কাজী নজরুল ও তাঁর সাহিত্য-সঙ্গীত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে বহু পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। গানের স্বরলিপির বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে জীবন আলোচনা-স্মৃতিকথা সঙ্গীত বিষয়ে, কিশোরদের বিষয়ে নজরুলের লেখা ৪৯টি বই, এই সংখ্যার মধ্যে রয়েছে ইংরাজিতে তিনটি বই। বাংলাদেশে প্রকাশিত পুস্তক সংখ্যা ৮১, তার মধ্যে ইংরাজিতে ৭। হিন্দী ও উর্দুতেও কয়েকটি বই বার হয়েছে। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি ৬ খন্ডে নজরুল রচনাবলী প্রকাশ করেছে। যা দুই বাংলায় একমাত্র নির্ভরযোগ্য নজরুল রচনার সংগ্রহ। প্রকাশিত বইয়ের এই সংখ্যা থেকে বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে নজরুল চর্চা আগ্রহের সঙ্গে চলছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুলকে ব্যাখ্যা করার বা বোঝার চেষ্টা চলছে। তাঁর গানের দিক নিয়েও আলোচনা চলছে। দুই বাংলায় প্রায় চলিশটি স্বরলিপির বই প্রকাশিত। সংখ্যাটি আরো বেশি হতে পারে। নজরুল গীতির স্বরলিপি করেছেন প্রায় ত্রিশজন। এই ক্ষেত্রেও সংখ্যা আরো বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নজরুল গীতির শিল্পীদের যে সংখ্যা পাওয়া গেছে সেই সংখ্যা প্রায় তিনশ’ মতো। যারা নজরুল গীতির গানের রেকর্ড, ক্যাসেট করেছেন, এবং নিয়মিত আকাশ বাণীতে নজরুল গীতি গেয়ে থাকেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, কাজী নজরুল বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতে এক প্রাণবান শক্তি। দেশ যখন যুদ্ধের সম্মুখীন হয়, অথবা সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হয়, তখন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রবীন্দ্র-নজরুলকে স্মরণ করা হয়। তাঁদের কবিতা আবৃত্তি ও গান গেয়ে দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করা হয়। তাঁদের গ্রন্থ থেকে পাঠ করে পথের নির্দেশ জানানো হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলেও রবীন্দ্রনাথের পরে নজরুলই বাঙালির প্রাণ-শক্তি যোগায়। নজরুলের প্রাণশক্তি আছে বলেই রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থের পরেই বিক্রয়ের দিক থেকে নজরুল পুস্তকের স্থান। বাংলার ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথের বই যেমন থাকে, নজরুলের বইও থাকে।
রবীন্দ্রনাথের মতো নজরুল বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এবং চিন্তাধারা বিকাশের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। দুইয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যেমন বাংলার যুবশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছে, দেশের মুক্তির জন্যমৃত্যুপণ সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিয়েছে, তেমনি তাঁর শিকল ভাঙার গান, তাঁর সাম্যের গান ও কবিতা নতুন চিন্তাধারায় উজ্জীবিত করেছে। সাম্যবাদের চিন্তার সূচনায় কাজী নজরুলকে বলা চলে এদেশে সাম্যবাদের প্রভাতের পাখি। তিনিই প্রথম সাম্যবাদের গান গেয়েছেন। সাম্যবাদের চিন্তায় বিপ্লবী যুব সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছেন। শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে সঙ্গীত-ভাষা জুগিয়েছেন। বাংলার এক ছবি কবি ‘আন্তর্জাতিক সঙ্গীত’ অনুবাদ করে বিশ্বÑ শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর সংহতি জাগিয়েছেন এটা কি কম কথা? সেই গর্ব কেবল নজরুলের নয়, বাংলার প্রত্যেক শ্রমজীবি মানুষের। বালেশ্বরে যতীন মুখার্জীর সশস্ত্র সংগ্রাম, মৃত্যুঞ্জয়ী যতীন দাসের দধিচীর মতো আত্মদান, ক্ষুদিরামের ফাঁসির মতো জাতীয় নব-ইতিহাস রচনাকে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী সংগ্রামকে তিনি ছাড়া কে সাহিত্যে-সঙ্গীতে ধরে রেখেছেন। বিপ্লবী যুব শক্তির সেদিনের আত্মদানের কথা তাঁর সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিতে হয়েছিল, আজো সেই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার কথা তাঁর সঙ্গীতে প্রতিধ্বনি হয়, ‘আমি রক্ত নিশি-ভোর একি এ শুনি ওরে মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খলে। এ কারাবাসে মুক্তি হাসি হাসে টুটেছে ভয় বাধা স্বাধীন হিয়াতলে’।
তিনের দশকের বাঙলার মৃত্যুপণ বিপ্লবীদের সংগ্রামের গীতিকার, সাম্যবাদের প্রভাতের পাখি নজরুলকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে বর্তমানে চেষ্টা চলছে প্রেমগীতি ও ভক্তিগীতি অথবা কেবলমাত্র সুর-জগতের নজরুলকে টিকিয়ে রাখার। যারা নজরুলকে বিকৃত করতে চান তাঁদের ‘বিদ্রোহী কবি’ কথাটিতেও আপত্তি। নজরুলের গণসঙ্গীতে তাঁদের অনিহা। এই আপত্তির সরল অর্থ নজরুলের রাজনৈতিক পরিচয় মুছে দেওয়া। আরো স্পষ্ট করে বললে কুড়ির দশকের নজরুলের বিপ্লবী রাজনৈতিক বা সাম্যবাদী সত্তাকে অস্বীকার করে কেবল গ্রামোফোন কোম্পানীর নজরুলকে তুলে ধরা। কিন্তু এতে তো নজরুলের পূর্ণরূপ পাওয়া যাবে না, সম্পূর্ণ নজরুলকে পাওয়া যাবে না। যারা এই বিকৃতি করতে চান তাঁরা শ্রেণীস্বার্থে এই কাজটা করেন, শ্রেণী সংগ্রামের চেতনা সমৃদ্ধ কবিতা ও গানগুলিকে পেছনে ঠেলে দিতে চান। আমাদের কর্তব্য হবে সম্পূর্ণ নজরুলকেপ্রকাশ রাখা। আমরা তাঁর শেকল ভাঙার গান যেমন গাইব তার সঙ্গে সাম্যের গানও গাইব, তাঁর জাতীয় বন্দী মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণামূলক লেখাগুলি পাঠ করবো, তার সঙ্গে সাম্যবাদী রচনাও পাঠ করবো। নজরুলের প্রতি জাতীয় স্বীকৃতি এবং তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ এই গান, কবিতা ও প্রবন্ধগুলি। সুতরাং নজরুলকে সামগ্রিকভাবে অনুভব করতে চাইলে এগুলি বাদ দেওয়া যায় না। নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ অস্বীকার করা যায় না।
নজরুলের সৃষ্টি যখন উচ্চমার্গে তখনো নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক ও নানা রটনার শেষ ছিল না। নজরুল যখন অসুস্থ তখনো তাঁকে নিয়ে এবং তাঁর রোগ নিয়ে নানা রটনা চলেছে। নজরুলের মৃত্যুর পরেও রটনা, ভিত্তিহীন প্রচারণা এবং বিকৃতির শেষ হয়নি। যদিও মুজফফর আহমদের মতো নজরুল সুহৃদ লিখেছেন নজরুলের গানের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। তথাপি কোন কোন বুদ্ধিমান বলে থাকেন, এই সংখ্যাটি প্রচার মাত্র, আসলে এত গান তিনি লেখেননি। জনৈক প্রবীণ সাংবাদিক খুব জোর দিয়ে এক সভায় একথা বলেছেন। তার সঙ্গে বলেছেন নজরুল হয়তো হাজার দু’হাজার গান লিখে থাকতে পারেন, বাকি গানগুলি নজরুলের নামে চালানো হয়। রাজ্য সঙ্গীত একাডেমী’তে গবেষণালব্ধ তথ্যে নজরুলের ৩২৩৭ টি গানের সন্ধান পাওয়া গেছে। আরো অনুসন্ধান করলে তিন শতাধিক গানের সন্ধান পাওয়া যাবে মনে করা চলে। তাঁর লেখা গান অন্যের নামে চলছে এই প্রমাণও আছে। আর এক প্রচার চলেÑ নজরুল নাকি গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন অন্যে। এই প্রচারও ভিত্তিহীন। এই ভিত্তিহীন কথাটি অনেকে সভাতেও বলে থাকেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে নজরুলের ৩২৩৭ গানের মধ্যে ৩৬০টি গানে অন্যের সুর সংযোজিত। তার মধ্যেও কথা আছে, নজরুল সুরের কাঠামো করে দিতেন, কখনো সুর নির্দেশ দিতেন, ট্রেনার অলঙ্করণ করছেন। এরকম ট্রেনারদের মধ্যে চিত্ত রায় একথা স্বীকার করেছেন। চিত্ত রায়ের পুত্র রতন রায় এক প্রবন্ধে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। বলা হয় কমল দাশগুপ্ত নাকি পায় সহস্র নজরুল গীতিতে সুর দিয়েছেন, অথচ তথ্যে পাওয়া যাচ্ছে তিনি ১৫৪টি গানে সুর দিয়েছেন তাঁর পরের স্থান নিতাই ঘটক ও চিত্ত রায়ের। কমিক গানে সুর দিয়েছেন রঞ্জিত রায়। সুর প্রয়োগ সম্পর্কে ভিত্তিহীন প্রচারের সঙ্গে চলছে নজরুল গীতির বিকৃতি। দেখা যাচ্ছে নজরুলের সুরে যে গানগুলি আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, কমলা ঝরিয়া ও বহু কৃতী শিল্পী রেকর্ড করেছেন, সেই গানগুলি বর্তমানে নবীন শিল্পীরা গাইছেন সুর তাল বদল করে। কোন ক্ষেত্রে গায়কী পরিবর্তন, কোন স্থলে রাগরাগিনীর পরিবর্তন। বহু ক্যাসেট বার হয়েছে নজরুলের সুর পরিবর্তন করে। ফলে এমন অবস্থা ভবিষ্যতে হতে পারে যখন ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, সিদ্ধেশ্বর মুখার্জী, নিতাই ঘটক, নীলিমা বন্দোপাধ্যায়, যুথিকা রায়, সুকুমার মিত্র, কল্যাণী কাজী, শঙ্করলাল মুখার্জী ছাড়া শুদ্ধভাবে নজরুলগীতি গাইবার কেউ থাকবেন না পশ্চিমবঙ্গে। সুর বিকৃতির দরুণ নজরুল-গীতির ক্ষেত্রে বড় দুর্দিন আসছে। যদিও নজরুলগীতির জনপ্রিয়তা এখনো উর্ধ্বমুখী।
এইরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার একমাত্র সংস্থা ‘রাজ্য সঙ্গীত একাডেমী’। দুঃখের বিষয় এবিষয়ে সঙ্গীত একাডেমী যথেষ্ট সচেতন নয়। একাডেমী লক্ষ-লক্ষ টাকা ব্যয় করে, কিন্তু নজরুলগীতির শুদ্ধতা রক্ষার মতো কর্মসূচী গ্রহণ করে না। নজরুলের সহযোগী এবং তাঁর কাছে গান শিখেছেন এমন শিল্পীদের দিয়ে গানের ক্লাস করান না, নজরুলের বিশেষ কিছু গান যেমন নবরাগ ইত্যাদির সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। ফলে এসব গানের সুর হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। নজরুলের গীতি নাটিকার কিছু কিছু গানের সুর এখন পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে কয়েকটি গীতি আলেখ্যের অনুষ্ঠান করা যায় না। এমন কয়েকটি গান আছে যে গানগুলির নজরুলের দেওয়া সুর হারিয়ে গেছে, পরবর্তীকালে অন্য কেউ সুর দিয়েছেন। এসব সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া রাজ্য সঙ্গীত একাডেমীর কার্যসূচীর মধ্যে থাকা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে নজরুল চর্চার কয়েকটি সংস্থা আছে। কিন্তু এই সংস্থাগুলি কবির জন্মদিনে ও প্রয়াণ দিনে গান-আবৃত্তির অনুষ্ঠান মাত্র করেন। নিয়মিত সঙ্গীত-শিক্ষার ব্যবস্থা, কবির জীবনাদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন না। কয়েক বছর আগে রীতি প্রচলিত ছিল অনুষ্ঠানের পূর্বে কোন বিদগ্ধ বক্তার নজরুল সম্পর্কে আলোচনা। বর্তমানে সেই রীতি প্রায় উঠে গেছে। নজরুল তিনটি পূর্ণাঙ্গ নাটক ও তিনটি শিশু নাটিকা লিখেছিলেন। নাটকগুলি পেশাদারী নাট্যমঞ্চে নিয়মিত অভিনীত হয়েছিল। কিন্তু তিনের দশকের পরে তাঁর নাটকের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত। শিশু নাটিকা তিনটির মধ্যে দু’টি প্রায় ৬০ বছর পরে রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে সদন কমিটির সৌজন্যে। দুঃখের কথা যে পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের সামগ্রিক রচনাবলী সুসম্পাদিত হয়ে এখনও প্রকাশ হয়নি।
সংগ্রামে প্রেমে-ভক্তিতে নজরুল আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। প্রতিদিনের জীবনে নানাভাবে তাঁর কবিতা, গান ও প্রবন্ধের কথাগুলি মনে জাগে।