শরতের সেই আবছা কুয়াশা ঘেরা সকালে শিশির মাখা শিউলী ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথাই ছিল জয়ন্তীর প্রথম কাজ। তাইতো ঘুম থেকে উঠেই মার বকুনীর অন্ত থাকতো না। পড়া-লিখায় তেমন মন নেই। সারাদিন শুধু দুষ্টামী আর দুষ্টামী। পাশের বাড়িতে জয়ন্তীর এক বন্ধু ছিল, নাম রুদ্র। রুদ্র খুব শান্ত ছেলে। পড়ালিখায় ও খুব ভাল। তাই জয়ন্তীর দুষ্টামী দেখে মাঝে মাঝে বড় মানুষী ভাব দেখিয়ে তাকে বকাঝকা করতো। জয়ন্তী একটু আধটু মন খারাপ করে, শিউলী মালাটি রুদ্রের মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে যেত। মালাটি পেয়ে রুদ্রের সমস্ত রাগ মাটিতে মিশে যেত। সে ভালবাসার স্বরে জয়ন্তী বলে ডাকতে থাকতো। রুদ্রের মাও জয়ন্ত্রীকে খুব ভাল বাসতেন আর আদর করতেন। এভাবেই কেটে যায় তাদের ছেলেবেলা।
রুদ্রের বাবা একজন সরকারি চাকুরীজীবি। তাই হঠাৎ করেই তাকে বদলি হয়ে চলে যেতে হয় দূরে কোন এক জায়গায়। সেখানে গিয়ে তিনি রুদ্রকে ভাল স্কুলে ভর্তি করাতে চান। তাই স্ব-পরিবারে চলে যেতে হয় রুদ্রকে। রুদ্র চলে যাবার সময় জয়ন্তী খুব কেঁদেছিল। শেষে শিউলী মালাটি দিয়ে বলেছিল- “জয়ন্তীকে যদি কখনও মনে পড়ে তখন এই মালাটি দেখ।” রুদ্র অশ্র“ সংবরণ করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। এই বিদায়ের মূহুর্তটিই যেন জয়ন্তীকে বেশী পরিমানে ব্যথিত করে তুলে।
এভাবে একদিন যায়, দুই দিন যায় জয়ন্তীর আর কিছু ভাল লাগেনা। পড়াশোনা, কাজকর্ম কিছুতেই সে মনোবিনেশ করতে পারেনা। যে কাজের জন্য প্রতিদিন সকালে মায়ের বকুনীই ছিল একমাত্র আহার, সেই শিউলী ফুল, সেই মালা গাঁথা সবই যেন অহেতুক হয়ে উঠলো। দেবদাসকে ফেলে পৌঢ়া ব্রাহ্মণের ঘরে যেতে পার্বতীর মনের অবস্থা যেমন হয়েছিল, জয়ন্তীর মনের অবস্থাও যেন ঠিক তাই হয়ে উঠলো। কিন্তু এভাবে আর কত দিন! তাইতো হলো, পার্বতীর মতো সবকিছু মেনে নিয়ে নতুন জীবন শুরু হলো জয়ন্তীর। সারাদিন ঘরের কাজকর্ম, অসুস্থ বাবা মা’র সেবা যতœ, সময় পেলে মাঝে মাঝে একটু-আধটু পড়ালিখা ইত্যাদি। এভাবে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এটাও জয়ন্তীর ভাগ্যে সইলো না বেশীদিন। হঠাৎ করে বাবা মারা যাবার শোক সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই মাও মারা গেলেন। অসহায় জয়ন্তীর আর কেউ রইলো না। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। কিন্তু এক পর্যায়ে গ্রামের মোড়লের কু-দৃষ্টি থেকে রেহাই পাবার জন্য গ্রাম ছাড়তে হলো জয়ন্তীকে।
দু’কলম বিদ্যে যা শিখেছিল সেটাকেই সে সম্বল মনে করে এগুতে লাগলো সামনের দিকে। ভর্তি হলো সেবা প্রতিষ্ঠানে, মনে মনে পণ করলো মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবে। তাই নিজের কথা না ভেবে পরের জন্য কাজ করে চলে অবিরাম।
বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। ওদিকে রুদ্র পড়া-লিখা শেষ করে বড় মাপের ডাক্তার হয়েছে। দেশ জুড়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে সংবর্ধণা দেওয়া হবে জন্য এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে অনেক উচ্চ পর্যায়ের লোক আমন্ত্রিত হয়েছেন। সেই সাথে ডাক পড়েছে জয়ন্তীদেরও। লোকমুখে জয়ন্তী রুদ্রের পরিচয় পেয়ে আনন্দে উৎফুল। কিন্তু এক নামি-দামি জনসম্মুখে জয়ন্তীর স্থান কোথায়? তাইতো সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুধু স্মরণ করতে থাকে অতীতের স্মৃতি। সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। আর বার বার শুধু রুদ্রের কথাই মনে হয় এভাবে আর চলেনা। তাই ঠিক করলো একসময় রুদ্রের সাথে দেখা করবে, বলবে তার এতদিনের জমানো না বলা কথাগুলো।
এদিকে রুদ্রও ভুলতে পারেনি তার ছোটবেলার সেই জয়ন্তীকে। এ ‘ক’ বছরে অনেক বন্ধু-বান্ধবী হয়েছে কিন্তু জয়ন্তীর স্থান কেউ দখল করতে পারেনি। তাইতো জয়ন্তীর আগমনে রুদ্র যেন স্বস্তি ফিরে পায়। প্রথমে জয়ন্তীকে চিনতে কষ্ট হলেও শিউলী মালার কথা বলতেই রুদ্র চেয়ার থেকে উঠে কাছে এসে আনন্দের সাথে জয়ন্তীর হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “দেবে না তোমার রুদ্রদা’কে তোমার সেই শিউলী মালা?”
লেখক: কবি ও গল্পকার, অধ্যাপক, নাটোর।