দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ আর দেশাত্মবোধের সংমিশ্রণে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যদি জাগরিত থাকে, সেই ব্যক্তি পৃথিবীর যে প্রান্তেই বিচরণ করুক না কেন, সে তার স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের আলোকরশ্মি দ্বারা আলোকিত রাখতে সক্ষম হবে নিজস্ব ভুবন টা। বিশ্বে যে সকল দেশে করোনা সংক্রমণ মহামারি ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করেছিলো, সেসকল দেশের প্রতিটি মানুষের স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের প্রভাবেই করোনা মহামারির প্রকোপ থেকে তারা অব্যাহতি পেতে চলেছে। আর আমাদের দেশের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে উচ্চস্তর পর্যন্ত সিংহভাগ নাগরিকের ব্যক্তিত্বে এই স্বচ্ছতার রয়েছে প্রচুর অভাব। আর এরই ফলস্বরূপ আমরা করোনা সংক্রমণের মহামারির দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হচ্ছি। করোনার প্রারম্ভিক পর্যায়টা গল্পের মতো থাকলেও যবনিকাপাত টা উপন্যাসের চিত্ররূপ ধারণ করতে চলেছে।
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের মৌলিক চাহিদা বলতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। করোনার করুণ প্রভাব আছড়ে পড়েছে আমাদের জাতীয় জাীবনের মৌলিক চাহিদার সকল স্তরেই। আমাদের নাজুক অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে দিনে দিনে, তবে তা জোরালোভাবে পরিলক্ষিত হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে। ভিক্ষুক শ্রেণীর উপার্জন আর উচ্চবিত্ত মানুষদের উপার্জনের পথ কখনোই বন্ধ থাকেনা। এরা সব অবস্থাতেই উপার্জন করে দিনাতিপাত করতে পারে, নিজেদের সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে পারে। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো না পারে কারো দারস্থ হতে, না পারে তাদের করুণ দশা সইতে।
উন্নত রাষ্ট্রগুলো যখন লকডাউন দিয়েছিলো তখন তারা অস্বচ্ছল পরিবারের পাশে থেকেছে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে, যাতে লকডাউনের নামে নাচতে গিয়ে ঘোমটা টানা না হয়। লকডাউনে সম্পদশালী ব্যক্তিদের সমস্যা নেই। কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায়, তারা কিভাবেলকডাউন পালন করবে? যাদের সীমিত আয় তারা কিভাবে লকডাউন পালন করবে যথাযথভাবে? এসব ভাবনা মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকার অবশ্য গত বছর লকডাউনে কিছু ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যায়, দুঃখজনক হলেও সত্য সেই ত্রাণের সিংহভাগই তাদের কাছেই মজুদ থেকেছে যাদের তত্ত¡াবধানে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব ছিলো। ঘরে খাবার না থাকলেও, চিকিৎসা ব্যবস্থার অচলাবস্থা চললেও বন্ধ থাকেনি ব্যয়ের খাতগুলো। বিদ্যুৎ বিল, জ্বালানী খরচ, ঋণের কিস্তি, বাসা ভাড়া, এরসাথে তাল মিলিয়ে সকল পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। কিভাবে বাঁচে সাধারণ জনগণের প্রাণ? কিভাবে সম্ভব ব্যয়ের খাত খোলা রেখে আয়ের পথ বন্ধ রাখা? আমাদের দেশের লকডাউন যেনো এক ধরনের সার্কাস, যেখানে শঙ্কা এবং মজা দুটোরই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। লকডাউন শুধুমাত্র গরিবের ক্ষেত্রে, ধনীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে লকডাউন নেই। মার্কেট খোলা রেখে, গার্মেন্টস খোলা রেখে লকডাউন চালু। যাতায়াত ব্যবস্থায় এক পথ খোলা রেখে আরেক পথ বন্ধ করে লকডাউন চালু। সড়ক পথ বন্ধ রেখে নদী পথে যাতায়াতের পন্থা অবলম্বন করে ঈদুল ফিতরের সময় ঘটলো বেহিসেবী প্রাণনাশ। সলিল সমাধিতে জরিপের বাইরেই থেকে গেলো কতো লাশ। গরীব তো এমনিতেই আধমরা, সেসব আধমরাদের প্রতি যতো নিয়মের বাটখারা। ব্যয়ের খাত বন্ধ না রেখে, মওকুফ না করে আয়ের পথে লকডাউন কখনোই সমীচীন নয়। সরকারি হিসেব খাতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঠিকঠাক থাকলেও অর্থনীতির চাকা যে মূলত পাংচার, সেদিকে খেয়াল রাখার সময় কোথায় হিসাবরক্ষকদের।
আবদুলাহ আবু সায়ীদ স্যার তাঁর একটা বক্তব্যে বলেছিলেন- “পৃথিবীটা শাসন করে ই গ্রেডের মানুষ, আর পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখে ঈ এবং উ গ্রেডের মানুষ। অ গ্রেডের মানুষগুলো বাস্তব পৃথিবীর কোনো কাজেই লাগেনা। তারা শুধুই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একটা নির্ঝঞ্ঝাট আরাম আয়েশের জীবন কাটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় আর দশটাজড়বস্তুর মতো। “
করোনার এই প্রবল দুঃসময়ে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বক্তব্যটিও এটাই প্রমাণ করে— “অর্থনীতি টিকিয়ে রাখে গরীব মানুষেরা, ধনীরা নয়।”
অমর্ত্য সেন এই আধমরা খেটে খাওয়া সি আর ডি গ্রেডের মানুষদের কথাই বলেছিলেন। সব মানুষই চাইলেও পারেনা আত্মহত্যা করতে, যদি পারতো আর যদি আত্মহত্যা মহাপাপ না হতো তাহলে হয়তো মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের সদস্যরা আত্মহত্যা করেই এমন করুণ জীবনের সমাপ্তি টানতো। অনেকে এমন করেছে ভবিতব্য না চিন্তা করে। একজন মানুষ মরলে সরকারি আদমশুমারী খাতায় জনসংখ্যা একজন হ্রাস পাবে, কিন্তু একটা পরিবার হারায় তার প্রিয়জন ও প্রয়োজন। কেউই তাদের প্রিয়জন হারাতে চায়না, কেউই সাধের জীবনটা স্বেচ্ছায় নিঃশেষ করতে চায়না। আনুষাঙ্গিক সবকিছুই নিজের অধীনে থাকলে, লকডাউনটা সবাই উপেক্ষা না করে উপভোগ করতো।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণের ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় স্বরূপ এই লকডাউন যেনো বারে বারে ফিরে না আসে সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যে কোনো কাজে নিয়মটা কঠোরভাবে পালন করলে শাস্তির কঠোরতা প্রয়োজন হয়না। তাই পরবর্তীতে যেনো আবারো কঠোর লকডাউন দিতে না হয়, সরকারকে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। প্রশাসনকে সকল নিয়ম বুঝিয়ে দিয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে দিতে হবে, সেক্ষেত্রে কোনো আত্মীয়করণ চলবে না। যতো উচ্চ মর্যাদার মানুষ হোক না কেন, নিয়ম লক্সঘন কেউই করতে পারেন না সেই সক্ষমতা প্রশাসনকে দিতে হবে। নিম্ন আয়ের প্রতি পরিবারে দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই এবং সরবরাহের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে সেনাবাহিনীর অধীনে। কোনো নেতাকর্মীর দায়িত্বে ত্রাণ (অর্থ বা অন্ন) অর্পণ করা যাবে না। ব্যয়ের খাত যেমন- সবরকমের বিল, কিস্তি এসব মওফুক করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতনতা পালন করতে হবে। দেশের বাইরে যাওয়া এবং আসার ভ্রমণ পথ একমাস বন্ধ থাকবে। দেশের উন্নয়ন খাতে এবং প্রয়োজনীয় সকল স্তরে কঠোর সচেতনতা বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। একটি মাস যেন কঠোর সচেতনতায় সরকার জনগণের সার্বিক দায়িত্ব নিয়েলকডাউন পালন করেন। লকডাউন পরবর্তীতে সকল অবস্থায় জনগণ নিয়ম মেনে চলবে এমন সচেতন কঠোরতার উদ্যোগ নিলে, আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকাও আবার ঘুরতে শুরু করবে। যেমন শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি করোনার জননী দেশ চীনও। তারা সবাই সচেতনতার সাথে কাজ শুরু করেছে বলেই তাদের অর্থনীতি থেমে রয়নি। আমাদের দেশেও নির্দিষ্ট দূরত্বে দূরত্বে স্যানিটাইজার, জীবানুনাশক, মাস্ক ব্যবস্থা রাখতে হবে প্রশাসনিক দায়িত্বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী করোনা কখনোই নির্মূল হবে না। সর্বক্ষেত্রে সার্বিক সচেতনতা সর্বদাই বহাল রাখতে হবে, কখনোই সচেতনতার ব্যাপারে জনগণ যেনো উদাসীন দৃষ্টিকোণ না রাখে সে ব্যাপারেও সতর্ক রাখতে হবে।
অনেকেরই স্বপ্ন থাকে মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার। সব মানুষকেই শিক্ষকের দারস্থ হতে হয় শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে, হোক সে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মন্ত্রী-মিনিস্টার। তাইতো শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। দুঃখের বিষয় হলো এই পেশাতে নিয়োজিত হওয়ার পর শিক্ষকের মানসিক সেই উৎফুলতা আর টিকে থাকেনা নানা প্রতিকূলতায়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমনিতেই কোমর ভাঙা, তার উপরে করোনার এই ভয়াল হানা। করোনার প্রকোপ বাড়তে দেখে ২০২০সালের মার্চ মাসে শুরু হলো প্রথম লকডাউন। এই লকডাউন টা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিলো বিভিন্ন মহল। সেবার লকডাউনে অনলাইনে ক্লাস করার বিষয়টা ছাত্রশ্রেণীর জন্য বানরের গলায় মুক্তোর মালা পরানোর মতো বেমানান হয়ে গিয়েছে। অনলাইন ক্লাস করার মতো প্রযুক্তিক মানসিকতার আধুনিক এখনো আমরা হতে শিখিনি। তাই শিশু থেকে শুরু করে যুব সমাজের নানারূপের অধঃপতন পরিলক্ষিত হতে থাকলো। যার প্রভাব কাটানো খুব সহজসাধ্য বিষয় নয় অভিভাবকদের জন্য। সমাজ তথা সারা দেশব্যাপী নানারকম অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে গিয়েছে যুব স¤প্রদায়। তারপর শুরু হলো ক্লাসের এসাইনমেন্ট। ছাত্র শ্রেণীকে নকলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সমতুল্য হলো এই এসাইনমেন্ট।
দেশ জুড়ে নেটওয়ার্ক সার্ভিস ঠিকঠাক চালু নেই, সব পরিবারের সামর্থ নেই অনলাইন ক্লাস করার মতো ফোন বা খরচ চালানোর। একারণেও ঘটেছে অনেক অঘটন। যুবকেরাঅনলাইনে ক্লাস না করে মেতেছে বাজে মানসিকতায়, এর ফলে ঘটেছে অনৈতিক অঘটন। কিশোরেরা অনলাইনে ক্লাস বাদ দিয়ে মজেছে ভিডিও গেমস এ। যার ফলে পারিবারিক কলহ-বিবাদ সহ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়েছে সমাজ। এতো কিছুর মাঝেও পরীক্ষা পদ্ধতি টা চালু থাকলে অন্তত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে হবে এই মানসেই পড়াশুনা করতো। সেক্ষেত্রেও তাদের প্রস্তুতিতে পক্ষাঘাত করা হলো, সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলো “অটোপাশ”। আমাদের বিকলাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই হয়ে গেলো অথর্ব। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার সিংহ দুয়ারে মহামূল্যবান বাস্তব সত্য কিছু কথা লিখা আছে, একটি দেশের সার্বিক অবক্ষয়ের কারণ নির্ণয় করা যায় কথাগুলো মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করলে। “কোনো জাতিকে ধ্বংস করারা জন্য পারমানবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সে জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা দালানকোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে এবং অর্থনীতিবিদদের দ্বারা আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এছাড়া বিচারকদের হাতে বিচার ব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির বিলুপ্তি।”
শিক্ষা-সংকট উত্তরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের কঠোর দাবি। করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারির প্রাদুর্ভাবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে আজ অবধি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জীবন যাপন। শিকলবিহীন বন্দিদশায় থাকতে থাকতে বিষন্নতা গ্রাস করছে ছাত্র সমাজকে, এমন কি শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সদ্য শিক্ষাঙ্গন চেনা শিশুদের শিখন কৌতুহল দমিত হয়েছে, তাদের মনে মুখে প্রশ্নবান- স্কুল কি আর কখনো খুলবে? আমরা কি আবারো স্কুলে যেতে পারবো? বিষন্নতার আগ্রাসনে আত্মহত্যা প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মাঝে।
শিক্ষা মানুষকে উন্নত করে, বিবেককে জাগ্রত আর মনুষ্যত্বকে করে আলোকিত। তবে অবশ্যই সে শিক্ষাকে হতে হবে সুশিক্ষা। সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ শুধু নিজের নয়, গোটাদেশ ও জাতির উন্নয়নে সহায়ক হয়। বিদ্যা অর্জন করতে হয় পাঠ্যপুস্তক থেকে, যা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রয়োজন। আর শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় পুরো জীবন পুস্তিকা থেকে, যার সূচনা হয় নিজ আবাসনে। জীবনের প্রতিটা চরণে, প্রতিটা পদক্ষেপে আমরা নতুন নতুন শিক্ষা অর্জন করি বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এ কারণেই দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করার পরামর্শ মানবের তরে। “শিক্ষিত” বলতে কি আমরা শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জনকেই বুঝবো? শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জন নয়, সুশিক্ষা অর্জন হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। যা দ্বারা পরিবার-সমাজ-দেশ তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কল্যাণ সাধিত হবে। প্রকৃত শিক্ষা মনুষ্যত্বকে উন্নত করে, বিবেকবোধ কে জাগ্রত করে। যে শিক্ষায় মনুষ্যত্বের উন্নয়ন নেই, বিবেকবোধে জাগরণ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। উন্নত সার্টিফিকেট আছে কিন্তু বিবেকবোধ নেই, এমন উচ্চ সার্টিফিকেট দ্বারা বড় পদবী অর্জন হয় ঠিকই কিন্তু সার্বিক কল্যাণ সাধিত হয়না। নিজ পরিবারে আদর্শের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা একটা সুসন্তান যখন বিদ্যালয়ের অঙ্গনে পৌঁছায়, তখন সে আদর্শ শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে নিজের জ্ঞান কে আরো বিকশিত করে তোলে, শাণিত করে তোলে। যেমন করে একজন ইঞ্জিনিয়ার একটা মজবুত ভিত্তিতে বিল্ডিংয়ের সুন্দর অবকাঠামো নির্মাণ করে, সেটাকে চাকচিক্যময় করে নজর কাড়া সৌন্দর্যে গড়ে তুলতে পারে।
বর্হিবিশ্বের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই, সব দেশেই শিক্ষকদের বেতনভাতা সম্মানজনক স্থানে এবং তাঁদের মর্যাদাও সন্তোষজনক। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ গড়ার কারিগরেরা যেনো কপাল পোড়া, না আছে তাঁদের যথোচিত সম্মান না আছে সম্মাননা। শুধুমাত্র সরকারি শিক্ষকদের তাঁদের জীবনযাত্রার জন্য বাড়তি দুশ্চিন্তায় কালযাপন করেন না। কারণ সরকারি সকল কর্মচারি-কর্মকর্তাদের বেতনভাতা প্রায় প্রায়ই বর্ধিত করা হয়, যাতে করে মন্ত্রী-মিনিস্টারদের বেতনভাতায় টানাপোড়েন সৃষ্টি না হয়। এদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাড়াও যেসব মানুষ বাস করে, আর এসব সাধারণ মানুষদের রক্ত চুষেই সরকারি চাকুরিজীবীরা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারার জন্য বেতনভাতা বর্ধিত করা হয়। এসব সাধারণ মানুষদেরও যে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার আছে তা হয়তো খেয়ালের বাইরে থাকে নীতিনির্ধারকদের। তেমনি বেসরকারি এম পি ও ভুক্ত এবং নন এম পি ও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও যে সম্মানআছে, তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার কথা মস্তিস্কের বাইরে রাখেন নীতিনির্ধারকেরা। সরকারি শিক্ষক এবং অন্যান্য সকল শিক্ষকেরা একই পরিশ্রম করেন শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। তবুও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের গ্যাঁড়াকল। এদেশে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো সরকারি অনুমোদনের আদলেই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের পেছনে নিজের শ্রম ব্যয় করছেন নিজেরই পকেট থেকে খরচ জুগিয়ে। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এম পি ও ভুক্তিতে না নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকিতে রেখেছেন দেশের পরিচালকগণ। তাদের মানবেতর জীবন নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সরকারের, উল্টো নানারকম মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় এসব হতভাগ্য শিক্ষকেরা। এবারের বাজেটেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ বেশিরভাগই বিলাসিতার অংশে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, নতুন করে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এম পি ও দেয়া হয়নি নিম্ন অযুহাতে। চির স্বাধীন, সম্পদবিহীন ব্রিটেন সূর্যাস্তবিহীন রাজ্যশাসন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলো মেধা আর শিক্ষা দিয়ে। ইতিহাস বলে দেয় পৃথিবীর যে দেশ যতো বেশি শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে, সেই দেশ ততো বেশি উন্নতির সোপান গড়েছে।
দেশব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য দূরীকরণ অত্যাবশ্যক। শিক্ষকদের পদমর্যাদা, বেতনভাতা সম্মানজনক স্থানে আনতে হবে। বেতনভাতা ঠিকঠাক থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি হওয়ার সম্ভাবনা কম হবে, প্রয়োজনে বদলির ব্যবস্থা করে হলেও এসব বৈষম্য বিমোচন প্রয়োজন। অযথা বিলাসিতায় অর্থ ব্যয় না করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, এতে যুব স¤প্রদায়ের অপরাধ প্রবণতার হার কমবে। শিক্ষকদের মর্যাদাসম্পন্ন বেতনভাতা থাকলে কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্য চালিয়ে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হতে হবেনা। গত বছর লকডাউন পালন শেষে কিছুদিনের পর্যবেক্ষণ শেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সচেতনা বৃদ্ধি করলে, পাবলিক পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের স্বশরীরে অংশগ্রহণের সুযোগ দিলে অন্তত শিক্ষা ব্যবস্থা সচল থাকতো। প্রতিটা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের দুইভাগে ভাগ করে প্রতি গ্র“প সপ্তাহে দুদিন ক্লাস করার ব্যবস্থা করা যেতো। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকথেকে স্যানিটাইজার এবং মাথা থেকে পা অব্দি জীবাণুনাশক ব্যবস্থা, মাস্ক ব্যবহার এবং যাতায়াতের পথে নির্ধারিত দূরত্বে এমন সচেতন ব্যবস্থা চালু করলে শিক্ষা সহ অর্থনীতির কোনো খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হতোনা। পরীক্ষা কেন্দ্র অনেক সময় দূরে হওয়ায় পাবলিক পরীক্ষাগুলো নির্ধারিত কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত না করে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত করা যেতো, সেক্ষেত্রে শিক্ষকগণকে কাছাকাছি দূরত্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অদলবদল করা যেতো।
চলে যাওয়া সময়কে যেহেতু ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তাই পেছনের জন্য হাহুতাশ না রেখে পেছনের ভুল পদক্ষেপগুলোকে সামনে আর ঘটতে না দেওয়া সমীচীন হবে। আমাদেরকে সচেতনতায় কঠোর হতে হবে প্রতি পদক্ষেপে। কারণ করোনার এই তান্ডব কোনোকালে শেষ হবে এমন গ্যারান্টি নেই। যেহেতু করোনাকে বিতাড়িত করা সম্ভব নয়, তাই সচেতনতার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ কে আমরা এড়িয়ে চলতে পারি। শুধুমাত্র সচেতনতার দ্বারাই করোনাকে রোধ করা সম্ভব এবং এই সচেতনতার পথ ধরেই বিশ্বের সেসব দেশ উৎড়িয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে করোনার নতুন সংক্রমণ থেকে, যেসব দেশ করোনা মহামারিতে মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছিলো। তারা তাদের শিক্ষা কর্যক্রমকে স্থবিরতা মুক্ত করে সচল গতিতে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছে, আমরাও সচেতন সচেষ্টতা দ্বারা সক্ষম হতে পারবো ইনশালাহ।
দেশে যতোগুলো নন এম পি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো এম পি ও দেওয়ার জন্য যেসব বাহুল্য এবং নিম্নমানের নিয়ম জারি করা হয়েছে, সেসব প্রত্যাহার করে প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এম পি ও ভুক্ত করা হোক। তিনটি ভাগে ভাগ করে এম পি ও দিলেও তিন বছর সকল বেকার শিক্ষক তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা পাবে। প্রথম বছরে ১০ বছরের বেশি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, দ্বিতীয় বছরে পাঁচ বছরের বেশি সময় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং শেষ পর্যায়ে বাকি নন এম পি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এম পি ও দিলে আর কোনো বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাশ্রম বিলানো শিক্ষক থাকবে না দেশে। আরো একটা নিয়ম বাংলাদেশে চালু করা অত্যাবশ্যক সেটা হলো, দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টার-সচিব কারো সন্তান বাইরের দেশে পড়তে যেতে পারবে না। সকলের সন্তানই দেশের গন্ডিতে লেখাপড়া শেষ করে তারপর বিদেশে যাবে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে।
( মাসিক অনন্য কথা পড়–ন, স্বজন প্রিয়জনদের পড়তে উৎসাহিত করুন। আপনার সৃজনশীল লেখাটি পত্রিকা দপ্তরে ইমেইলে প্রেরণ করুন। আপনার মূল্যবান মতামত, সুস্থ সমালোচনা আমাদের পথ চলার প্রেরণা।
মাহফুজ আলী কাদেরী, সম্পাদক, মাসিক অনন্য কথা, আতাইকুলা রোড, শালগাড়িয়া, পাবনা।)