ধোঁয়া বাড়ছে। আগুনের শিখাও লকলক করে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। পুরো রান্নাঘরটা পুড়ে গেলে পাশের শোবার ঘরও গ্রাস করবে। এই মাঘ মাসে অনেক কষ্ট করে ফুটো ঘরের চাল খড় দিয়ে ছেয়েছে ফাতেমা। সামনে বর্ষা। মাথা গোজার ঠাঁই থাকবে না। অসহায় পঙ্গু কাশেম শুয়ে ছিল মাটির ঘরের দাবাতে। কাসেম কাঠুরে। গাছ কিনে কাঠ কেটে চেরাই করে আড়তে বিক্রি করাই তার কাজ। কিন্তু গেল সনে গাছ থেকে পড়ে পা পঙ্গু হয়ে পড়ায় বউ ফাতেমাই লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়।
এখন ফাতেমা হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে পুকুরে চান করতে গ্যাছে। চৈতি হাওয়ায় উনুন থেকে আগুনের টুকরো কখন উড়ে গিয়ে রান্নাঘরের বেড়ায় লেগেছে। কাশেম বুঝতে পারে না কী করবে। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে তাদের বাড়ি। কেউ দেখতে পাবে না। ফতেমাও দূরের পুকুরে ডুব দিতে গ্যাছে।
কাশিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু সে মরিয়া। ঘরটাকে বাঁচাতে হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করল ফাতেমার নাম ধরে ডাকতে। কাশির দমকে গলা দিয়ে ঘড় ঘড় আওয়াজ ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে সে অশক্ত পা-দুটোতে বল আনার চেষ্টা করল। কিন্তু বৃথা। সারা শরীর শুধু যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। আর একবার চেষ্টা। আশ্চর্য ! এবার কাশেম দেখল তার পা নড়ছে। আলাহর নাম করে সে খুঁটি ধরে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু পরক্ষণেই পড়ে গেল। তবু সে দমল না। বুক ঘষতে ঘষতে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল। প্রথমে ফাতেমার পোষা ছাগল দুটোর দড়ি কেটে, মুরগি ঘরের আগল তুলে দিল। তারপর সামনে পড়ে থাকা একটা ভাঙা টিনের অংশ নিয়েসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আগুনের উপর। চলল অসম লড়াই। কাশেম পাগলের মত বার বার আঘাত করতে লাগল বেড়ার গায়ের আগুনের উপর। তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ঢুকে এক টানে সে রান্নাঘরের ছাউনি টেনে নামিয়ে নিল। শোবার ঘরের দিকে এখন আগুন আর যেতে পারবে না। ততক্ষণে ফাতেমা দূর থেকে আগুনের শিখা দেখতে পেয়েছেছ। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ছুটে আসছে।
“কী সব্বোনাশ হল গো আমার! খোঁড়া মনিষ্যিটা যে শুয়ে আছে। কে আছো বাঁচাও!
ফাতেমা উঠোনে পা দিয়ে দেখল আগুন অনেকটা নিভে এসেছে। কিন্তু সেই নিভন্ত আগুনের মধ্যে পড়ে আছে পঙ্গু স্বামী কাশেম। সারা শরীর ঝলসে গ্যাছে। ফাতেমা ছুটে গিয়ে কাশেমকে পাঁজাকোলা করে দাবাতে এনে শোয়াল। তার চোখে বিস্ময়। “তুমি উখানে গেলে কী কইরে?”
কাশেম ফাতেমার হাতটা চেপে ধরে বলে, “তোর কষ্টে ছাওয়া ঘর আমি বেঁইচে দিছি। গলায় এট্টু জল দে।”
বদনা থেকে জল মুখে দিতেই ফাতেমার কোলে ঢলে পড়ল কাশেমের মাথা।