‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’।
কি বিড়বিড় করো দিদি?
হ্যাঁ? না না, ও কিছু না।
আরেকটুখানি ফুলকপির তরকারি দেবে নাকি?
কী যে বলো না! খাও না যত ইচ্ছে।
পারমিতা গোবিন্দলালের পাতে ফুলকপির তরকারি দেয়। ওদিকে ভুবু সেনাপতি, কাত্তিক গাঁতাইত, মেনকা মালোরা হাত চেটে খাচ্ছে। পারমিতার আরাম হয়।
অনন্ত চেঁচিয়ে বলে, দিদি ভাত ফুরিয়ে এলো। আবার এক হাঁড়ি বসাবো?
পোস্তার দিক থেকে এখনো লোকজন আসছে। গঙ্গা থেকে ঝিরঝিরে হাওয়া ছেড়েছে, চওড়া সিঁড়িরা উঠে-নেমে গেছে, চাঁদের ফালির মতো একখানা নৌকো গঙ্গার অল্প ঢেউয়ে দুলছে। সূর্য মাঝ আকাশ থেকে একটুখানি গড়িয়েছে। পারমিতা অনন্তর দিকে তাকায়। বড্ড খাটছে ছেলেটা সকাল থেকে। বলে, চাপিয়ে দে, আরো এক হাঁড়ি ভাত চাপিয়ে দে।
অনন্ত বড় হাঁড়ি বসায়। ডাল, তরকারি, মাছ আছে এখনো। কম পড়বে না। ভাতটাই খাচ্ছে বেশি। সাড়ে এগারোটা-বারোটা থেকে খাওয়ানো শুরু হয়েছে। জনা পঞ্চাশেক খেয়েছে। এখনো লোক আসছে।
পারমিতা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে গঙ্গার আরেকটু কাছে বসে, পাশে বসে। হাওড়া ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। ব্রিজের মাথায় একখন্ড সাদা মেঘ ঝুলে আছে। পারমিতা হাত বাড়ায়। মেঘ ছুঁতে পারে না। তবু হাত বাড়ায়। বুকের মধ্যে কেমন যেন হুহু করে। কখন আসবে সে? কখন?
চক্ররেলের লাইন ক্লান্ত হয়ে আছে। লাইনের পাশের ঝুপড়ি থেকে টুপু, দুলাল, হুকুম কলকল করতে করতে এসেপারমিতার পাশে বসে। টুপুর চোখ দুটো দুষ্টুমিতে ভরে আছে। বলে, ও দিদি, চলো রং খেলব।
তোরা খেল। আমি রং খেলি না।
আরে চলো না। আজ না দোল। আজ রং খেলবে না তো কবে খেলবে?
নারে বাবু। তোরা যা। অবশ্য নতুন করে রং আর খেলবি কোত্থেকে? মুখ-চোখ তো ভূতের মতো হয়ে আছে। সকাল থেকে রং মেখে বসে আছিস, রং দেয়ার আর জায়গা আছে নাকি?
টুপু, দুলাল, হুকুমরা পারমিতার কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে। পারমিতাও হাসে। টুপুর মাথা আছে। নাইট স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী। পরের বছর কোনো ভালো বাংলা স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করাতে হবে টুপুকে। যদি না ততদিনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেয়। পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অনন্ত লোকজনকে তাড়া দেয়, আরে করছো কি? হাতই তো নড়ছে না। এত ঢিলে দিলে চলবে? এরপরেও লোকজন আসছে। আরো দুটো ব্যাচ অন্তত বসাতে হবে। সন্ধ্যে হয়ে যাবে তো।
বাগবাজার ঘাটের দিক থেকে গান ভেসে আসছে। দোলের গান। পারমিতা উঠে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে বাগবাজার ঘাটের দিকে যায়। ঊনিশ-কুড়ি বছরের মেয়েরা শাড়ি পরে, মাথায় পলাশ গুজে নদীর কাছে বসেছে। জিনস-পাঞ্জাবিতে ছেলেরাও আছে। সব বন্ধুরা মিলে গান গাইছে। পারমিতার আনন্দ হয়। ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে/ সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে’। পারমিতা ফিসফিস করে গলা মিলিয়ে ফেলে, ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’। ভেতরটা তিরতির করে কাঁপে। ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা, পলাশ ফুলের মেয়েদের একজনেরকাছে এগিয়ে গিয়ে গালে আবির দেয়। ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, রঙ যেন মোর মর্মে লাগে’। পারমিতার ভালোবাসার লোভ হয়। গান বদলে গেছে, ‘আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে আকাশ খেলে হোলি/ কেউ জানে না সে কোন কথা মনকে আমি বলি’।
পারমিতা ফিসফিস করে, ‘কেউ জানে না সে কোন কথা মনকে আমি বলি’। হাসিতে পারমিতার চোখ চিকচিক করছে, কান্নায় পারমিতার চোখ চিকচিক করছে।
পারমিতা ফিরে যায়। ফিরে যেতে যেতে বুঝতে পারে না কার কাছে ফিরছে। কাশীমিত্র ঘাট শ্মশান। ফিরতে ফিরতে পারমিতা শ্মশানের কাছে দাঁড়ায়। হুহু করা কান্না ভাসছে। পারমিতা কান্নার মধ্যে রং খোঁজে। নাভিকুন্ড ভাসাতে যাচ্ছে কে একজন। রং কই? রং টের পায় না। অথচ রঙের লোভ হয়।
পারমিতা চুলিকে বলে, কে পুড়ছে গো? কে পুড়ছে?
চুলি হেসে গড়িয়ে বলে, কে নয়?
সবাই পুড়ছে?
সব্বাই।
তারপর?
তারপর নেই।
কিচ্ছু নেই?
কিচ্ছু না।
‘জীর্ণ কিছুই নেই কিছু নেই, ফেলে দিই পুরাতনে’? তুমি যত বলো কিছু নেই, আমি বলব আছে।
হা হা হা, তুমি যেমন করে দ্যাখো। তুমি যদি ‘আছে’ দেখতে পাও, তবে ‘আছে’, যদি দ্যাখো ‘নেই’, তবে ‘নেই’।
দেখতে পাই না, আর ‘আছে’কে দেখতে পাই না। কষ্ট হয়। কেমন যেন মনে হয় এ দেখা সান্ত্বনার দেখা। আমি জীর্ণ দেখি। দেখি কিছু নেই। সত্যিই কিছু নেই।
তাও তো অপেক্ষা করো।
ওমা, আজ দোল যে। অপেক্ষা করব না?
তবে পোড়ো।চিরন্তন পোড়া।
চিরন্তন।
মুক্তি?
নেই।
দুঃখ?
আহা, বলো রং। দুঃখ নয়। এ হলো কিছু না থাকার রং।
পারমিতা ফিরে যায়। নতুন ব্যাচ বসেছে। পারমিশান নেওয়া ছিল, তাই রাস্তায় চট বিছিয়ে, লোক বসিয়ে খাওয়াতে অসুবিধা হচ্ছে না।
বছর আশির সনাতন মান্না আরাম করে লঙ্কায় কামড় দিয়ে পরম বন্ধু বছর আটাত্তরের নগেন হাঁসদাকে বলে, কুমোরটুলি থেকে মা দুগগা, মা দুগগা গন্ধ পাছিস নাকিরে?
নগেন হাঁসদার ডালটা বেড়ে লেগেছে। বহুদিন এমন মুগডাল খায়নি। আঙুল চাটতে চাটতে বলে, তুমি গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে আছো, মানে কুমোরটুলি এখন ঠিক তোমার পেছনে, ডান হাতে বাগবাজার, বাঁ হাতে আহিরিটোলা। তা সে মা দুগগা মা দুগগা গন্ধ তুমি পেতেই পারো। তবে কিনা আজ সবে দোল। দুগগা পুজো ঢের পরে।
আহা সে কি আর আমি জানি না। তবে ওই পারমিতা দিদিকে দেখে কেমন দুগগা দুগগা লাগলো। যেন কুমোরটুলি থেকে নিয়ে এসে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা দুগগা। তাই বললাম।
নগেন জবাব দেয় না। পারমিতা সত্যিই মা দুর্গা হয়ে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। গত পাঁচ বছর ধরে দোলের দিন এখানে পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়। ঝুপড়ির লোক, ভিখিরি, লরিওলারা চেটেপুটে খায়, পুজোতে জামা দেওয়া হয়, রাতের ইস্কুল করে ছেলেমেয়েদের পড়ানো হয়, ডাক্তারি ক্যাম্প হয় বছরে দুবার। আরো কত্ত কাজ করে পারমিতা দিদির এনজিও। কত আর বয়েস দিদির? মেরে কেটে বত্রিশ-তেত্রিশ হবে।
অনন্ত এসে বলে, দিদি এবার তুমি খেয়ে নাও। এটাই শেষ ব্যাচ। আমরা এবার গোটাবো।তোর খুব পরিশ্রম গেল নারে অনন্ত?
কী যে বলো না! আমি একা কী করলাম? এনজিওর সবাই তো আছে নাকি! আর সব থেকে বেশি পরিশ্রম তো করো তুমি। নাও, খেয়ে নাও। খেয়ে নিয়ে বাড়ি যাও।
পারমিতার ঘোর হয়। বলে, তোরা গুটিয়ে নে। আমি গঙ্গার কাছে আরেকটু বসবো।
মানু বৈরাগী টিফিন বক্সে করে স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে নিয়েছে। পঙ্গু ভিখিরি স্বামী আজ ভিক্ষা করতে বেরোয়নি। দোলের দিন তার ছুটি। মানুর গালে সে আবির মাখিয়েছে। মানু এসে পারমিতার কাছে দাঁড়ায়। পারমিতা দ্যাখে মানুর গালে আবির। পারমিতার দু’চোখ ভিজে যায়। মানু পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, দিদি কেঁদো না, কেঁদো না। সাট সাট, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছে?
দুলাল বোঝে না কিছু। কেন কাঁদছে দিদি? সে চক্ররেলের ধারের ঝুপড়িতে এসেছে বেশিদিন হয়নি। এখনো সবকিছু তার জানা হয়নি। টুপুকে জিজ্ঞেস করে।
আহ, তুই একটা মাথামোটা। দিদি কেন কাঁদছে তুই বুঝিস না?
কেন কাঁদছে?
বরের জন্য কাঁদছে। বর মরে গেছে। দোলের দিন সকালবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল বাইকে করে, অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছে। তাইতো দিদি দোলের দিন রং লাগায় না, আমাদের খাওয়ায়।
এমা, দিদি বিধবা?
টুপুর গা জ্বলে যায়। গালি দিয়ে বলে, শালা ভিখিরির বাচ্চা, বিধবা আবার কিরে? বিধবা-টিধবা নয়, বরের সঙ্গে দিদির তখনো বিয়ে হয়নি। আর যদি হতোও বিধবা, তোর কি? আমার তো মনে হয় প্রতিবছর দোলের দিন দিদি আরেকটু সুন্দর হয়ে যায়। এমনিতেই ফর্সা, দোলের দিন দিদিকে আরো ফর্সা লাগে।
দুলাল টুপুকে ভয় পায় তাই কথা বাড়ায় না। গঙ্গার হাওয়ায় ঠান্ডা লেগে তার সর্দি হয়েছে বেশ, সে নাক টানে। তবু বিকেল হলেই গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে স্নান করবে, লঞ্চ ঘাটেরমাথা থেকে ঝাঁপ মারবে। হেব্বি মজা। আজ দোল বলে রুটিনে হেরফের। আগে খাওয়া, পরে স্নান।
অনন্তরা জিনিসপত্র গুটিয়ে নেয়। এনজিওর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, গাড়িতে তুলে দেয় সব। অনন্ত বলে, দিদি তুমি একা থাকবে?
হুম। তোরা যা।
আমি তোমাদের বাড়ি হয়ে যাব। জেঠু-জেঠিমা জানতে চাইলে কি বলব, তুমি কোথায়?
বলবি আমি বেশি রাত করব না, বাড়ি ফিরব। ওরা যেন খেয়ে নেয়। চিন্তার কিছু নেই। তাদের মেয়ে সুইসাইড করবে না।
পারমিতা হাসতে থাকে। গঙ্গাতে হাসি পাক খায়। মা দুগগার হাসিতে গমগম করে চারদিক। অনন্ত দিদিকে ধূসরতায় মিলিয়ে যেতে দ্যাখে। ধূসরতা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। কিছুতেই পারে না।
সূর্য ডুবে যায়, অন্ধকার নেমে আসে, শহরের আলো জ্বলে, এখনো বিলুপ্ত না হওয়া পাখিরা বাসায় ফেরে। চাঁদের পাশে নতুন একখানা তারা জন্ম নেয়। পারমিতা আকাশের দিকে চেয়ে বলে, এসেছো আবিরওলা, তুমি এসেছো?
আবিরওলা উত্তর দেয় না।
পারমিতার চোখ ভেসে যায়। দু’হাতে নিজেকে আঁকড়ে ধরে। খুব আস্তে গেয়ে ওঠে, ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে/ সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে/ রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে’। একটু রং লাগিয়ে দাও আবিরওলা, অল্প একটু রং। আমার সব শুভ্রতা মুছে দাও।
গঙ্গার জলে পারমিতার কান্নারা ঢেউ হয়ে হাসতে থাকে আর এক আবিরওলা রং নিয়ে রওনা দেবে বলে তৈরি হয়। তাড়াতাড়ি এসো আবিরওলা, আর বেশি সময় নেই।
লেখক: কবি, ছড়াকার, গল্পকার ও শিশুসাহিত্যক, চট্টগ্রাম।