• Sun. Nov 17th, 2024

আমাদের লোক শিল্প ও আধুনিক চিত্রকলা (মুহাম্মদ বদরুদ্দোজা)

আমাদের লোক জীবন ও লোক সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে মূলত লোক শিল্প বলতে তাকেই বুঝায়। আমাদের সহজ-সরল কিন্তু বর্ণাঢ্য লোকায়ত জীবন লোক শিল্পের প্রধান ঐশ্বর্য্য। আমাদের দেশের প্রতিভাবান শিল্পীরা বাংলার নান্দনিক জীবন চেতনাকে তাদের শিল্পের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে সৃজন করেছেন আধুনিক শিল্পের উজ্জ্বল ভূবন। তারা রূপে-রসে আমাদের শিল্প ভান্ডারকে ভরিয়ে তুলেছেন বিচিত্র ভাবে। আমাদের ঐতিহ্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন স্বগৌরবে।
আবহমান কাল থেকে গ্রামের মানুষ সত্য ও সুন্দরের পূজারী। সত্য সুন্দর কে তাদের জীবন চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গ্রাম গঞ্জের সাধারণ মানুষের হাতে যে শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে তাই লোক শিল্প।
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার ধারা প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই সকল কৃর্তিমান শিল্পীদের সৃজন কর্মের দিকে।
ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভেতর লালিত-পালিত হয়ে বাংলার শিল্পী সমাজ লোক সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। আমাদের শিল্পকলায় উত্তর উত্তর সাফল্যের পশ্চাতে রয়েছে এ দেশের প্রতিভাবান শিল্পীদের নিরন্তর সাধনা। লোক শিল্প আমাদের আত্ম পরিচয়ের সোনালী স্বাক্ষর। আমাদের শিল্পকলায় সামাজিক জীবন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও কালের প্রভাব প্রতিভাত হয়েছে চমৎকার ভাবে। লোক শিল্পে স্বদেশী ঐতিহ্যের স্ফূরণ ঘটে বহু মাত্রিক ব্যঞ্জনায়। আমাদের আত্ম মর্যাদাবোধ ও স্বদেশ চেতনার বিস্তারে এই শিল্পের জুড়ি নেই।

লোক শিল্পের কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিম্নে উলে­খ করা যেতে পারেঃ
১। ঐতিহ্যই লোক সংস্কৃতি ও লোক শিল্পের মূল প্রবাহ। লোক শিল্প আধুনিক সভ্যতার ফসল নয়। উহা লোক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। গ্রামীণ সাধারণ জীবন প্রক্রিয়ার সন্ধান পাওয়া যায় এ শিল্পে।
২। সাধারণ মানুষ এবং তাদের জীবন যাত্রা লোক শিল্পে স্থান করে নিয়েছে। লোক শিল্প সহজ বোধ্য এবং এর উপস্থাপনা সহজ-সরল এবং স্পষ্ট।
৩। লোক শিল্প তার নিজস্ব গন্ডিতে গুণগতভাবে এতিহ্যের অধিকারী।
৪। ইহা রক্ষণশীল ও গতানুগতিক।
৫। লোক শিল্প অনায়াসে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ শিল্পের কোন সন তারিখ বা সূচনা নির্ণয় করা সত্যিই দূরুহ। তবে ধারণা করা হয়েছে যান্ত্রিক সভ্যতার বহু আগে এই শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে। লোক শিল্পের নানা মাধূর্য্য আমাদের আলোড়িত করে। লোক শিল্পের পরিবর্তন তেমন হয় না। শাশ্বত কাল ধরে তাদের গৌরব জনক অবস্থান।
৬। বাংলার আলপনায়, পটচিত্রে, পৃথিচিত্রে লোক শিল্পের গুণাগুণ পাওয়া যায়। আমাদের গ্রাম বাংলার নকঁশী কাঁথার নানা রকম অলংকরণে লোক জীবন স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। পোড়া মাটি পুতুল, কাঠের পুতুল, ঘট, শরা, শীতল পাটি ইত্যাদিতে লোক শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের লৌকিক সৌন্দর্য্য বোধের সহজ-সরল প্রকাশ ঘটেছে এ সকল কাজের ভেতরে। এ শিল্পের ঐশ্বর্য্য আমাদের মুগ্ধ করে। এসব শিল্পে বাঙালির স্বপ্নের ও চাওয়া-পাওয়ার অভিব্যক্তি রয়েছে বিপুল শ্রদ্ধায়। পুতুল, মুখোশ, নকঁশী কাথা ইত্যাদি আমাদের লোক শিল্পের একটি উলে­খযোগ্য বিষয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্দির ও মসজিদে গায়ে আঁকা পোড়া মাটির চিত্রফলক লোক শিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শণ যা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ।
৭। নদী মাতৃক বাংলার মাটি, মানুষের দীর্ঘ দিনের আবেগ, আনন্দ, বেদনার প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশের লোক শিল্প।
৮। লোক শিল্পের ভাষা বর্ণনা মূলক এবং এতে উজ্জ্বল রংয়ের উপস্থিতি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। এ শিল্পে নিজের অস্তিত্ব, ঐতিহ্য ও শেকড় খোঁজার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়।
আমাদের দেশের শিল্পীরা লোক শিল্পের ঐতিহ্যকে ধারণ করে দেশ মাতৃকার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় তাদের মেধাবী সৃজনে লোক শিল্পের নানা উপাদানকে উপস্থাপন করেছেন নানা ভাবে। যাদের মধ্যে নিম্নের কয়েকজন শিল্পীর সৃজন কর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম জয়নুল আবেদীন। বাংলার লোক সংস্কৃতি, লোক ঐতিহ্য অনুসন্ধানে তার অবদান বর্ণনাতীত। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সমকালীন আধুনিক শিল্পধারার প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রাণ পুরুষ। বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্যের শুদ্ধতা রক্ষার ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদীনের ভূমিকা প্রবাদ প্রতীম।
বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিকতার প্রকাশ ও প্রবর্তনে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা বর্ণনাতীত। বাংলার মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশ তাকে প্রবল ভাবে টানছিল। আবহমান বাংলার মেহনতী মানুষ, ঐতিহ্যের প্রতি তিনি ছিলেন গভীর ভাবে শ্রদ্ধাশীল। তিনি মূলত প্রকৃতি ও মানুষের শিল্পী। গ্রামীণ বাংলার নানা প্রাচুর্য্য তাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। লোক জীবনধারা তাঁর চিত্রকর্মে গভীর ঐশ্বর্য্য নিয়ে বিকশিত হয়েছে। নৌকা, মাঝি, গ্রামের বধূ, জেলে, মজুর বেদেনী, সমাজের অবহেলিত কৃষক প্রমুখ তার চিত্রের প্রধান চরিত্রের মর্যাদা লাভ করে। অত্যন্ত প্রাণখোলা, সহজ-সরল মানুষটির ছবির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি তা কত সহজতা ও স্বতঃস্ফূর্ততায় ভরপুর। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য, লোককলা, লোকজীবন এবং শিল্পের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল। তার অনুভব ও উপলদ্ধিতে তা ছিল প্রভাত সূর্যের ন্যায় দীপ্যমান। তাঁর বাংলার দুর্ভিক্ষের উপর আঁকা ছবি কালোত্তীর্ণ শিল্পের মর্যাদায় সমাসীন হয়েছে। স্বল্প মূল্যের এবং সহজলভ্য কাগজ এবং সাধারণ কালি আর তুলির ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেছেন অপূর্ব শিল্পকর্ম। ক্রোধ, জনরোষ, জনগণের দুঃখ প্রকাশে যে ছবির জুড়ি নেই। বিক্ষোভ ও আবেগে উদ্ধীপ্ত এই সব ছবির শিল্পমান সুউচ্চ। মানবতাবোধ এবং সমাজ সচেতনতা সৃষ্টিতে এই ছবির তুলনা হয় না। নিজস্ব ঐতিহ্য এবং অবেহেলিত শিল্পকে তিনি স্বীয় মেধা ও শ্রম ধারায় করলেন গৌরবান্বিত। এ ক্ষেত্রে তাঁর আঁকা কেশ বিন্যাস, অবসরে তিন বধূ, রমণী যুগল, পাইন্নার মা, সংগ্রাম ছবি উলে­খযোগ্য।
এই সকল ছবিতে বাংলার লোক শিল্পের সহজ সরলীকরণ ও বর্নণামূলক আবেদন প্রোজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। কলসী কাঁধে রমণী, জলকে চলা, অবসরে তিনবধূ, রমণী যুগল, কেশ বন্যাসে রমণী ইত্যাদি ছবিতে লোক জীবন ও লোক শিল্পের প্রভাব সুন্দর ভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। তাঁর এসব ছবিতে লোকজ ধারা এবং গভীর সমাজ সচেতনতার আবেদন লক্ষ্য করা যায়।
বাংলার কষ্ট সহিষ্ণ দুঃখজয়ী মানুষের জীবনের উত্থান পতন ও গতিময়তা নিয়ে তাঁর আঁকা সংগ্রাম ছবিটির কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। এই ছবিটিতে সংগ্রামী শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রামী জীবন ভাষ্য গভীর শ্রদ্ধায় প্রকাশ পেয়েছে। তাদের জীবন চেতনা, একাকিত্ব ও জীবন যন্ত্রণার অভিঘাতের যে আশ্চর্য্য প্রকাশ ঘটেছে তা শিল্পকলার ইতিহাসে বিরল। ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে তাঁর তৈরীকৃত পোষ্টার এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁর প্রতিবাদী চেতনার দুরন্ত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাকে আমরা একজন বিপ্লবী সমাজ সচেতন শিল্পীর অভিধায় অভিসিক্ত করতে পারি নিঃসন্দেহে।
এদেশের শিল্পকলা আন্দোলনে আর এক মহান পুরুষের নাম কামরুল হাসান। বাংলার লোক শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে কামরুল হাসানের গভীর আত্মিক যোগছিল। লোক শিল্প ও লোক ঐতিহ্যকে তিনি তাঁর আত্মার মর্ম মূলে ধারণ করেছিলেন গভীর মমতায়। লোক শিল্প ও সংস্কৃতির পুরোধা পুরুষ ও সংগ্রাহক মহান দেশ প্রেমিক গুরু সদয় দত্তের সাথে কামরুল হাসানের হৃদ্যিক সম্পর্ক ছিল। তাঁর দ্বারায় প্রভাবান্বিত হয়ে তিনি ব্রতচারী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। ব্রতচারী আন্দোলন তাঁর শিল্প জীবনে মারাত্মক ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তাঁর মধ্যে মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর অনুরাগ ও মমত্ববোধের সৃষ্টি হয়। তাঁর খেরো হাতের খাতা বাঙালির শিল্পবিকাশের সুর্বণ দলিল। তাঁর অমর সৃষ্টি তিন কন্যা বা দুই কন্যা মাটি ও মানুষের ভালবাসার চেতনায় সিক্ত। বাংলার লোক শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল দূর্বার। সাধারণ মানুষ এবং গরিব মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহিন ভালবাসার কারণে তিনি লোক শিল্পের বিকাশে এত বড় অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থায় যোগদান এবং ব্রতচারী আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে লোক শিল্পের প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তিনি তাঁর শিল্পকর্মে লৌকিক ধারার সাথে আধুনিক চিত্রশৈলীর মিলন ঘটিয়ে জন্ম দেন নতুন শৈল্পিক শিল্প। তাঁর ছবিতে লোক জীবনের উপাদান পশু, পাখি, নারী, প্রকৃতি বারবার ঘুরে ফিরে উপস্থাপিত হয়েছে অপূর্ব শিল্প কুশলতায়। তিনি সমাজের নানা পরিবেশে গায়ের বধূকে উপস্থাপন করেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। লোক শিল্পের নানা গড়ন ও বৈশিষ্ট্য তার চিত্রকলায় আমরা দেখতে পাই। লোক শিল্পের উজ্জ্বল রং, লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কালো রং এর ব্যবহার তাঁর ছবিতে পরিলক্ষিত হয়। লোক শিল্পের আপন ভাষা তিনি গভীর দক্ষতায় আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলে আমাদের বিশ্বাস। কামরুল হাসান বাংলাদেশের পোড়া মাটি ভাস্কর্য, লোক শিল্প ও পটের জগতকে প্রত্যক্ষ করেছেন গভীর মনোযোগের সাথে। নিজেকে তিনি পটুয়া বলে পরিচয় দিলেও তিনি পটুয়া নন। তিনি জাত শিল্পী। তিনি পটশিল্পের নির্যাস নিয়ে চিত্র এঁকেছেন যুগের সাথে আধুনিক শিল্প ধারার সাযুস্য রক্ষা করে। ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ দানব রূপী ইয়াহিয়ার পোষ্টার একে তিনি আমাদের সচেতন করেছিলেন, আমাদেরকে প্রতিবাদী হতে দীক্ষা দিয়েছিলেন। একুশের রক্তিম ভাষা আন্দোলনে তাঁর কাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের সামনে চলার প্রেরণা দিয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের দেশের একজন খ্যাতিমান শিল্পী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও স্নেহ লাভের সুযোগ হয়েছিল তাঁর শৈশবে। জয়নুল আবেদীন তাঁর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেন অভাবনীয়ভাবে। পিতার সরকারী চাকুরীর সুবাদে বাংলাদেশের নানা শহর এবং গ্রাম দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে। আপন সংস্কৃতি ও মৃত্তিকা সংলগ্ন এই মানুষটির সৃষ্টিশীল কাজের ভিতর আবহমান বাংলার নানা ঐশ্বর্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি তাঁর ছবির ভিতর দিয়ে নিজস্ব অস্তিত্ব খোঁজার তাগিদ অনুভব করেছেন গভীর আগ্রহের সাথে।
‘আমাদের লোকশিল্পই হচ্ছে বাংলাদেশের চিত্রকলার ঐতিহ্য’ জয়নুল আবেদীন এই দীক্ষা তাকে অনুপ্রাণিত করে দারুনভাবে। তিনি বাংলার লোকজ নানা রূপের কাব্যিক প্রকাশ ঘটান তাঁর ছবির ভিতর দিয়ে। ভিতর দিয়ে লোকজ শিল্পের মোহনীয় সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল প্রবলভাবে। তাঁর ছবি আঁকার সৃজনশীল আঙ্গিকে চোখ এড়াবার নয়। তিনি তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে লোকশিল্পের সহজ-সরল প্রকাশটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন গভীর আন্তরিকতার সাথে। তাঁর নানা ছবিতে নির্সগ প্রীতির সন্ধান মিলে। কাইয়ুম চৌধুরীর নির্সগের ছবি দেখলে আলপনার আদল চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর সহজ সাবলীল ছবির অবয়বে প্রকৃতি অবিচ্ছেদ্য ভাবে বিকাশমান হয়েছে। তিনি আজীবন নিজস্ব শৈলী রচনায় সতর্ক ছিলেন।
‘শিল্পকর্ম হচ্ছে প্রেম’ এই মেধাবী উক্তিটি ধারণ করে বাংলার এক মেধাবী সন্তান আমাদের শিল্পকলায় অসাধারণ অবদান রাখেন। তিনি রশিদ চৌধুরী। তিনি তাঁর ছবিতে লোকশিল্পের সরল বিন্যাস, রং ও রেখা ব্যবহারে গভীর যতেœর ছাপ রাখতে সক্ষম হন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-সংস্কৃতির সম্মিলনে নিজ সংস্কৃতির ধারাকে বেগবান করার ক্ষেত্রে তিনি খুবই আন্তরিক ছিলেন। আধুনিক পদ্ধতিতে দেশ শিল্প ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সাধনা ছিল নিরন্তর। সাধারণ জীবনের নারী পুরুষ তাঁর ছবিতে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয়তাকে তিনি অšে¦ষণ করছেন লোকায়তের গভীরে, আন্তর্জাতিক ছবির ভাষার ভিতর দিয়ে। লোকশিল্পের বর্নণামূলক নানা কাহিনী, উজ্জ্বল রং, পুথি আকারে অলংকরণ তাঁর নানা ছবিতে দৃশ্যমান হয়েছে বিচিত্র আলোকে। হাতি, প্রণয়ী যুগল প্রভৃতি ছবি তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায় মুর্তজা বশীরের অবদান গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ যোগ্য। বাংলাদেশের লোক মাধুর্যের প্রতি মুর্তজা বশিরের আকর্ষণ দূর্বার তিনি ইউরোপীয় রীতিকে আশ্রয় করে লোকশিল্পের সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটালেন তার সৃষ্টির ভিতর। বাংলার মাটি ও মানুষকে তিনি ভাল বেসেছেন জীবনের প্রথম বেলা হতেই। গভীর সান্নিধ্য ও স্নেহ পাওয়ার সুযোগ হয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের। লোক শিল্পের সহজ ও সাবলীল প্রকাশ তার নানা কাজের মধ্যে দেখা যায়। বাংলার লোক জীবন, চাষী মজুর, গায়ের বধূ, নৌকা, মাছ ইত্যাদি গ্রামীণ বিষয় নিয়ে তিনি ছবি আঁকেন। বাংলার লোক শিল্পের গঠনগত দিক ‘লাইন’ এবং বড়-বড় আয়ত চোখের আকার তাঁর ছবিতে সগৌরবে দৃশ্যমান হয়। স্মৃতিতে কলকাতা, মা ও শিশু, আগামী দিনের প্রতীক্ষায়, পাখ পাখি হাতে বালিকা এবং পাখি, বালক ও খাঁচার পাখি, উড়ন্ত পাখি ইত্যাদি ছবিতে লোক শিল্পের প্রভাব রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদের উদ্দেশ্যে আঁকা ছবি গুলির মধ্যে তাঁর গভীর আবেগ, দেশ প্রেম ও শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায়। যোদ্ধার আকুতি, দেশ প্রেম, ইত্যাদি বিষয়কে তিনি অভিনব শিল্প সত্বায় উপস্থাপনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি গভীর বুদ্ধি ও মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর শিল্প কর্মে জ্যামিতিক ফর্মের প্রাধান্য দেখা যায়।
গমর জিৎ রায় চৌধুরী তাঁর নানা মেধাবী সৃজনের ভেতর লোক শিল্পের নানা উপাদান কে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্থান দিয়েছেন। লোক শিল্পের প্রতি তার গভীর অনুরাগের প্রকাশ দেখা যাবে তাঁর ছবি বিশ্লেষণ করলে। নানা ঘটনার ভিতর দিয়ে লোক শিল্পের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বাড়তে থাকে। দেশীয় ঐতিহ্য এবং লোক শিল্পকে তিনি নতুন আঙ্গিকে তার চিত্রকলায় সংযোজন করেন। রূপসী বাংলার ষড়ঋতু এবং প্রকৃতির ছন্দময় ও লাবণ্যময়ী পরিবেশ তাকে মন্ত্র মুগ্ধের মত আকৃষ্ট করে। শ্যামল নির্সগ তাঁর চিত্রে উঠে আসে স্বমহিমায়। যাপিত জীবনের বিষাদঘন সুখ দুঃখের স্মৃতি তাকে তাড়া করে তাঁর ছবিতে এসবের জীবন্ত প্রকাশ রয়েছে। লোক শিল্পের খন্ড-খন্ড বিষয় বিজয় দিবস, প্রতীক্ষা, স্বদেশের গান ছবির ভিতর তিনি স্থাপন করেছেন অতীব নিপুনতার সাথে। পশ্চিমা রীতি এবং লোক শিল্পের অলংকারের যুগল মিশ্রনে তিনি প্রজ্জ্বলিত করেন নতুন আলোকমালা। বাংলার লোক শিল্পকে সৃজনশীল আঙ্গিকে রূপায়ন করার ক্ষেত্রে তাঁর শ্রম প্রশংসার দাবী রাখে।
এদেশের আধুনিক শিল্পকলার আন্দোলনে হাসেম খান আর এক উজ্জ্বল নাম। দেশের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি জনগণের গভীর শ্রদ্ধা লাভ করেছেন এবং ধন্য করেছেন নিজেকে।
লোক শিল্প ও লোক সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ প্রকাশ পায় তাঁর ছবিতে নঁকশী কাথার নকশা উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে। এ ক্ষেত্রে গুরু জয়নুল আবেদীন তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পল­ী কবি জসীম উদ্দীনের স্নেহ ও গভীর সান্নিধ্য তাকে লোক সংস্কৃতি ও লোক জীবনকে গভীর ভাবে অনুধাবনের সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি রাজনীতি সচেতন শিল্পী। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তাঁর অনেক চিত্র কর্মে জাতীয়তাবাদী চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে। তিনি নানা প্রচ্ছদ আঁকেন।
যাতে তিনি নকঁশী কাথা ও নকঁশী পিঠার গঠনগত দিক এবং ফর্ম ব্যবহার করেন আশ্চর্য মেধার বিন্যাসে। তিনি বাংলার প্রকৃতি, জীবন ধারা, রাজনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তাঁর চিত্র কর্মে প্রকাশ করেন। বাস্তবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এঁকেছেন নানা ধরণের চিত্র। যাতে লোক শিল্পের নানা লক্ষণ দৃষ্টি গোচর হয়।
তিনি লোকশিল্পের মধ্যে খুঁজেছেন শিল্পের আধুনিক স্বরূপকে। তিনি বাংলার প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক শিল্পকে দিয়েছেন নতুন গতি। তাঁর প্রচ্ছদ ও নানা চিত্র মানুষকে মুগ্ধ করেছে, দিয়েছে অনাবিল আনন্দ। তিনি সমাজ সচেতন মেধাবী শিল্পী। তাঁর নানা ছবিতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ প্রকাশিত হয়েছে নানা ব্যঞ্জনায় এবং বাঙালিকে তাদের জীবন সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছে। দেশকে ভালবাসতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
শিল্পী রফিকুন্নবী বিপুলভাবে পরিচিত এক মেধাবী, মানবতাবাদী ও রাজনীতি সচেতন শিল্পী। বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি ছবি আঁকেন। তাঁর ছবিতে জীবন ধর্মীতার উজ্জ্বল প্রকাশ লক্ষ্য করা হয়। বাংলাদেশের শ্যামল প্রকৃতির নানা উপাদান যেমনÑ নদী, মাছ, ঘোড়া, মানুষ, মহিষ, গরু, কাক, ফেরিওয়ালা, বাউল, নরনারী তাঁর ছবিতে বিচিত্র আলোকে স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছবিতে তিনি দেশ শিল্পকলার রীতির সাথে আধুনিক পাশ্চত্য রীতির সমন্বয় সাধনে আন্তরিক হন। তিনি তার ছবির বিষয়ের প্রয়োজনে লোকশিল্পের অনেক বৈশিষ্ট্যকে মোটিফ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। গ্রাম বাংলার মানুষের সহজ জীবন ও সারল্যকে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লোকজ শিল্পের নীল রং ব্যবহার করেছেন। তিনি ঐতিহ্য সচেতন এবং শিল্প ভাবনায় আন্তর্জাতিক।
একটি স্বাধীন ও ঐতিহ্য মন্ডিত লড়াকু জাতি হিসাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছবির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে উপরে উলে­খিত শিল্পীসহ আরো অনেক নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা মেধা ও গভীর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের মেধাবী সৃজনে আমাদের লোকশিল্প স্থান পাক গভীর মমতা ও অহংকারের সাথে, বিশ্ব সভায় সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এ লেখার ইতি টানছি।


লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, পিরোজপুর।

আলোকিত সমাজ গড়তে ও নিজেকে সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত সাহিত্য সাধনা করুন। রুচিশীল গ্রন্থ, পত্রিকা ও গুণী মানুষদের আত্মজীবনী পড়–ন। সন্তান ও প্রিয়জনদের হাতে ভাল বই ও সাহিত্য সাময়িকী তুলে দিন। পড়তে উৎসাহিত করুন। প্রকৃত সাহিত্যিকরা দেশ ও জাতির সম্পদ, তাদের দ্বারা সমাজের কোন অপকর্ম/ অপরাধ সংঘটিত হয়না।
করোনাকালীন সময়ে ঘরে বসে রুচিশীল বই, পত্রিকা পড়–ন, নিজে লিখতে চেষ্টা করুন।
একজন সৃজনশীল মানুষ পরিবার-সমাজ- তথা দেশের আলোকবর্তিকাসম নক্ষত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *