ঈদ আসছে ঘরে ঘরে আনন্দের বারতা নিয়ে। আর কোরবানি ঈদ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে ধর্মীয় শিক্ষা ও ত্যাগের মহিমা তাৎপর্যপূর্ণ হয় পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে। সেসাথে নিয়ম অনুযায়ী গোশত বন্টন করে আনন্দ ভাগাভাগি করা হয়। ঈদের একাল এবং সেকাল নিয়ে এখন বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে এখনকার ঈদে যেন এককেন্দ্রিকতা দেখা যায়। আজ থেকে পনেরো বছর আগেও ঈদ উদযাপন, ঈদ নিয়ে চিন্তাভাবনা বা আয়োজন ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তখন আয়োজন ছিল অনেকটাই সাদামাটা যা এখন বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পরিলক্ষিত হয়। শুধু শহরে নয় গ্রামেও এসেছে সেই রেশ। সাধারণত কোরবানি ঈদে গরু, ছাগল, ভেড়া বা উট কিংবা নির্ধারিত পশুকেই কোরবানি করা হোক না কেন সেটিই হলো মূল বিষয়।সেকালে শহর, নগর কিংবা গ্রামে ইন্টারনেটের আধিপত্য এখনকার মতো ব্যাপক আকারে বিস্তার হয়নি। মোবাইল ও ইন্টারনেটের চল সদ্য প্রবেশ করলেও কৌতুহলবশত নাড়াচাড়া হতো যা এ যুগের মানুষের কাছে রীতিমতো জনপ্রিয়। আর গ্রামে তখনও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। মূলত এই প্রযুক্তির কল্যাণে শহরকেন্দ্রিক মানুষের কাছে দুটো জিনিসঅধিকমাত্রায় দেখা যায়। তার একটি হলো অতিমাত্রায় ফ্যাশন সচেতনতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অকল্পনীয় হারে সামাজিক ব্যস্ততা।
তাই এখনকার ঈদ আসন্ন হলেই বেশ কিছুদিন পূর্বে থেকে বিপণনগুলোতে ভিড় জমে। লাল নীল আলো ঝলমলে করে সাজানো হয় ফ্যাশন হাউজকেন্দ্রিক শহুরে বিপণন কেন্দ্র বা শপিংমল। যেটি কেবল রোজার ঈদকে সামনে রেখেই নয় কোরবানি ঈদেও এখন আয়োজন থাকে। তাছাড়া বিক্রি বাণিজ্য আরো আকৃষ্ট হচ্ছে অনলাইন শপিং এর মাধ্যমেও।মজার বিষয় ভালো গরু কেনার উদ্দেশ্যে অনেকে অনলাইনে ছবি দেখেন ও অর্ডার করেন কিংবা গরু কিনতে যান।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টিগ্রাম ইত্যাদিতে মানুষ এত বেশী আসক্ত হয়ে পড়ছে যে, সরাসরি কারো বাসায় গিয়ে দেখা করা, দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো, সবার সাথে একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়ে সময় পার করা, কোলাকুলি করা কিংবা কুশল বিনিময় প্রভৃতি সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব, আন্তরিকতা আগের মতো নেই। বরং কৃত্রিমতার ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়। পূর্বে গ্রামাঞ্চলে ঈদ উপলক্ষে গুড়ের পায়েস রান্না করা হতো এখন কিন্তু তা কমে এসেছে। গ্রামের ঈদও শহরের মতো পালিত হচ্ছে।
ইন্টারনেট প্রযুক্তি সেবার কল্যাণেও মানুষের ভেতর এক ধরণের প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। ইউটিউব চ্যানেল দেখে কে কতটা রান্নায় পারদর্শী তা বিভিন্ন ধরণের রান্নাবান্নার ছবি, যেমন টেবিল ভরা সুস্বাদু খাবারের ছবি ইত্যাদি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে প্রচার করেও এ ধরনের প্রতিযোগিতা চোখে পড়ে। এতে কে কতটা লাইক পেল, প্রশংসা কুড়োলো সেটিই যেন ঈদ উপলক্ষে এক ধরণের চিন্তাভাবনা যা সেকালে একদমই ছিল না কিন্তু একালে তা অপসংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু কোরবানির আদর্শ এসব বিষয়ে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
ঈদ উপলক্ষে বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের হোটেল, রেস্টুরেন্ট অথবা বিনোদন পার্কে গিয়ে প্রচুর সময় এবং অর্থ খরচ হচ্ছে যেটি পূর্বে কারো বাসায় যাওয়া বা আতিথিয়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলশ্র“তিতে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুসুলভ ভাবের আদান প্রদান যেমন একসাথে টিভি দেখতে বসা, গল্প করা ইত্যাদি উদযাপন গুলো সেকালের ঈদের মতো না হয়ে শহরের ঈদে অনেকটা যান্ত্রিকতা পরিলক্ষিত হয়। তবে শহর থেকে গ্রামে গিয়ে ঈদ করলে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন সবার সাথে আত্মিক সম্পর্কও আবারও জোরালো হয়, সেক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
তাই ঈদ সেকালের হোক কিংবা একালের পুরো ঈদটা ভার্চুয়াল জগতের মতো রঙিন ও আকর্ষক করে সবার কাছে উপস্থাপন হওয়াটা জরুরী নয়। তাতে তো কোরবানির যে আদর্শ, ত্যাগের মহিমা সেটা একেবারেই থাকবে না।
কাজেই আকাশ সংস্কৃতি কিংবা ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে কম বেশী সবাইকে। প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে বুদ্ধিদীপ্ত বা আধুনিক করে তুললেও তা একদিকে বিরাট ক্ষতির কারণ। সারাক্ষণ মোবাইল বা ল্যাপটপে বসে কেউ কখন কি করছে, কি পড়ছে, কি রান্না করছে এসব বিষয়ে ডুবে না থেকে সত্যিকার অর্থে কাজগুলোতে সক্রিয় হতে হবে এবং ব্যবহারিক কাজে মনোনিবেশ করে অলসতা দূর করতে হবে।
ঠিক আগের মতোন ছেলেরা নামাজ পড়ে এসে পশু কোরবানি কাজে সক্রিয় হবেন, অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করবেন একইভাবে মেয়েরাও পরিবারে তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবেন। তবে তা যেন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে পোস্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে না হয়।
কে কত টাকা দামের পশু কিনলো, পশুটি অন্যজনের কেনা অপেক্ষা অধিক উত্তম কিনা এসব লোকদেখানো চিন্তাভাবনা বর্জন করা না হলে; মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে কোরবানি তার কোন মর্যাদা বা মাহাত্ম্যই থাকবে না। আর তা কখনোই মঙ্গলজনক হবেনা। কোরবানির হাটে পশুগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে বা কিনে এনে তার পাশে চটকদার সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেয়ার প্রবণতা একালের ঈদে যেন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরণের হাস্যকর মনোভাবঅবশ্যই পরিহার করতে হবে তা না হলে কোরবানির যে মূল শিক্ষা, নৈতিকতা তা কোরবানি বলে গণ্য হবে না।
পূর্বে যেমন কোরবানির জন্য উপযুক্ত উত্তম পশু নির্বাচনের উদ্দেশ্যে হাটে যাওয়া জরুরী ছিল তেমনি অনলাইনের ওপর নির্ভর না করে সশরীরে যাওয়াই শ্রেয়।
ঠিক তেমনি কোরবানির মাংস বন্টনসহ প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে হবে। গরীব দুঃখীদের মাঝে মাংস বিতরণ, আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি গিয়ে বিলোনো স¤প্রীতি ও সৌহার্দ্যকে আরো মজবুত করে। এছাড়া মাংস কর্তনে একে অপরকে সহায়তা করা সবাই মিলে শরিক হয়ে কোরবানির কাজে সক্রিয় হওয়ার মাঝেও নির্মল আনন্দ পাওয়া যায়।
ঈদ উপলক্ষে একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করে একসাথে খেতে বসা, আদর আপ্যায়ন করে খাওয়ানো, পরিবেশনে সহায়তা করাও নৈতিক শিক্ষা ও ইবাদত। তবে অসহায়, দরিদ্রদের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ এর সময় সাথে সাথে ছবি দিয়ে পোস্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
শেষতোক বলবো, যেকোনো আনন্দের মুহুর্ত ছবি তুলে তাকে সুখস্মৃতি হিসেবে ধারণ করা ঈদ উদযাপনের একটি অংশ কিন্তু উদ্দেশ্য কখনোই নয়। আর তাই কোরবানির পবিত্রতা যাতে বর্জিত না হয় এর মাহাত্ম্যগুলো স্মরণ করে যেভাবে কল্যাণকর হবে সেভাবেই ঈদ উদযাপন করা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য।
ঈদ উদযাপনকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অন্যসব কৃত্রিম বিনোদনে এত বেশী সময় ব্যয় না করে পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে সময় কাটানো হলে সুস্থ বিনোদন ও ঈদের মাহাত্ম্যতা বজায় থাকবে।
ঈদটা কেবল ধনী বা স্বচ্ছল পরিবারেই জাঁকজমক করে হলে হবে না। আশেপাশে, দূরে বা সন্নিকটে অভাবগ্রস্থ, গরীব অসচ্ছ¡ল পরিবারেরও হক আছে ঈদের আনন্দ লাভ করার। কাজেই পর্যাপ্তভাবে তাদের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করা, পাশের বাড়িতে কেউ অভূক্ত হলো কিনা সেসব বিষয়ও খেয়াল রাখা জরুরী।
ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ভাগাভাগি করে নেয়ার মাঝেই ঈদের পবিত্রতা ও মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে। আর এভাবেই একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাই বছর ঘুরে আসন্ন কোরবানি ঈদ সবার জীবনে কল্যাণময় ও সুখকর হয়ে উদযাপিত হোক, সে প্রত্যাশা।