• Thu. Nov 21st, 2024

বঙ্গবন্ধু ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম)

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও  জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দু’জনেই ছিলেন স্বাধীনতার অগ্নিপুরুষ। বাঙালি উজ্জীবিত হয়েছিল এই দুই স্বাধীনতাকামী মহা পুরুষের দ্বারা। বাঙালির জয় হোক বলে যে মুক্তির কথা কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই সাধকেই পরিপূর্ণতা দিলেন জয়বাংলা বলে। দু’জনেই আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, সা¤প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে। বলা হয়ে থাকে সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল, আর রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু। পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের বিশেষ সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন দেশের শোষণ পীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন করেছেন, কারাবরণ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ঠিক তেমনি নজরুলও শোষিত বঞ্চিত মানুষের কথা লেখনীর মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন- আর এই কারণেই কারাবরণ করতে হয়েছে। তাই একদিকে বাংলা সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তেমনি অন্যদিকে রাজনীতির কবি শেখ মুজিবুর রহমান।” কাজী নজরুল ইসলাম কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও ব্যক্তিগত জীবনে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে যেমন মেদিনীপুর, হুগলি, কুমিল­া, ফরিদপুরসহ অনেক জায়গায় অংশগ্রহণ করেছেন। এমন কি ১৯২৬ সালে নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। যদিও তিনি ওই নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। কবি কাজী নজরুল প্রত্যক্ষভাবে ১৯২৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক রাজনীতিতে আসেন। তিনি কৃষক- শ্রমিক শ্রেণিরঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি লাঙল পত্রিকার প্রধান পরিচালক নিযুক্ত হন। লাঙল পত্রিকার সম্পাদনা থেকেই কবি নজরুলের রাজনৈতিক আর্দশ প্রকাশের উদ্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘শ্রমিক-প্রজা-স্ব^রাজ- স¤প্রদায়ের মুখপত্র হিসেবে এই পত্রিকাতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহু কবিতা ( সাম্যবাদী, কৃষাণের গান, সব্যসাচী, শ্রমিকের গান, সর্ব্বহারা) রচনা করেছিলেন এবং সমাজতন্ত্রের জয়গান গেয়েছিলেন। জনৈক গবেষক কাজী নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, “রাজনীতির এই ঘোরময় মুহূর্তে নজরুল দর্শনগত দিক থেকে কখনো কমিউনিজমের শরণাপন্ন, আবার কখনো ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসের। তাঁর চেতনায় একদিকে আলোড়িত ছিল পুঁজিবাদের কষাঘাতে বঞ্চিত মানুষের মুখ- সেখানে তিনি হয়েছেন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার দ্যোতক, সেখানে তাঁর আশ্রয় হয়েছে সমাজতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি হয়েছে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব।” (হাসানুর রশীদ, কবি নজরুলের রাজনীতি ও দর্শন, ভোরের কাগজ, ২৮ আগস্ট ২০১৫) বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিঝরা কবিতা ও গান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে। মূলত বঙ্গবন্ধুর সাথে আমরা কাজী নজরুলের রাজনৈতিক দর্শনের বেশ মিল লক্ষ্য করি। হয়তোবা কাজী নজরুলের দর্শন বঙ্গবন্ধুকে বেশ টানতো। কবি নজরুল যেমন শ্রেণি বৈষ্যমের অবসান চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধুও ঠিক তাই। দুজনেই চেয়েছেন সমাজ থেকে শোষণ, শাসন ও বঞ্চনার অবসান ঘটুক। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা থেকেই বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এ কারণেই কাজী নজরুল ইসলামের ‘ বাংলার জয়’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জয় বাংলা’ এক এবং অভিন্ন। নজরুল গবেষক মুহম্মদ নূরুল হুদা যথার্থই বলেছেন, “ আসলে বাঙালিত্বের সংজ্ঞায়নের প্রশ্নে নজরুল ও বঙ্গবন্ধু দুটি সম্পূরক সত্তা। একজন পূর্বসূরী, অন্যজন উত্তরসূরী।” (মুহম্মদ নূরুল হুদা সম্পাদিত, বিদ্রোহী কবি ও বঙ্গবন্ধু) কবিকেও অসম্ভব শ্রদ্ধাভরে দেখতেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরই বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টাতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলইসলামকে ঢাকায় আনা হয়। ১৯৭২ সালের ২০ মে তারিখে বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে তদানীন্তন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবা সম্পাদক মোস্তফা সারওয়ার এবং পূর্তমন্ত্রী মতিউর রহমানকে কোলকাতায় পাঠান। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর ৭৩ তম জন্মবার্ষিকী ঢাকায় উদযাপন করার। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একটি চিঠি দেন। চিঠির বিবরণে লেখা হয়: “আমি আমার বন্ধু ও সহকর্মী জনাব মতিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মোস্তফা সারওয়ারকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। মুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ ও আমার পক্ষে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার জন্মবার্ষিকীতে আপনার আদর্শে বাংলাদেশকে সিক্ত হতে দিন। আমরা বাংলাদেশে সাগ্রহে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছি। আমি আশা করি, আপনি অনুগ্রহ করে আসবেন। জয় বাংলা।” বঙ্গবন্ধুর চিঠির বরাত দিয়ে ঢাকার পত্র পত্রিকাগুলো নিউজ হেড লাইন করে। ১৯৭২ সালের ২১ মে তারিখে সংবাদ লিখেছিল, ‘বাংলাদেশ আপনার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছে, বিদ্রোহী কবির কাছে বঙ্গবন্ধুর চিঠি।’ বাংলাদেশে কবি কাজী নজরুল ইসলামের পদার্পণ নিয়ে দৈনিক বাংলা ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে ‘ নজরুল প্রেরণার পথে’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিল: “বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। আমরা ভাগ্যবান, আজ এই স্বাধীন স্বদেশে কবি এসেছেন আমাদের মাঝে। তাকে বরণ করছি আমরা মুক্ত হ্নদয়ে, তাঁর কবিতার শৃঙ্খল মুক্তির অপার আনন্দে। এতদিন নজরুলকে আমরা পেয়েছিলাম খন্ডিত করে। কায়েমী স্বার্থচক্র দীর্ঘ দুই যুগ ধরে তার কবিতা আর গানের পরিপূর্ণ সৌরভ থেকে বঞ্চিত রেখেছিল বাংলাদেশের মানুষকে। আজ সে তিমির হনন করে কবিকে আমরা তাঁর পরিপূর্ণ সত্তায় বাঙময় করে তোলার সুযোগ  পেয়েছি।” কবির আগমনে অত্যন্ত আবেগ্লাপুত ভাষায় দৈনিক বাংলার ওই সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়েছিল, “আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে, ১৩৩৯ সালে শেষবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন কবি। জনপ্রিয়তার শিখরে তিনি তখন। ঢাকার বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং নাগরিক সাধারণ ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় বরণ করেছিলেন তাঁকে। তিনি ছিলেন মুক্ত বিহংগ।

লেখকঃ কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সমালোচক। প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *