• Fri. Dec 27th, 2024

সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা রোধে নজরুলের প্রাসঙ্গিক (মাহমুদ কামাল)

নজরুলের ওপর একসময় অভিযোগ ছিল তিনি বিশেষ সময়ের কবি। কিন্তু, আমরা এখন এমন অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, যখন ধর্মের নামে খড়গের নিচে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত; আর এই সময়ে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে ভাবনার জন্ম দিয়েছে। নজরুল সকল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তাঁর অল্প জীবনের সাহিত্যে তিনি হিন্দু-মুসলিমের অপূর্ব সমন্বয় করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়েই নজরুলের উত্থান। এই কবিতার মধ্যে বিদ্রোহ, প্রেম ও ধর্মীয় নানা অনুষঙ্গ পাশাপাশি আবস্থান করেছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা স্বকীয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখা বিদ্রোহী কবিতাটি সেই সময়ে সর্বমহলে আলোড়ন তুলেছিল। আমরা ভেবে বিস্মিত হই, তিনি লিখতে পেরেছিলেন এমন পংক্তি, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।’ একবার ভাবুন সেই সময়ের কথা। আমরা জানি, দেবতা ভৃগুকে নানা সময়ে শাস্তি দেয়ার কারণে তিনি মহাদেবের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। মহাদেবের নিদ্রার সুযোগে তিনি তার বুকে চড়ে লাফিয়েছিলেন। পূরাণের সেই বিষয়টি সাহসিকতার সাথে নজরুল কবিতায় ব্যবহার করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় প্রসঙ্গগুলোও কবিতাটিতে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। লিখেছেন, ঈষান-বিষাণের ওংকার, ইস্রফিলের শিঙ্গা, মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল, অর্ফিয়াসের বাঁশি, বাসুকীর ফণা, পুরাণের এইসব বিষয়াদি। তিনি লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য।’ আমরা বলতে পারি, এই কবিতার মধ্যে সামগ্রিকতা বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উঠে এসেছে।
তিনি বিদ্রোহের কবি, সাম্যবাদের কবি, প্রেমের কবি, ইসলামের কবি, শ্যামা সঙ্গীতের কবি এরকম যার যা সুবিধা সেভাবেই তাকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এ কথা ঠিক উপর্যুক্ত সকল অভিধায় তিনি কবিতা ও গান রচনা করেছেন। মুসলিম এতিহ্য বিষয়ক কবিতা কামাল পাশা, খেয়াপারের তরণী, মহরম, শাত-ইল-আরব, আনোয়ার,কাব্য আমপারা, ঈদ মোবারক, ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম লিখেছেন। পাশাপাশি স্বত:স্ফূর্তভাবে লিখেছেন হিন্দু ঐতিহ্য বিষয়ক কবিতা, আনন্দময়ীর আগমন, পূজারিণী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী ও পূজা-অভিনয়। বিজয়া এবং হরপ্রিয়া নামে লিখেছেন দু’টো নাটক। লিখেছেন অজস্র ইসলমী গান ও শ্যামা সঙ্গীত। লিখেছেন বটে কিন্তু এর জন্য তাকে কম ধকল সহ্য করতে হয়নি। ইসলামী গান লেখার জন্য যেমন তৎকালের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের যেমন তিনি রোষানলে পড়েছিলেন পাশাপাশি শ্যামা সঙ্গীত রচনার জন্য মোল­া-মৌলবীদের কোপানলে পড়তে হয়েছে। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি এর জবাবও দিয়েছেন। মুনীর চেীধুরীর ভাষায় বলা যায়, নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের কবি, বিপ্লবের কবি, শান্তির কবি, সাম্যের কবি। তিনি প্রেম ও অপ্রেমের, হিংসা ও ভালোবাসার, মিলন ও সংঘাতের কবি। আস্তিকতা ও নাস্তিকতা, ধার্মিকতা ও অধার্মিকতা, ইসলাম ও অনৈসলাম সবই নজরুল-কাব্যে পাশাপাশি আবিস্কারযোগ্য। সবকিছু মিলিয়েই নজরুল ইসলাম কবি।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে কবীর চৌধুরীর ‘মুসলিম রেঁনেসা ও কাজী নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধের কিছু অংশ উদ্ধৃত করি। “কোন সত্যিকারের মহৎ শিল্পীই কোন একটি সম্প্রদায়, জাতি কিংবা দেশের হন না। রমাঁ রোলা কি টলস্টয়, শেক্সপিয়ার কি গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ কি নজরুল ইসলাম কোন বিশেষ বা সমাজের লোক ননÑতাঁরা সমগ্র বিশ্বের এবং সমগ্র কালের। মহৎ শিল্পী তাঁর রচনায় বহু ধারার সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্টি বহু মানুষকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। যে ধারা যাকে যে ভাবে প্রভাবান্বিত করে বা অনুপ্রাণিত করে তিনি সেই অনুপাতে গুরুত্ব দেন, তাঁর মূল্যবিচারে ও আলোচনায় সেই স্বীকৃতি প্রাধান্য পায়। কিন্তু খন্ডিত বিচারে সাবধান না হলে মূল্য বিকৃতির আশংকা থাকে।”
উপর্যুক্ত দুই বিখ্যাত লেখকের উদ্ধৃতি পাঠে আমাদের খুব সহজেই মনে হয় নজরুল ইসলাম কোনও বিশেষ ধারার কবি নন। আর সাম্প্রদায়িকতা বিষয়েও তিনি তার অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন তারই লেখা ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের নায়ক প্রমত্তর জবানীতে। নায়কের উক্তি এরকম: আমার ভারত এ মানচিত্রের ভারত নয় রে অনিম। আমার ভারতবর্ষÑ ভারতের এই মূক- দরিদ্র-নিরন্ন পর-পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ! ..আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন-তীর্থ, ওরে এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়, এ আমার মানুষেরÑ মহা মানুষের মহাভারত!”
মানবতার কবি নজরুল সেই গানই গেয়েছেন যেখানে হিন্দু-মুসলিমের সব বাধা ব্যবধান এক হয়ে গেছে। কিন্তু এক কি হয়েছে? এ বিষয়ে তিনিও সন্দিহান ছিলেন। সন্দিহান ছিলেন নিজেকে নিয়েও। তাঁর অল্পদিনের সাহিত্যপ্রদীপ নিভে যাবে তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন সম্ভবত। ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’ এই শিরোনামে ১৯৪১ সালের ৫ই এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত-জুবিলী উৎসবের সভাপতি হিসেবে জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন:Ñ “যদি আর বাঁশি না বাজেÑআমি কবি বলে বলছিনেÑআমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছিÑআমায় ক্ষমা করবেনÑআমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলামÑ সে প্রেম পেলাম না বলে আমি প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি, জাতিতে-জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাবÑ অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মতো জমা হয়ে আছেÑ এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলামÑ অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলামÑ আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই নাÑ তবু আপনারা আদর করে যখন নেতৃত্বের আসনে বসান, তখন অশ্র“ সংবরণ করতে পারি না। তাঁর আদেশ পাইনি, তবু রুদ্রসুন্দর রূপ আবার আপনাদের নিয়ে এই অসুন্দর, এই কুৎসিত অসুরদের সংহার করতে ইচ্ছে করে। যদি আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়েই নামতে হয়Ñতা’হলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সে নজরুল আনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। সেদিন আমাকে কেবল মুসলমানের দলে দেখবেন নাÑ আমি যদি আসি, আসব হিন্দু-মুসলমানের সকল জাতির ঊর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়াম্ তাঁরই দাস হয়ে।”
পরের বছরই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে বাকশক্তিহীন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সাহিত্য জীবন থেকে তার বিদায় আসন্ন। মাত্র ২২/২৩ বছরের লেখালেখিতে তিনি সব সময় মানুষের কথাই বলেছেন। অথচ বর্তমান সময়ে কিছু অমানুষের কারণে আমাদের জীবন-যাত্রা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। নজরুল তা কখনই চাননি। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বায়নকে মোকাবেলা করা। আমরা এখন ডিজিটাল যুগে আছি। বিজ্ঞান বহুদূর পর্যন্ত এগিয়েছে। আমাদের পিছিয়ে পড়লে চলবে না। যত বিঘœই আসুক নজরুলের চেতনার আলোকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা অসুরের নই, আমরা মানুষেরÑ মানবিকতা আমাদের ধর্ম। নজরুল মানবধর্মের কথাই বলেছেন।
ধর্মভীরুতা এবং ধর্মান্ধতা এক কথা নয়। নজরুল সাহিত্যকে বার বার পাঠ করে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরও বৃদ্ধি করতে হবে।

পাবনার শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ সাহিত্য গবেষক
প্রফেসর মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এর প্রথম গ্রন্থ
‘সাহিত্য, স্মৃতি ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গ’
পাবনায় একুশে বইমেলায় বিকিকিনি মার্ট
এ বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
সবার সংগ্রহে রাখার মতো একটি অনন্য গ্রন্থ
গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কপি সংগ্রহ করুন। পড়–ন, প্রিয়জনদের উপহার দিন।

প্রকাশক: রূপম প্রকাশনী
বানী সিনেমার দক্ষিণে, পাবনা।

মোবাইলঃ ১২৫৮৩৩৭০/০৭৩১-৬৪৮৫০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *