এক
দ্রুত এসে পড়ছে বসন্ত। শীত যাই যাই করছে। ভোরে আকাশ ছিল ধূসর। এখন ঝকঝকে। রুদ্র শাওন জানালার গ্রীলে গাল ঠেকিয়ে বসে আছে। প্রকৃতির এই রূপ বদল তাকে অভিভূত করে। শুধু তাকে কেন অনেককেই হয়তো করে। খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না।
রুদ্র শাওনের বয়স আটাশ। বিয়ে-থাওয়া করেনি। পঁচিশ বছর পর্যন্ত সে ছিল হাওয়ায় ওড়া পাখি। হৈ-হুলোড়, বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে মাতামাতি ছিল নেশার মতো। একদিন হঠাৎ কী হলো কেউ জানে না, সে চুপচাপ হয়ে গেল। অফিস আর বাসা, এই এখন তার গন্ডি। বিকেল হলে জানালায় বসে উদাস চেয়ে থাকা। এভাবেই দিন কাটে।
যাই যাই শীত বিকেলে শাওন জানালায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন রাস্তা ধরে কারা যাচ্ছে-আসছে সেটি দেখায় মগ্ন সে। আসলে তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপাশের শিমুল গাছটির দিকে। গাছ ভর্তি কলি। তার মানে বসন্ত এসে গেছে। কি শীত কি বসন্ত শাওনের খুব একটা কিছু যায় আসে না। তার কাছে সব ঋতুরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। স্বভাব শোভায় সব ঋতুই নিজস্ব মহিমায় উদ্ভাসিত। বসন্ত নিয়ে তাই খুব বেশি মাতামাতি নেই তার। তবে কোকিলের কুহু ডাক তাকে টানে।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। এই সময় কেন যেন এক ধরণের বিষাদ শাওনকে আচ্ছন্ন করে। অনেক হাতড়িয়েও উত্তর পায়নি সে। না, পায়নি বললে ভুল বলা হবে। অনেক খুঁজে উত্তর একটি পেয়েছে। সেই নিয়েই তলিয়ে আছে এই মুহূর্তে।
শাওনের দৃষ্টির মধ্যে ঈষৎ নড়াচড়া। সে গাঢ় করে তাকিয়ে দেখে একটি অল্পবয়সী মেয়ে। বয়স বড়জোর পনের কি ষোল হবে। ডুবতে থাকা সূর্যের আলো পড়েছে মেয়েটির গালে। অপূর্ব লাগছে তাকে। সে খুব ধীরে হাঁটছে। ঘাড় বাঁকিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বারবার পেছন ফিরে দেখছে। সে যে কাউকে খুঁজছে কিংবা কারও আসার অপেক্ষায় আছে, সেটি অনুমান করা যায়। শাওন লক্ষ্য করে, মেয়েটির বেশ পেছনে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে আসছেন। ভদ্রলোক কাছে আসতেইমেয়েটির মুখ ঝলমল করে ওঠে।
দিন ও রাতের এই নিঝুম সন্ধিক্ষণে সম্ভবত মানুষের মাথা আচমকা ভারী হয়ে যায়। তারা বুঝতেও পারে না এই বিরতির ক্রিয়াকালে সবকিছু কেন শব্দহীন স্তব্ধ হয়ে যায় ! কেন মনে হয় হাওয়াও বইছে না আর ! এই সময়ে আলো-আঁধারের এক অপার্থিব রহস্যময়তা খেলা করে। আর নিয়ত বদলাতে থাকা ছায়া ছায়া আলো খেলা করে মানুষের মুখের ওপর। মুখের আদলও যেন কেমন বদলে যায়। শাওনের অবাক লাগে। ভদ্রলোককে খুব চেনা চেনা মনে হয়, মেয়েটিকেও। বোধকরি আলো-আঁধারের রহস্যময়তার ভেতর ঠিক মনে করতে পারে না।
ঝুপ করে আঁধার নেমে আসে। মফস্বল এলাকাগুলোতে আঁধারও বুঝি একটু দ্রুতই নামে। চেনা চেনা লোকটি আর তরুণী মেয়েটি যেন ভ্রাম্যমাণ অভিনেতাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া মঞ্চের নামানো কালো পর্দার ওপাশে হারিয়ে যায়। শাওনের মন হঠাৎ বিষণœ হয়ে যায়। কেন এই বিষণœতা সে ঠিক খুঁজে পায় না। তার মনে হয়, সে একটি লম্বা, নিঃসঙ্গ, বৃষ্টিধোয়া কালো রাস্তার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যপ্রান্ত দূরে সরে যেতে যেতে ক্রমশ সরু থেকে আরও সরু হয়ে দূরের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। নিজেকেও তার ওই নিঃসঙ্গ রাস্তার মতোই মনে হয়। যার একপ্রান্ত দেখা গেলেও অন্যপ্রান্ত কোথায় মেলে ঠিক বোঝা যায় না। এক বিরাট নিঃসীমতা ! এই যে এখন রুদ্র শাওন রাস্তার দিকের জানালায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এক বিপুল নীরবতার ভেতর… এই নিকষ অন্ধকার তাকে ক্রমাগত বিষণœতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আঁধারের প্রগাঢ় সামিয়ানায় ঢাকা ফাঁকা ফাঁকা বাড়িগুলো আর আকাশের তারা পর্যন্ত উঠে যাওয়া অন্ধকার যেন ক্রমাগত তাকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। রাস্তায় অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া পথচারীদের পায়ের শব্দ, বৃক্ষরাজির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ কিংবা কোনো এক ঘরের বন্ধ জানালায় গ্রামোফোনে বাজতে থাকা রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ… নীরবতাকে আরও বেশি প্রকট করে তুলছে। যেন এই বিষœতা, এই একাকীত্ব, আর এই নীরবতার আধিকারিক এরাই। আগের অনাদিকাল যেমন, ভবিষ্যতের অনন্ত সময়েও এরাই থাকবে।বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এই বিশাল বাড়িতে লোক বলতে শাওন নিজে আর নতু ভাই। নতু ভাইয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছি। তাঁর আসল নাম আব্দুল লতিফ। লতিফ অপভ্রংশ হয়ে “লতু”, সেখান থেকে “নতু”। তিনি কৈশোরে এ বাড়িতে আসেন। শাওনের দাদার আমলে। এ বাড়িতেই শাওনের দাদা ধুমধাম করে তাঁর বিয়ে দেন। তাঁর একটি কন্যা সন্তান হয়। সেই কন্যার বিয়েও এ বাড়ি থেকেই দেয়া হয়। তাঁর স্ত্রী এ বাড়িতেই মারা যান। তিনি স্ত্রীর শবদেহ নিজ কাঁধে বহন করে চৌধুরী পরিবারের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করেন। তাঁর মেয়েও ওই কবরস্থানেই শায়িত। তবে মেয়ে কেন আত্মহত্যা করেছিল, সেটি রহস্যই থেকে গেছে। শোনা যায়, স্বামীর অত্যাচার, চৌধুরী বাড়ি থেকে তার স্বামীর অনৈতিক অর্থ হাসিলের অভিলাষ, এইসব কারণে সে চৌধুরী বাড়িতে আসলে আর যেতে চাইত না। এও শোনা যায়, শাওনের বাবার সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা ছিল। দু’জন ছিলেন প্রায় সমবয়সী। কোনো এক গভীর রাতে সে আত্মহত্যা করে। নতু ভাই এভাবেই রক্ত সম্পর্কিত না হয়েও বংশ পরম্পরায় চৌধুরী বাড়ির পরম আত্মীয় হয়ে ওঠেন।
বিশাল চৌধুরী বাড়িতে প্রাণী বলতে দু’টি মানুষ। নতু ভাই আর রুদ্র শাওন। চৌধুরী পরিবারের একমাত্র জীবিত বংশধর, রুদ্র শাওন। আর নতু ভাই শাওনকে বুক পেতে আগলে রাখা পরম পরিজন। দু’জনই যার যার মতো একা। ‘নতু ভাই’ আব্দুল লতিফের কমন সম্বোধন। সবাই তাঁকে নতু ভাই বলেই ডাকে। শাওনও। শাওন তাঁকে নিজের দাদার মতোই ভালাবাসে এবং সম্মান করে। নতু ভাই শাওনকে ছোট সাহেব বলে ডাকেন। শত বারণ সত্তে¡ও তাঁকে নিবৃত করা সম্ভব হয়নি। তাঁর একটিই কথা, রুদ্র শাওন… চৌধুরী পরিবারের ইজ্জত। সে ইজ্জত রক্ষা করা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে যতদিন বেঁচে থাকবে, এ দায়িত্ব পালন করে যাবে।
আশ্চর্য এক মানুষ এই নতু ভাই। শাওন কখনো তাঁর কথা অমান্য করে না। তিনি এমন কথা বলেনও না যা অমান্য করা চলে। শাওনের বাবা-মা-আত্মীয়-পরিজন বলতে তিনিই। যক্ষের ধনের মতো শাওনকে পাহাড়া দেন এই মানুষটি। যেন সে তাঁর কাছে গচ্ছিত আমানত। লোকটির প্রতি শ্রদ্বায় ভালোবাসায় কখনো কখনো শাওনের চোখে জল আসে। তিনি না থাকলে সে ভেসে যেত। তিনি নেই, এ কথা ভাবতে গেলেও সে শিউরে ওঠে। একজন ভৃত্য ধরণের মানুষ এমন মহান শিক্ষা পেলেন কী করে এ কথা ভাবতে গেলেও মনে বিস্ময় জাগে ! তাঁর মধ্যে যেমানবিকতা, ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ… যে সততা, প্রজ্ঞা, উদারতা ও বিনয়… যে টান ও মমতা, তা আজ শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া দুরূহ। মূলত পাওয়াই যায় না। নতু ভাই প্রকৃত প্রস্তাবে মানবিক মানবকুলের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি নমস্য।
দুই
শাওন সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পায়। এই ভরসন্ধ্যায় কে এলো ? একলা এই দুই প্রাণীর খোঁজ তো সচরাচর কেউ নেয় না! আর রাতে তো নতু ভাই কাউকে অনুমতিই দেন না। তাঁর ধারণা, চৌধুরী বংশের একমাত্র পিদিম নেভানোর জন্য অনেকেই ওত পেতে থাকে। শাওনের হাসিও পায়, কষ্টও লাগে। টিমটিম করে জ্বলা বাতির আবার শত্র“ ! অথচ লোকটি যদি পারতেন তাঁর সমস্ত শরীর প্রসারিত করে শাওনের চারপাশে দেয়াল তৈরি করে রাখতেন। এমন মানুষ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। শাওনের মন খারাপ হয়ে যায়।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কে এলো ? নতু ভাই যেহেতু ঢুকতে দিয়েছেন, নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ। কিন্তু তিনকুলে শাওনের তেমন কেউ আছে বলেই তো মনে পড়ে না।
“ছোট সাহেব ? ছোট সাহেব ? দরজা খোলো, মেহমান এসেছে।” নতু ভাইয়ের কণ্ঠে এক ধরণের উত্তেজনা।
শাওন দরজা খুলে হকচকিয়ে যায়। এক ভদ্রলোক এবং একটি মেয়ে। ভদ্রলোককে খুব চেনা চেনা মনে হয়, কিন্তু স্মরণ করতে পারে না। মেয়েটি যথেষ্ট রূপবতী। বয়স বোঝা যাচ্ছে না। আঠার হতে পারে কিংবা বাইশ, আবার পঁচিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। মোটকথা এ মেয়ের বয়স ঠাওর করা মুশকিল। ঝলমলে গায়ের রং। এতক্ষণে বোঝা গেল নতু ভাই কেন উত্তেজিত। হয়তো তাঁর ধারণা, মেয়েটি শাওনের পরিচিত। এবার শিকে ছিঁড়বে।
নতু ভাই বছর তিনেক হলো শাওনের বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ডাক্তারি পাস করার পর থেকেই। শাওন যতক্ষণ বাড়ি থাকে, আঠার মতো লেগে থাকেন।—“ছোট সাহেব বিয়ে করো, বিয়ে করো। এতবড় বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে। বউ এলে ঝলমল করবে। এই উঠোন, ওই কলতলা, পুকুর ঘাট, বাগান বাড়ি সব আবার হাসবে। ছোট সাহেব বিয়ে করো। অন্তত দেখে যাই চৌধুরি বংশ রক্ষা হলো। শান্তি পাবো। এমন মরা মরা বাড়ি এখন আরআমার ভালো লাগে না। বিয়ে করো।”
শাওন নতু ভাইয়ের আবেগ বোঝে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর এই বাড়ির সঙ্গে তাঁর আত্মার যোগ। এ বাড়ি আলোয় ভরা থাকুক, তিনি তো চাইবেনই। কিন্তু শাওনের বিয়ে করতে মন টানে না। বছর তিনেক আগে যে শঙ্কা তার মনে গেঁথে গেছে, কিছুতেই সেটি তাড়াতে পারে না। সেখান থেকে বেরতেও পারে না। সে জানে, সব একরকম নয়। জীবনও এক নয়। তবু শঙ্কা তার পিছু ছাড়ে না।
তিন
ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে শাওনকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদেন। বিস্ময়ে বিহŸল শাওন হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। লোকটি কে, কেন এমন করছেন, বুঝে উঠতে পারে না। হ্যাঁ, লোকটিকে ভীষণ চেনা মনে হয়, কিন্তু ধরতে পারে না।
“ছোট সাহেব, আমি যাই মেহমানদের খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করি। বহুদূর থেকে এসেছেন। উনারা বলছিলেন, তোমার সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবেন। থাকার মতো আশপাশে কোনো আবাসিক হোটেল থাকলে সেখানে রাতটা কাটিয়ে ভোরের বাস ধরে চলে যাবেন। আমি মানা করেছি। যে বাড়িতে পাঁচ পাঁচটি রুম ফাঁকা পরে থাকে, লোকের অভাবে খা খা করে, সেই বাড়ির মেহমান থাকবে হোটেলে ! তুমিই বলো, তা কি মানা যায় ? আমি গেলাম ছোট সাহেব, অনেক কাজ।”
“না, তা মানা যায় না। ঠিক আছে তুমি যাও, উনাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করো।”
“আপনারা বসুন, দাঁড়িয়ে কেন ! বসুন বসুন।”
“ছোট সাহেব কি আমায় চিনতে পেরেছেন ? আমি শফিক সাদি। নামে চিনতে পারার কথা নয়। এ আমার মেয়ে অরণ্য। অরণ্য মৌবনি। ওর জন্যই আসা। তিন বছর ধরে আমার পেছনে লেগে আছে। আপনাকে দেখবে বলে বায়না। ওর বিশ্বাস, শুধু ওর কেন আমিও তাই মনে করি, আপনার কারণেই আমি বেঁচে আছি।” লোকটির চোখে অশ্র“ টলমল করে। আর অরণ্য রীতিমতো কাঁদছে।
শাওনের হঠাৎ সব মনে পড়ে যায়। সমস্ত দৃশ্য এখন চোখের সামনে ঝলমল করছে। কী করুণ সেই দৃশ্য! সম্ভবত জীবনের প্রথম সেদিন শাওনের চোখে জল এসেছিল। শফিক সাদি ফুটপাতে পড়ে আছেন। একটি তরুণী মেয়ে পাগলের মতো বিলাপ করছে আর আকুতি জানাচ্ছে… আমার বাবাকে বাঁচান ! আমার বাবা মরেযাচ্ছে। বাবা ছাড়া কেউ নেই আমার ! প্লিজ আপনারা কেউ আসুন। আমার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার বাবা মরে যাবে।
রাসেল স্কোয়ারের ফুটপাতে সেদিন শফিক সাদিকে ঘিরে মানুষের জটলা ছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। কী আশ্চর্য মানুষ সব ! কোনো অঘটনে মুহূর্তে উৎসুক জনতার ভিড় জমে ওঠে; উঁকিঝুঁকি লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু সাহায্যের হাত এগিয়ে আসে না। কী আজব একটি দেশ ! আরও আজব এদেশের মানুষ ! শাওন সেদিন স্বচক্ষে মানবতার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিল।
সে একা লোকটিকে বহন ক’রে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু শফিক সাদির অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। সেই সময় প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া সম্পূর্ণ চিকিৎসা নিশ্চিত করা ল্যাবএইডের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁকে বাঁচাতে হলে কোলকাতা নেয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। তরুণী মেয়েটির বিলাপ শাওনের কানে বাজতে থাকে। একটানা, অবিরত। সে সিদ্ধান্ত নেয়, শেষ পর্যন্ত লোকটির পাশে থাকবে।
শাওন মেয়েটিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সমস্ত বন্দোবস্ত করে শফিক সাহেবকে নিয়ে আকাশে উড়াল দেয়। ভর্তি করে কোলকাতার নারায়ণা কার্ডিয়াক হাসপাতাল এন্ড রিচার্স সেন্টারে। নিজে চিকিৎসক বলে শাওন সেই সময় সেখানকার চিকিৎসকদের যথেষ্ট সহযোগিতা পায়। শফিক সাহেবের তাৎক্ষণিক ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয় এবং ধীরে ধীরে তিনি সেরে ওঠেন। নারায়ণা হাসপাতালের কেবিনে শাওন মোট পনের দিন শফিক সাহেবের পাশে ছিল।
সেই সময়ে শফিক সাদি সম্পর্কে শাওনের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়। কেবিনের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভদ্রলোক শাওনকে নিজের জীবনের ইতিবৃত্ত খুলে বলেন। শাওন প্রশ্ন করে করে সব জেনে নেয়।
“শফিক সাহেব, আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানা হলো না। কে আপনি, কোথায় থাকেন, কী করেন কিছুই না। এতদিন ছিল যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। এখন তো ভালো। এ যাত্রা বিপদ কেটে গেছে। ও, আমি রুদ্র শাওন। আমিই আপনাকে ঢাকা থেকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনি ফুটপাতে পড়ে ছিলেন। আপনার সঙ্গে একটি কিশোরী মেয়ে ছিল। ঢাকায় আপনার চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। আমি নিজেও একজন সদ্য পাস করা ডাক্তার। এটি কোলকাতার একটি কার্ডিয়াক হাসপাতাল। আপনার নামটা ওই মেয়েটির কাছ থেকে জেনেছিলাম।” শফিক সাদি শাওনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে অশ্র“। দমকে দমকে উপচানো জল গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি অনেকক্ষণ কাঁদেন। শাওন চুপচাপ বসে লোকটির কষ্টের জল গড়াতে দেয়। আহা বেচারা, ধুয়ে যাক তাঁর সমস্ত বেদনা প্রবহমান চোখের জলে। তিনি নবীন জীবন নিয়ে বেঁচে উঠুন।
“আমার মেয়েটি ? ও ছাড়া কেউ নেই আমার !”
“সে ভালো আছে। আমি তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম।”
“এখনও কিছু ভালো মানুষ রয়েছে পৃথিবীতে। মানুষ সম্পর্কে একধরনের বিতৃষ্ণা জন্মেছিল। আপনার হাতটি দিন, একটু ধরে থাকি। আপনি আমার জীবনের ত্রাতারূপী ঈশ্বর। স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন।”
ভদ্রলোক অবিরত কাঁদছিলেন। তাঁর দু’চোখ ছিল বহমান জলের নদী। ঢাল বেয়ে একটানা গড়িয়ে পড়ছিল অশ্র“জল। মনে হচ্ছিল যেন প্রবহমান সেই নদীর জল ফুরবে না কখনই। বুকের ভেতর বেদনার যে পাথর জমে ছিল, সেই জমাট পাথর গলে গলে পড়ছিল অশ্র“ হয়ে। ক্রমাগত জলের পতন। সেই অধোগত জলের ধারায় ভিজছিল ভাটির মৃত্তিকা। আহা, অসহায় মানুষ !
“শাওন সাহেব, আমি নাটোরের মানুষ। বনলতা সেনের কাব্যময় জায়গা। ঢাকা কলেজের ইংরেজীর সহকারী অধ্যাপক। কলাবাগানে একটি ভাড়া বাসায় থাকি। আমার মেয়ে ও আমি মিলে আমাদের দু’জনার সংসার। সুখের বলবো না, তবে সংসার তো বটেই। বাবা-মা বেশ আগেই গত হয়েছেন। একমাত্র বোন তার জামাইয়ের সাথে ইউকে’তে থাকে। ব্যস, রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় বলতে এই-ই।”
“ভাবী ?”
“সে অনেক কথা। বলতে ভালো লাগে না। তবু আপনাকে বলব। —–আমি ভালোবেসে রূপাকে বিয়ে করেছিলাম। রূপা আমার স্ত্রীর নাম। সে ডাক্তার। গাইনোকলজিস্ট। অনেক অর্থ উপার্জনকারী মানুষ। আমরা ভালোই ছিলাম। ধীরে ধীরে তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে মধ্যরাতে। পরিবারের জন্য সময় বরাদ্দ কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আমি অনুরোধ করি, আমার জন্য না হোক মেয়েটির জন্য কিছু সময় দিয়ো। ও অবুঝ শিশু। মাকে পেতে চায়। নাহ, সে অর্থ রোজগারে এতই সম্পৃক্ত হয়ে যায় যে, পৃথিবীর আর সমস্ত বিষয় একেবারেই গৌণ হয়ে যায়। দুধের শিশুটির প্রতিও তার স্নেহানুরাগ বিরাট এক শূন্যতেপরিণত হয়। তার সঙ্গে বারবার কথা বলেছি, কাজ হয়নি।
মেয়েদের আত্মনির্ভরতার বিরোধী নই আমি। বরং স্বপক্ষে অবস্থান ছিল সবসময়। কিন্তু স্বাবলম্বীতা মানে কি সন্তান, পরিবার, সমাজ থেকে পূর্ণ বিচ্যুতি ? একেবারে বিচ্ছিন্নতা ? আমার মেয়েটি সারাক্ষণ কাঁদতো শাওন সাহেব! বুকের দুধ পেতো না তো ! আমি অস্থিরতা নিয়ে কলেজে যেতাম। ক্লাস শেষ করে ছুটতে ছুটতে বাসায় আসতাম। যতটা পারি মেয়েটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু মায়ের অভাব কি পূরণ করা সম্ভব বলুন ? মেয়ে বড় হতে লাগলো। রূপা বলতে গেলে পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অর্থ আর এক ছেলে বন্ধু ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান; তার চিন্তা ও অনুভূতির একমাত্র বিষয়। সে ফ্ল্যাট কিনে আলাদা হয়ে গেল। অতুল বৈভবের মালিক সে। তাতেও আমার দুঃখ নেই। কিন্তু মেয়েটিকে একেবারে পর করে দিল !
একদিন বুকে ব্যথা অনুভব করায় ডাক্তার দেখালাম। তাঁরা বললেন চারটি ব্লক। সবগুলোই আশি পারসেন্টের ওপরে। বাইপাস ছাড়া উপায় নেই। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। নিজের জন্য নয়, মেয়েটির জন্য। কে ওকে দেখবে ! কার কাছে রেখে যাব ওকে ! সারাক্ষণ পাগল পাগল লাগতো। বিষণœতায় ভুগতে ভুগতে জীবন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকলো। শুধু ভয় করতো। একা একা কোথাও যেতে পর্যন্ত পারতাম না।
আমি জানতাম বাইপাসের অনেক খরচ। ডাক্তার কোলকাতা যেতে বললেন। মেয়েটির জন্য খুব বাঁচতে ইচ্ছে করতো। সব অভিমান ঝেড়ে ফেলে একদিন রূপার সঙ্গে দেখা করে সবকিছু খুলে বললাম। শাওন সাহেব, সে আমায় ফিরিয়ে দিল। তার মুখে মুহূর্তের জন্যও সেদিন একটু মমতা কিংবা সহানুভূতির চিহ্ন দেখতে পাইনি।
শাওন সাহেব, আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ক’জন বন্ধুর সহযোগিতায় টাকার জোগাড় হলো। কিন্তু কার সঙ্গে যাব ? একা যেতে ভয় করে। আবার রূপার কাছে গিয়ে বললাম, টাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সে যদি একটু সঙ্গে যায়। একা যেতে সাহস হয় না। সে বললো, সময় নেই। এক শ্যালকের কাছে গেলাম, যে একসময় আমায় ছাড়া কিছু বুঝতো না। বললো, স¤প্রতি সিঙ্গাপুর গিয়েছিল, এখন আর ছুটি পাবে না। আমার এক ভাগ্নের কাছে গেলাম, বললো সামনে জুন ফাইনাল, কাজের ভীষণ চাপ।
শাওন সাহেব, সেই মুহূর্তে বারবার এটিই মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে কি আসলেই কেউ কারও জন্য ? ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে ক’জন পারে ? আদৌ কি কেউ পারে ? এই যে মমতা কিংবা ভালোবাসা, এর গহিনে কি স্বার্থ লুকনো নয় ? সেই সময়ে বারবার আমার মনে হচ্ছিল, নিঃস্বার্থ শব্দটি এক বিরাট ভুল।
সেদিন সকাল থেকেই বুকে ব্যথা হচ্ছিল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। যাতে মেয়ে না বুঝতে পারে। ও অস্থির হয়ে পড়বে। কিন্তু মেয়ে ঠিকই বোঝে এবং আমায় নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়। পথে রিক্সা থেকে পড়ে যাই। ওইটুকু মেয়ে কি আমায় সামলাতে পারে বলুন ?”
শফিক সাদি কথাগুলো বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। সেই সময় তাঁর জীবনের সঞ্চিত যত জল বিধাতা বুঝি তাঁর চোখে মেঘ করে দিয়েছিলেন। নইলে অমন জলের প্রপাত কোথা থেকে আসবে !
বছর তিনেক আগের কথা। ভদ্রলোক তখন রোগ-শোকে আর বিষণœতায় একেবারে কাহিল ছিলেন। মেয়েটিও ছিল অস্থির। কিন্তু এখন বেশ ঝলমলে। শাওন তাই চিনতে পারেনি।
“শফিক সাহেব, আসলেই প্রথমে আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু চেনা উচিত ছিল। অন্তত আপনাকে। খুবই দুঃখিত আমি।”
“না না, ঠিক আছে ছোট সাহেব। তখন খুবই দুর্বল ছিলাম, ক্ষীণ ছিলাম। এখন ভালো আছি। মামণি, এই হলো ছোট সাহেব। তোমার বাবার রক্ষাকারী। বিধাতা ইনাকে পাঠিয়েছিলেন।”
অরণ্য উঠে গিয়ে রুদ্র শাওনকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে উদ্যত হয়। কিন্তু শাওন বাধা দেয়।
“একি করছ ! এটি করতে হবে না। যাও বসো, গল্প করি। কোন ক্লাসে পড়ছ তুমি ?”
“আমি অনার্স থার্ড এয়ারে আছি। ইংরেজী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
“কী বললে ! অনার্স থার্ড এয়ার !! আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমায় দেখে তো নাইন-টেনের ছাত্রী বলে মনে হয়।”
“হা হা হা… শাওন সাহেব, আপনি যেদিন আমায় উদ্ধার করলেন, অরণ্য তখন ক্লাস টোয়েল্ভ এর ছাত্রী।”
শাওন এবার অরণ্যের দিকে গভীর করে তাকায়। না, চেহারায় পরিপক্বতা আছে। আর রূপসী যে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যরকম আভা আছে।শাশ্বত বাঙালি ঘরানার অবয়ব। কাছে টানে। মায়াবী চোখে জাদুকরী সম্মোহ আছে।
এ মেয়ে একেবারে আলাদা।
“এতবড় বাড়ি একদমই ফাঁকা। এবার বিয়ে-থাওয়া করেন নি শাওন।” শফিক সাহেব হাসতে হাসতে বলেন।
“আপনিও দেখি আমার একমাত্র সঙ্গী নতু ভাইয়ের দলে। শফিক সাহেব, আপনার জীবনের গল্প শোনার পর বিয়ের ইচ্ছেটি একেবারে শিকেয় তুলে রেখেছি। এক ধরণের শঙ্কা বলতে পারেন। শঙ্কা থেকে ইচ্ছে মরে গেছে।”
“না মি শাওন, সবাই এখনও রূপা হয়ে যায়নি। এখনও মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব, মানবতা, বোধি, মনন জাগ্রত রয়েছে। আপনিই তো তার জ্বাজল্যমান দৃষ্টান্ত। আমার জীবন গেছে বলে আপনারও যাবে, এটি ভাবা বোকামি।
ব্যাচেলর জীবন একসময় জীবনের বোঝা হয়ে ওঠে। ধরুন বৃদ্ধ বয়সে যখন কারও সঙ্গ পেতে মন চাইবে কিংবা কারও সান্নিধ্যে সন্ধ্যাটি কাটাতে ইচ্ছে করবে, তখন আত্মসম্মানের মাথা খুইয়ে কারও কাছে কৃপা চাইতে হবে এই বলে, আমায় একটু সঙ্গে নাও। আবার ধরুন, অসুস্থ হলে দিনের পর দিন শূন্য ঘরে একলা শুয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকতে হবে। সবসময় মানুষজনকে গুডবাই বলে যেতে হবে কোনমতে রাস্তার দিকের দরজায় দাঁড়িয়ে। রাতের খাবার বাইরে থেকে হাতে করে বয়ে আনতে হবে। অন্যকারও ফুটফুটে বাচ্চার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসবে। এটি কঠিন বাস্তবতা যে, এক সময় ব্যাচেলর মানুষটি একা দাঁড়িয়ে থাকবে একটি শরীর ও মাথা নিয়ে এবং তার একটি কপালও থাকবে নিজের বোকামির কারণে নিজ হাতে চাপড়ানোর জন্য। সুতরাং বিয়েটা জরুরি মি শাওন।”
“নতুন করে ভাবতে হবে আবার। তবে কথা দিতে পারছি না।”
“ভাবুন, ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক হলে খুশি হব।”
“ছোট সাহেব, উনাদের খাবার রেডি। থাকার রুমও প্রস্তুত।”—নতু ভাইয়ের মুখ চোখ উজ্জ্বল। একটা খুশি খুশি ভাব।
“ওকে মি শফিক, জার্নি করে এসেছেন, চলুনখেয়ে শুয়ে পড়বেন। অরণ্য চলো।”
চার
গভীর রাত কিংবা রাত হয়তো শেষের দিকে। কেন যেন শাওনের ঘুম আসছে না। এরকম সাধারণত হয় না। আজ কেন হচ্ছে ! একটি মুখ এলো-ভাবনায় বারবার উঁকি দিয়ে যায়। কার মুখ ? মুখটি অতি পরিচিত, কিন্তু ধরতে পারে না। মন অস্থির হয়ে আছে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই হয়তো রাত্রি পার করতে হবে।
দরজায় মৃদু টোকা। কিছুক্ষণ নীরব। আবার টোকা। শাওন দ্বিধা নিয়ে দরজা খোলে। অরণ্য দাঁড়িয়ে। সে অবাক হয় না। এটি যেন অনিবার্য ছিল। সে যেন জানতো, অরণ্য আসবে। সহসা তার মনে হয়, হ্যাঁ, উঁকি দিয়ে যাওয়া মুখটি অরণ্যর।
“আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল ছোট সাহেব। কথাগুলি আমার জন্য জরুরি। কথাগুলি বলার জন্য আমি তিন বছর অপেক্ষা করে আছি। সে কারণে লজ্জা ভয় ত্যাগ করে এত রাতে আপনার ঘরে এসেছি।”
“ভেতরে এসো। বসো। বলো কী বলবে।”
“আমি রূপা নই, আমি অরণ্য। আমি প্রমাণ করতে চাই, এ দেশ রূপাদের কাছে নিরুদ্ধ নয়। এখনও অরণ্যরাই এখানকার জনপদের মূল মাহাত্ম্য ধারণ করে।”
“কী করে?”
“আমি আপনার খুব কাছে থাকতে চাই। শেষ পর্যন্ত। যেদিন সূর্য ডুবে যাবে, আমাদের দুজনার সূর্য একসঙ্গে অস্তমিত হবে। সেদিন হতে এই প্রান্তরের সবুজ ঘাসে আরেক প্রণয়গাঁথা ডাহুকের কণ্ঠ থেকে ঝরে ঝরে পড়বে।”
“তুমি তো সাহিত্যের ছাত্রী। তুমি পারো। কিন্তু আমি তো অত বুঝি না। সহজ করে বলো।”
“যেদিন আপনি সহস্র উৎসুক লোকের ভিড় ঠেলে আমার মুমূর্ষু বাবাকে উদ্ধার করে পরম মমতায় প্রাণ করলেন, সেদিনই ভবিষ্যতের জন্য যতœ করে তুলে রাখা আমার মনে ও শরীরে প্রণয়ের অনিবার্য ঢেউ ধেয়ে এসে আছড়ে পড়ে। সে ঢেউ ওখানেই থেমে থাকেনি বরং আমায় সঙ্গে করে টেনে নিয়ে গেছে অনির্বেয় আলোকের দিকে। সেই ঢেউ আপনি। বিগত তিন বছর সেই ঢেউয়ের সঙ্গে বসবাস আমার। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমায় ফিরিয়ে দেবেন না।”
“অরণ্য, সজীব বৃক্ষছায়ায় কার না হারাতে মন চায়, জানালার ঝলমলে পর্দার অন্তঃপুরে কার না যেতে ইচ্ছে করে, রংবাহারি পাতার স্পর্শ কার না পেতে ইচ্ছে জাগে? এই মুহূর্তে আমি বর্ণালি কাঁচে ঘেরা অন্য এক ভুবনে ভেসে যাচ্ছি জলপ্রপাতের মতো।”
“ভেসে যাও তবে, উড়ে যাও; তোমার ডানাগুলি মেলে ধরো আমি দেখি, যা আমি আগে কখনো দেখিনি এবং তোমায় নিয়ে যাও অরণ্যর উপত্যকার ভূমিতে। তোমার মন যা চায় তাই করো। তবে ঢাল বেয়ে নদীর উৎসমুখে ঝাঁপ দেবার আগে চারণভূমির যতটুকু দেখার দেখে নিয়ো। যখন দুটি ভিন্ন রাস্তা থেকে এসে দুটি মানুষ একসঙ্গে মেলে, কেউ কাউকে পথ দেয় না, শুধু একটির ভেতর দিয়ে আরেকটি চলে যেতে যেতে অবরুদ্ধ হয়। তুমি কিন্তু মন ছুঁয়ে পথ করে নিয়ো। সেতু ধরে জলের ছড়াটি পার হয়ে গভীরে যেয়ো আর যুদ্ধজাহাজে আনন্দে জেগে উঠতে দিয়ো তোমার কালের সাথিকে।”
“নিশ্চয়ই তাই হবে আমার চিরকালের অমৃত মৌবনি, তাই হবে।”
পাঁচ
ভোর হয়ে গেল। পূবাকাশে আরক্ত আভা। এ আভা অন্যরকম। কোনকিছুর সঙ্গে এর কোনো তুলনা চলে না। কিছুক্ষণ বাদে সূর্যোদয় হবে। শাওন ও অরণ্যের জীবনে আজকের উদিত সূর্যের আলো এক অপরূপ ভিন্নতা নিয়ে আসবে। যা কাউকে বোঝানো যাবে না। জানবে শুধু ওরা দুজন।
লেখক: কবি ও কথাশিল্পী, ডেপুটি সিভিল সার্জন, পাবনা।
আলোকিত সমাজ গড়তে ও নিজেকে সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত সাহিত্য সাধনা করুন। রুচিশীল গ্রন্থ, পত্রিকা ও গুণী মানুষদের আত্মজীবনী পড়–ন। সন্তান ও প্রিয়জনদের হাতে ভাল বই ও সাহিত্য সাময়িকী তুলে দিন। পড়তে উৎসাহিত করুন। প্রকৃত সাহিত্যিকরা দেশ ও জাতির সম্পদ, তাদের দ্বারা সমাজের কোন অপকর্ম/ অপরাধ সংঘটিত হয়না।
করোনাকালীন সময়ে ঘরে বসে রুচিশীল বই, পত্রিকা পড়–ন, নিজে লিখতে চেষ্টা করুন।
একজন সৃজনশীল মানুষ পরিবার-সমাজ- তথা দেশের আলোকবর্তিকাসম নক্ষত্র।