১.সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের ভৌগলিক দূরত্ব ৭০০০ মাইল। তা হলেও শিক্ষা, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যšত কাছের একটি দেশ। অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে বলেই আমাদের ধারণা নেই যে জাপান হলে কী রকম দেশ-দুই অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন? আধুনিককালে বাঙালি-জাপানি দ্বিজাতির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শ-ভারতের রাজধানী কলকাতাতে ১৯০২ সালে। সে সম্পর্ক জাপানি শিল্পকলার পন্ডিত ও দার্শনিক তেনশিন ওকাকুরা এবং কবি রবীন্দ্রনাথের যৌথ পৌরহিত্যের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল বলে জাপানি গবেষকরা মনে করেন।
তখনকার অখন্ড বাংলাকে বিবেচনা করলে এই সম্পর্ক শতবর্ষ ছাড়িয়ে গেছে ২০০২ সালে। আর যদি পূর্ববাংলাকে বিবেচনা করি তাহলেও শতবর্ষ অতিক্রাšত হয়েছে ২০০৬ সালে। উয়োমমান তাকেদা নামে একজন জাপানি ১৯০৬ সালে ঢাকায় গিয়ে সাবানের কারখানা স্থাপন করেন এবং বিয়েও করেন সেখানে। তার ছোটভাই তোসানও রানি নামে। একজন মহিলাকে বিয়ে করন ঢাকাতে, পরে কলকাতায় স্থানাšতরিত হন। এরপর ১৯০৭ সালে জাপানের স্বনামধন্য বৌদ্ধপতি নিকি কিমুরা বা রিউকান কিমুরা চট্টগ্রামের মহামুনি গ্রামে অবস্থিত মহাস্থবির মন্দিরে পালিভাষা শিক্ষালাভ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ছিলেন তিন বছর। বৃটিশ জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি খুবই বিখ্যাত হয়েছিলেন ফলে তার নাম শিক্ষাবিদ স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের কানে গিয়ে পেীছেছিল।
পরবর্তীতে কিমুরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক হয়েছিলেন, বিশ বছর সেখানে কাটিয়েছেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তিনি বাংলা ভাষায় ছিলেন তুখোড় ও পারদর্শী।মি তাঁরও বহু বছর আগে ভারতপথিক চীনাভিক্ষু ও পন্ডিত হিউয়ান সাং (৬০২-৬৬৪) ভ্রাট হর্ষবর্ধন ও রাজা শশাঙ্কর সময় ভারতে এসেছিলেন। তার জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি । বাংলার কর্ণসুবর্ণ, পুনগর, সমতট এবং তাম্রলিপ্তি ঘুরেছেন, । বৌদ্ধধর্মীয় শিক্ষালাভ করেছেন এবং প্রচুর বৌদ্ধ, পান্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছেন স্বদেশে। স্ত্রীর ভারতে প্রাপ্ত মহাযান বৌদ্ধসূত্র প্রজ্ঞাপারমিতা যা সংস্কৃত ভাষার আদিকাঠামাে সিদ্ধাম ভাষায় তালপত্রে লিখিত চীনা, কোরিয়ার হাসুল এবং জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। খুবই জনপ্রিয় এই মন্ত্রগেুলা। শুধু তাই নয়, হিউয়ান সাং এর লিখিত জীবনী, চীন, রেশমপথ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণসহ অনেক রচনা ইংরেজি তো বটেই জাপানি ভাষাতেও অনুবাদ করেছেন বৌদ্ধভিক্ষু ও পন্ডিতরা।
তাঁর করোটির বিভিন্ন অংশ পবিত্র নিদর্শন হিসেবে চীনের সিচুয়ান, ভারতের নালন্দা এবং জাপানের নাৱা-প্রিফেকচার বা জেলা। অবস্থিত বিশ্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ ইয়াকুশিক্সি বৌদ্ধমন্দিরে সংরক্ষিত আছে। সুতরাং বলা যায়, জাপানি বৌদ্ধভিক্ষু ও পন্ডিতরা সেই প্রাচীনকাল থেকেই হিউয়ান সাং এর রচনাবলি থেকে ভারতবর্ষের একাংশ পূর্ববাংলার কথাও নিশ্চয়ই জেনেছেন। বৌদ্ধপতি নিক্তি কিমুরাও তেমনি একজন যিনি পালিভার স্কুল যে প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রামে প্রভূত বিকাশলাভ করেছিল জানতে পেরেছিলেন। সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধাšত গ্রহণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত তরুণ লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসের রচনা থেকে জানা যায়, কিমুরার চট্টগ্রাম সফরের সমসাময়িককালে পূর্ববাংলা থেকে জাপানে এসেছিলেন দুজন বাঙালি ব্যবসা ও উচ্চপ্রযুক্তি শিক্ষাগ্রহণে তারা হলেন মন্মথনাথ ঘােধ এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারা দুজনেই জাপান সম্পর্কে ছাদি লিখে রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ১৯১৬ সালে। কিন্তু তারও আগে ১৯১৫ সালে ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের মেয়ে জাপানি ব্যবসায়ীপতœী হরিপ্রভা (মল্লিক) তাকেদা-যিনি স্বরচিত ‘বঙ্গমহিলার জাপানযাত্রা’ গ্রন্থটির জন্য বিখ্যাত জাপানে তাঁর শশুরবাড়ী ভ্রমণ করেছিলেন। পূর্ববাংলার সঙ্গে সম্পর্কিত।
পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পূর্বে অনেক জাপানি স্বদেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধের সময় জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনী পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র বার্মা দখল করে নেয়। পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করেছে কিনা অজ্ঞাত। কিন্তু কুমিল্লার ময়নামতিতে অবস্থিত কমনওয়েলথ সমাধিস্থলে রয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক সেনার সমাধি ফলক। যুদ্ধের পর ১৯৫৩ সাল পর্যšত কোনো জাপানির নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি যিনি বা যারা বাংলাদেশে গিয়ে থাকবেন। ভারতভাগের পর ১৯৫৩ সালে প্রথম ঢাকায় জাপানি কনস্যুলেট খোলা হয়,শুরু হয় সীমিত আকারে ব্যবসাবাণিজ্য। ঢাকার প্রথম আšতর্জাতিক পাঁচতারাবিশিষ্ট ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল (হােটেল শেরাটন, এখন নাম রুপসী বাংলা), বেতারভবন ও টিভিভবন নির্মাণকল্পে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ও নির্মাণকর্মীরা পূর্বপাকি¯তান তথা পূর্ববাংলায় যান। জাপানি নির্মাণ কর্মীদের পানশালার স্মৃতি বহন করছে আজকের বিখ্যাত সাকুরা বার। । ১৯৬২ ও ১৯৭৫ সালে ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দেন জাপানের রাজপুত্র আকিহিতাে বর্তমানে যিনি সম্রাট তখনকার পূর্বপাকি¯তান । এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সফর করেন (যঃঃঢ়://িি.িপযধঢ়ধহধহ. পড়স/)। পাঁচতারা প্যান-ফ্যাসিফিক হােটেল সােনারগাঁও, মেঘনা সেতু, বঙ্গবন্ধু নভাে থিয়েটার প্রভৃতি জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রীবন্ধনের অন্যতম প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে জাপানি নাগরিকদের সাহায্য-সহযােগিতা।