐ সরকার তাকে ভিসা দিয়ে ঢাকায় বসবাসের সুযোগ দিলেও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তাকে দিব্যি স্বাধীন এই দেশটিতে বাংলাদেশের নাগরিকের মতই থাকতে দেওয়া হলো।
এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে আলহাজ্ব মোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে জিয়ার সাংবিধানিক সংশোধনী প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করলেন বাংলাদেশের “রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম” এই কথা ক’টি একই ভাবে ঐ সংবিধানে সংযোজন করে।
এভাবে সংবিধানের পাকিস্তানী করণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের দল বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। বিগত আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে ১৯৭২ এর মূল সংবিধানে ফেরত যাওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে তার সপক্ষে বিপুলতম সংখ্যক ভোটারের রায় পেয়ে তিন চতুর্থাংশের অনেক বেশী আসন পেয়ে বিজয়ী হলেন। ব্যাপক আশাবাদের সৃষ্টি হলো এবার নতুন সংসদ ঐ পাকিস্তানি প্রবর্তনামূলক ধারাগুলি সংশোধন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফেরত যাবার ব্যবস্থা করবেন। হঠাৎ সুপ্রীম কোর্ট ও পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়ে এ কাজটি আরও সহজ করে দিলেন।

বিস্ময়ের ব্যাপার এতে সন্তুষ্ট না হয়ে ক্ষুব্ধ হলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি বললেন, বিসমিল্লাহ থাকবে, জামায়াত নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, বৈধ সংগঠন হিসেবে কাজ করবে এবং সকল ধর্মভিত্তিক দল ও রাজনীতি বৈধ থাকবে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও বহাল থাকবে। এই কাজটির দ্বারা আওয়ামীলীগ সংসদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ব্যাকওয়ার্ড মার্চ সক্ষম করলেন। রাজনীতিতে নীতিহীনতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক ধারা বর্জন এ সবই হয়েছে এই নতুন দেশে পঞ্চাশ বছর ধরে। তবে যে মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে সে মানুষ একদিন ফরোয়ার্ড মার্চ করবেই।

[রণেশ মৈএ ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর বৃহওর রাজশাহী জেলার নহাটায় জন্মগ্রহন করার মাস খানেক পর চলে আসেন পৈএিক বাসস্থান পাবনা জেলার সাথিয়া থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। রাজনীতি ও সাংবাদিকতা তার জীবনের ব্রত। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ বাংলাদেশ সরকার রণেশ মৈএকে ২০১৮ সালে একুশে পদকে ভ’ষিত করেন। ১৯৫৯ সালে নাটোরের মেয়ে পূরবী মৈএির সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারা দুই ছেলে, তিন মেয়ের জনক-জননী।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *