• Fri. Dec 27th, 2024

প্রসঙ্গঃ বিশ্ব দরবারে কবি নজরুল ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা (আবদুর রশীদ চৌধুরী)

নজরুল আমাদের হৃদয়ে সদাজাগ্রত, তিনি বিস্মৃত হবার নন। এ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত আছে। স¤প্রতি এই গবেষণা ধারায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিশ্ব দরবারে আরো পরিচিত করতে বাংলাদেশে অনুবাদকৃত তাঁর গানের প্রথম ইংরেজী অনুবাদগ্রন্থ ‘দি রিটার্ন অব লাইলী’র মোড়ক ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে ১ আগষ্ট, ২০১০ উন্মোচন করা হয়। বইটি প্রকাশ করেছে অ্যডর্ন পাবলিকেশন্স।
ইতঃপূর্বে নজরুলের কবিতা ও গল্প অনুবাদ করা হলেও গান অনুবাদ এ-ই প্রথম। সংগীত অনুবাদের নানা সমস্যা কাটিয়ে প্রফেসর ড. নাশিদ কামালের অনুবাদ করা কবির বিভিন্ন ধারার পঞ্চাশটি গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। বাংলা গানের প্রতিটি ধারায় গান রচনা করেছেন নজরুল আর নজরুলের প্রতিটি ধারার গান থেকে বইটির গানগুলো বাছাই করা হয়েছে। পাশ্চ্যাত্যে যে অল্প ক’জন নজরুল চর্চা করেন তাদের মধ্যে কোন বাঙালি নেই। বিভিন্ন কারণে নজরুলকে নিয়ে আমরা বিশ্ব দরবারে হাজির হতে পারছি না। বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য নজরুল ছাড়া আর কেউ তেমনভাবে ধরতে পারেননি।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রসিদ্ধি শুধু যে উভয় বঙ্গে (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে) প্রসারিত হয়েছে তা-ই নয়, বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতা এবং গান অনুদিত হওয়ার ফলে ক্রমাগত ভারত ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তাঁর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ব্যাপকতর হচ্ছে। তাঁর এমন কতকগুলি কবিতা ও গান রয়েছে যেগুলি হৃদ-সংবীক্ষণে মর্মানুভূতি জাগিয়ে দেয়। সে অনুভূতি মূলত মানবিক সাম্য সচেচতনতা এবং মানবাধিকার সংবলিত হৃদয়স্পর্শী ভাবব্যঞ্জনা। পৃথিবীর সকল মানুষের সুখ-দুঃখের আবেদন সমূহ দেশ ও কালের ঊর্ধ্বে অন্বয়ী-তা পরিবেশগত তারতম্য ছাড়া হৃদ-বীক্ষণে সম-মর্মের। তাই বিশ্বের সকল দেশের মানব স¤প্রদায় সম্পর্কযুক্ত এবং অভেদ আত্মার আত্মীয়। এই সম্বোধে নজরুল সম্বুদ্ধ ছিলেন বলে উলে­খ করেছেন মহন্মদ মিজানুর রহমান।
আশার কথা, নজরুলের কবিতা ও গান বিশ্বের দেশে দেশে অনুদিত হয়ে বিপুলভাবে। সমাদৃত হচ্ছে। ১৯৫৮ সালে লেলিনগ্রাদের এস বতভিনিক রুশভাষায় নজরুলের কবিতা অনুবাদ করেন। ১৯৬২ ও ৭০ সালে কবি মাইকেল কুরগানেতসভ নজরুলের নির্বাচিত কবিতা রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। শোনা যায়, ভারত পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথা মিসর, ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স ও চিনে নজরুলের কবিতা অনুবাদ হয়েছে; অনুবাদ হয়েছে জার্মান, স্প্যানিশ, গ্রিক, উর্দু, ফারসি, ফিলিপিনো প্রভৃতি ভাষায়। ডঃ গুলশান আরার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওখানকার স্টেট গভর্নর এই অনুষ্ঠানে নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান করেছেন। ২রা নভেম্বর ১৯৯৫ ঢাকায় ইরানী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে ওসমানী মেমোরিয়াল হলে মুহাম্মাদ ঈসা শাহেদী কর্তৃক সংগৃহীত ও ফারসি ভাষায় অনুদিত কাজী নজরুল ইসলামের জীবন এবং তাঁর নির্বাচিত কবিতা বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়ে গেছে।
গবেষক সাদেক আলী তাঁর ‘জাতীয় কাব্য ও কবি নজরুল’ প্রবন্ধে বলেছেন, নজরুলের জাতি সত্ত¡ার অনুভূতি বা জাতীয় চেতনা শুধুুমাত্র বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়তার পটভূমিতেই স্থাপিত হয় নি, বিশ্বাত্মতা বা মহামানবতার মিলন তীর্থে তার সংকীর্ণতা অপমোদিত হয়েছে। মহামানবতার মহা জাগরণে বিশ্বাসী কবি মনে করেন, আজ নব যুগের নব সৃষ্টির শুভ মুহূর্ত সমাগত। এখন বিশ্বে উৎপীড়িত জনগণের মুক্তির পর্ব। বিশ্বমানবের মুক্তিকামী কবির দৃষ্টিতে তাইঃ
‘একই দুঃখে দুঃখী জনগণ দেশ, জাতি, সমাজের বর্হিবন্ধন ভুলিয়া পরস্পর পরস্পরকে বুকে ধরিয়া আলিঙ্গন করিল। আজ তাহারা এক, তাহারা একই ব্যথায় ব্যথিত, নিপীড়িত সত্য মানবাত্মা’।
                        (নবযুগ)।
কবির জাতীয় চেতনা এইভাবে আন্তর্জাতিক চেতনা বা বিশ্বমানবের অনুভূতিতে সর্বজনীন ও সর্বকালিক রূপলাভ করেছে। এই বিশ্বাত্মতার অনুভূতি থেকেই কবি শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন। তিনি ভাবলোক বিহারী আদর্শবাদী মানবতার পূজারী ছিলেন না,Ñ সত্যকার গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থা এবং শোষণহীন সমাজের মধ্য দিয়েই তিনি মানবতার মুক্তি চেয়েছিলেন। এই আন্তরিক অনুভূতির জন্য তিনি সকল রকম শোষণের হাত থেকে মেহনতী মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। ‘ধর্মঘট’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে এই ‘পতিত উপেক্ষিত নিপীড়িত হতভাগাদের’ জন্য তাঁর বেদনা বোধ চূড়ান্ত আকারে প্রকাশ পেয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিকতা নিয়ে তিতাস চৌধুরী লিখেছেন ঃ
এই দৃপ্ত ঘোষণা বাণীর মধ্য দিয়েই পাকিস্তানী কবি ইকবাল বিশ্বের সম্পদে পরিণত হন; আন্তর্জাতিক সীমারেখা স্পর্শ করেন। বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিকতা অস্পষ্ট নয়। নজরুল ইসলামও উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেনঃ
আমি চির বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !
বস্তুত নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিকতার স্বরূপ আছে তাঁর কবিতা ও গল্পে, নাটকে ও উপন্যাসে, আর চিঠিপত্র ও অভিভাষণে। তাই সর্বাগ্রে নজরুলের লেখা থেকে অনুসন্ধান ও অšে¦ষণ প্রয়োজন। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের…। যাঁরা আমার নামে অভিযোগ করেন তাদের মত হলুম না বলে তাদেরকে অনুরোধ, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তাঁরা যেন সকলের করে দেখেন।
[নজরুল ইসলামের ‘প্রতিভাষণ’ থেকে। কলকাতা, ১৫ই ডিসেম্বর ১৯২৯]
বলা বাহুল্য, ‘এই সকলের করে দেখা’র মধ্যেই নজরুল ইসলামের আন্তর্জাতিকতার আভাস আমরা লক্ষ্য করি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে। মূলত কোনো ভৌগোলিক সীমারেখাই কোন মহৎ বড়ো কবিকে বাঁধতে পারে না। কোনো সামাজিক রাষ্ট্রীয় এমন কি ধর্মীয় বন্ধনও না, নজরুলের ক্ষেত্রে তো নয়ই।
কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যাণ্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।
নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মন মানসিকতায় অধিকারী না হলে তাঁর পক্ষে উপরিউক্ত কথা বলা কখনোই সম্ভব হতো না।
আসলে জলবায়ুর মতোই কবিদের গতিবিধি ও বিচরণ ক্ষেত্র সকল দেশে, সকল কালে। তাঁদের দেশ নেই, জাতি নেই। পৃথিবীর সব দেশ আর জাতিই তাঁদের দেশ ও জাতি। যেমন কাজী মোতাহার হোসেন নজরুল সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ
‘কেবল এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, কবি সর্ব দেশের, সর্বকালের তাঁকে জাতের সংকীর্ণ গণ্ডির বেষ্টনীর মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করা অত্যন্ত জবরদস্তি’।
[মাসিক মোহাম্মদী, চৈত্র ১৩৩৬]
এই চিন্তা চেতনায়ই তাঁরা আন্তর্জাতিক। তবে যে পটভূমির ভিন্নতায় নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মন-মানসিকতা ও সমাজমনস্কতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন তা এখানে একটু বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এ-কথা সত্য যে, নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় বৎসরে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তিনি শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র। আসলে স্কুলে ষান্মাষিক পরীক্ষার পরই নজরুল ইসলাম বাঙালি পল্টনে তাঁর নাম লিখিয়েছিলেন। নজরুলের নিজের কথায়ঃ
‘ক্লাশে আমি ছিলাম ফার্স্ট বয়। হেডমাস্টারের বড় আশা ছিল আমি স্কুলের গৌরব বাড়াবো। কিন্তু এ সময়ে এল ইউরোপে মহাযুদ্ধ। একদিন দেখলাম, এদেশ থেকে পল্টন যাচ্ছে যুদ্ধে। আমিও যোগ দিলাম এই পল্টন দলে।’
[১৩৪৭ সালে কলকাতায় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র ঈদ-সম্মেলনে কাজী নজরুল ইসলামের প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ থেকে]
প্রকৃত পক্ষে, পল্টন জীবনই, নজরুল ইসলামকে বিশ্বমানবতা শিখিয়েছিলো, তাঁর বিশ্বদৃষ্টি খুলে দিয়েছিল এবং সমস্ত নীচতা, ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, অসুন্দরতা, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সীমাবদ্ধতা এবং জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে সহায়তা করেছিলো। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের মতো নজরুল ইসলাম ক্রমশ বৃহত্তর, ব্যাপকতর ও উদারতর পরিবেশের মধ্যে মুক্তির সন্ধান করেছিলেন বলে ডক্টর আনিসুজ্জামানের ধারণা।
অন্যপক্ষে, নজরুলের কবিতার দিকে তাকালে আমরা কি দেখি, সেখানেও কি নজরুলের বিশ্ব মানবতাবাদ তথা আন্তর্জাতিকতা ঝিকিয়ে ওঠেনি ? যেমন বলেছেনঃ
সকল কালের সকল দেশের
সকল মানুষ আসি,
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন
এক মিলনের বাঁশি।
একজনে দিলে ব্যথাÑ
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা
সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জাÑ
সকলের অপমান।
[‘কুলি মজুর’]
নজরুল ইসলামের অন্য অনেক কবিতাতেও আমরা তাঁর এই আন্তর্জাতিকতার স্পর্শ পাইঃ
বন্ধু বলিনি ঝুট
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজ-মুকুট।
এই হৃদয়ই যে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা কাবা ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ইসা-মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
[‘সাম্যবাদী’]
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। কবি নজরুলের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর ‘আমার বন্ধু নজরুল: তাঁর গান’ প্রবন্ধে উলে­খ করেছেন, প্রায় প্রতি বৎসর গ্রীষ্ম কিংবা হেমন্তের ছুটিতে সস্ত্রীক অথবা একা যদি আমার স্ত্রী কলকাতায় থাকতেন কলকাতায় যেতাম। গেলেই ‘বিদ্রোহী’ কবির সংগে দেখা করাটা আমার যেন ফরজ ছিল। প্রতিদান স্বরূপ কবিও আমার শ্বশুর বাড়িতে আমাদের দর্শন দিতেন। শী¹ীর আমি আবিষ্কার করলাম কবি একজন সুদক্ষ হস্তরেখাবিদ। আমার সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আমার ভাগ্যে সমুদ্র যাত্রা ঘটবে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে আমার ভাগ্যে প্রভূত সম্মান জুটবে। আমি অবশ্যই বলতে পারি না যে তেমন সৌভাগ্য আমার হয়নি…।
যতদূর মনে পড়ে ১৯২৮ সালে নজরুলের দ্বিতীয়বার ঢাকা আগমনে কুমারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় নিয়ে একই ধরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না অথবা ‘বীনানিদিত মঞ্জুভাষিনী’ও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম. এ. এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে ! তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন, আমার কাছে থেকে তিনি শুনেছিলেন যে, কবি একজন সৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্য অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্ক রেখা, জীবন রেখা, হৃদয় রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখা সমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষির মত সূর্য, চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন। ঘণ্টাখানেক পরে আমরা ফিরে এলাম। রাত্রে খাবার পর প্রতিদিনকার অভ্যাসমত আমরা শুতে গেলাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হওয়ার আগে জেগে উঠে দেখলাম নজরুল নেই। বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম নজরুল কোথায় যেতে পারে। সকালে নাস্তার সময় তিনি ফিরে এলেন এবং তাঁর অমনভাবে অদৃশ্য হওয়ার কারণ বললেন: রাত্রি ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম একজন জ্যোর্তিময় নারী তাকে অনুসরণ করার জন্য আমাকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু জেগে উঠে সেই দেবীর পরিবর্তে একটি অস্পষ্ট হলুদ আলোর রশ্মি দেখলাম। আলোটা আমাকে যেন ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে আমার সামনে সামনে এগিয়ে চলছিল। আমি বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে কিছুটা অভিভূত হয়ে সেই আলোকরেখার অনুসরণ করছিলাম। মিস ফজিলাতুন্নেসার গৃহের কাছে পৌঁছান না পর্যন্ত, আলোটা আমার সামনে চলছিল। তাঁর বাড়ির কাছে পৌঁছতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দেখলাম একটি ঘরের মধ্যে তখনও একটি মোমের বাতি জ্বলছে। রাস্তার ধারের জানালার কাছে সম্ভবতঃ পথিকের পায়ের শব্দ শুনে গৃহকর্ত্রী এগিয়ে এসে ঘরের প্রবেশ দরজা খুলে দিলেন এবং মিস ফজিলাতুন্নেসার শয়ন ঘরের দিকে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ফজিলাতুন্নেসা তার ঘরের দরজা খুলে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। কুমারী নেসা তাঁর শয্যার উপর গিয়ে বসলেন আর আমি তাঁর সামনে একটি চেয়ারে বসে তাঁর কাছে প্রেম যাঞ্ছা করলাম; তিনি দৃঢ়ভাবে আমার প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য করলেন।
এই হচ্ছে সামগ্রিক ঘটনা একে মানসচক্ষে নিয়ে আসা কিংবা এর রহস্যোদঘাটন করা অত্যন্ত কঠিন। সূর্য ওঠার পর কোথায় ছিলেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেনঃ
ঐ ঘটনার পর নিরতিশয় ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ি; তাই ভোরবেলা রমনা লেকের ধারে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছিলাম।
এটা অবশ্য একটা যুক্তিসংগত বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার। কেননা নজরুল রমনার লেক ভালবাসতেন এবং লেকের ধারে সাপের আস্তানা আছে জেনেও সেখানে ভ্রমণ করতে যাওয়া তাঁর পক্ষে আদৌ অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আরো একটি বিস্ময়ের ব্যাপার তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঐদিন দুপুরে লক্ষ্য করলাম ফজিলতের গলার লম্বা মটর মালার হারটা ছিঁড়ে দু’খান হয়ে গিয়েছে। পরে সেটা সোনারুর দোকান থেকে সারিয়ে আনতে হয়েছিল…। নজরুল ইসলাম আমার কাছে ও ফজিলাতুন্নেসার কাছে যে সব দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, এমন অঘটন কিছু ঘটেছিল যাতে ফজিলতের হৃদয় তিনি জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ঐ সব চিঠিপত্রে নজরুলের হৃদয়ের গভীর হাহাকার ব্যক্ত হওয়া সত্তে¡ও তাদের সত্যতা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ ক্ষেত্রে নোটনের ব্যাপারে যেমনটি ঘটেছিল ফজিলতের ব্যাপারেও ঠিক তাই-ই ঘটেছিল।
কাজী মোতাহার হোসেন আরো বর্ণনা করেছেনঃ একবার এক ব্যাপার ঘটল। স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুব দাবা খেলা পছন্দ করতেন। তিনি একদিন নজরুল ইসলামকে, আমাকে ও মিঃ আড্ডিকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেতে বললেন, আমাদের খেলা দেখবেন বলে। সুতরাং নজরুল ইসলাম মিঃ আড্ডিকে তাঁর নেবুতলা এ্যাভেনিউ (বউ বাজার)-এর বাড়ি থেকে এবং আমাকে তালতলা থেকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিয়ে গোধূলি সন্ধ্যায় ঢাকুরিয়া লেক এরিয়া থেকে অর্ধ মাইল দূরে অবস্থিত শরৎচন্দ্রের শরৎচন্দ্র এ্যাভিনিউয়ের বাসায় পৌঁছালেন। আমরা দেখলাম বৃদ্ধ ঔপন্যাসিক একটি দাবার ছকের সামনে বসে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। আমরা এক মুহূর্ত দেরী না করে খেলায় বসে গেলাম এবং রাত্রি সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একটানা খেললাম। গৃহকর্তা শরৎচন্দ্র ও নজরুল সারাক্ষণ বসে খেলা দেখছিলেন আর নজরুল ইসলাম ও অতিথি খেলোয়াড়দের প্রচুর পান ও চা জোগাচ্ছিলেন। খেলার ফলাফল হয়েছিল সমান-সমান। খেলার পর পূর্ব-ব্যবস্থা অনুযায়ী কিছু খানাপিনা হল। তারপর নজরুল ইসলামের গাড়িতে করে আমরা ঘরে ফিরে এলাম।
আড্ডি এবং আমি উভয়েই প্রায়ই নজরুলের বাড়িতে যেতাম; এবং গৃহকর্তারও বাড়িতে অবশ্য-নির্দেশ দেওয়া থাকত যে, কবি বাড়িতে উপস্থিত নেই, এমনি মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে যেন আমাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া না হয়। ব্যাপার হল অনাহূত আগন্তুকেরা এসে কবিকে বিরক্ত করতো বলে উদ্দেশ্যজনক ভাবে তিনি তাঁর বাড়ির প্রবেশ পথের উপর একটি ‘বাড়ি নেই’ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে রাখতেন। আমার মনে হয়, দাবা খেলোয়াড় হিসাবে নজরুল বড় জোর কলকাতার মাঝারি খেলোয়াড়দের সমান ছিলেন। সুতরাং ১৯২৫-এ কলকাতার দাবা প্রতিযোগিতায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়, যদিও আমি ছাড়া অন্য একজন সাধারণ প্রতিযোগী থেকে অর্ধেক পয়েন্ট তিনি জিতে নেন…।
এবার অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা উলে­খ করতে চাই, বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন আমার বড় মামা। সেই সুবাদে তাঁর কাছে কাজী নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি, তথ্য জেনেছি…। আমার মায়ের মুখেও শুনেছি, কুমিল­া থেকে ঢাকা হয়ে রাজনৈতিক কারণে আলমডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় যাওয়ার পথে আমার মামা বাড়ি, তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা) বাগমারা গ্রামে একবার স্বল্প সময়ের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন। দুপুরে বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ের মধ্যে গাবগাছের নীচে মাদুর পেতে তাঁরা দাবা খেলেছিলেন এবং আমার মা ছালেহা খাতুন (তখন কিশোরী) তাঁদের ফরমায়েস অনুযায়ী ঝালমুড়ি মেখে নিয়ে গিয়েছিলেন বেতের কাঠায় করে।
কাজী নজরুলের নাতি কণ্ঠশিল্পী সুবর্ণ কাজী কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ড. ফজলুল হক মহিলা ডিগ্রী কলেজের ইংরেজী বিভাগের অনারারী প্রফেসর হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন কালে প্রায়ই কুষ্টিয়া আসতেন এবং আমাদের পরিবারেরই একজন হিসেবে তাঁকে দেখা হত।
তাঁর আমন্ত্রণে বেশ ক’বার পশ্চিবঙ্গের বর্ধমান জেলার কবিতীর্থ চুরুলিয়ায় আমি সস্ত্রীক (তাছলিমা চৌধুরী বুলবুল) গেছি এবং সে সময় নজরুল পরিবারের সাথেও আমাদের সখ্য হয়। সুবর্ণর বড় চাচা কাজী মাজহার হোসেন (চুরুলিয়া নজরুল একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক) আমাকে একাডেমীর বাৎসরিক সুভ্যেনির ঢাকার বনানীতে কাজী নজরুলের নাতনী খিলখিল কাজীর কাছে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করায় তাঁর চিঠি ও স্মরণিকা খিলখিল কাজীকে পৌঁছে দিই…।
নজরুলের অপর ভাতিজা কবি কাজী রেজাউল করিমের আতিথেয়তা ভুলবার নয়। আমরা চুরুলিয়ার ‘নজরুল যুব আবাস’ এ অবস্থানকালে প্রতিদিন নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার তাঁর সাথে তাঁর বাসায় খেতে হত। তিনি কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা, সাপ্তাহিক জাগরণী ও মাসিক অভিষেক পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লেখেন…।
দু’তিন দিন পর সুবর্ণ বাসার গাড়ি করে আমাদের আসানসোল ষ্টেশনে পৌঁছে দিল। এর আগে আসানসোলে তার বোন ও ভগ্নিপতির সাথে তাদের বাসায় আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়…।
বাংলাদেশে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে নজরুলকে নিয়ে চিত্রায়িত নাটক ও টেলিফিল্মে সুবর্ণ কাজী নজরুলের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এবং তা প্রশংসিতও হয়েছে…। নজরুল প্রসঙ্গে চুরুলিয়া ও তার আত্মীয়-স্বজন এমনিতেই এসে যায়…।

তথ্য সহায়কঃ
প্রফেসর রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত: নজরুল স্মৃতিচারণ
নজরুল একাডেমী পত্রিকা: ৫ম সংখ্যা ১৩৯৫।
নজরুল একাডেমী পত্রিকা: নজরুল জন্ম বার্ষিকী সংখ্যা, মে-২০০০।
নজরুল একাডেমী পত্রিকা: নজরুল স্মারক সংখ্যা ১৩৮৪

লেখক: সাংবাদিক, কবি ও চিত্রশিল্পী,
সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা, কুষ্টিয়া।

সাহিত্যানুরাগী সচেতন বাঙালি
লেখক ও পাঠকদের জ্ঞাতার্থে
সৃজনশীল সাহিত্য ভাবনা ও নান্দনিক রচনায় আপনার মনের সকল ক্লেদ অভিমান জমাট বাধা দুঃখ কষ্ট সামাজিক অনাচার ব্যাভিচার-অনিয়ম সবই তুলে ধরতে পারেন আপনি। প্রতিটি মানুষের মাঝেই সাহিত্যভাবনা থাকে, যাঁরা সাহিত্যকে লালন করেন, পালন করেন তারা একসময় হয়ে ওঠেন লেখক। আপনার মনের ভাবনাগুলিকে সৃষ্টিশীল করে তুলতে রুচিশীল সাহিত্য পাঠ করুন, নিজে লিখতে চেষ্টা করুন, তাহলে আপনিও একজন লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। মান সম্পন্ন সাহিত্য আপনার সন্তান-সম্পত্তির চেয়েও অনেক সম্মানের সাথে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে পৃথিবীতে অসংখ্য মানব হৃদয়ে। আপনার চিন্তাশীল লেখনীটি পাঠিয়ে দিন ‘অনন্য কথা’ দপ্তরে, প্রকাশ হবে পরবর্তী সংখ্যায়, ছড়িয়ে পড়বে বৃহৎ পরিমণ্ডলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *