যুগে-যুগে কালে-কালে নারীকে ঘিরেই সমাজ-সংসার গড়ে উঠেছে, বিস্তার লাভ করেছে। এদিকে পুরুষ যুদ্ধ করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, দিগবিজয় করেছে। নারী রাজ্যের ভালমন্দ দেখেছে, প্রতিপালন করেছে সন্তান, পরিচর্যা করেছে ফসলের ক্ষেত। এ জন্য সমাজের বুকে নারীর দৃপ্ত পদচারণা দেখা যায়। অর্থাৎ প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, নারী-পুরুষ হাতে হাত মিলিয়ে ক্রমশ মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আবার আদিবাসী সমাজে দেখা যায়, নারী কাজ করেছে ঘরের বাইরে, পুরুষ কাজ করেছে গৃহে। পরবর্তীতে পুরুষ শাসিত সমাজে ক্রমে নারী হলো গৃহবন্দী। নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা হলো ভূলুণ্ঠিত-পদদলিত। হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজে ‘ক‚ল রক্ষার’ কথা বলে এক পুরুষ সাত রমণীকে বিয়ে করার অধিকারও পেল, যা আমরা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসে দেখতে পাই।
বাংলাদেশের নারী মুক্তি আন্দোলন এবং বর্তমানে এই আন্দোলন কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তার বিচার-বিশ্লেষণ করে তাকে চিহ্নিত করতে হবে। এদেশের নারীরা একটি রক্ষণশীল পুরুষশাসিত জীবন-যাপন করে। দেখা যায় গৃহের সংকীর্ণ পরিসরের বাইরে এসে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারা কাজ করলেও তাদের জন্য আইন-কানুন, রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে মহিলাদের গৃহবন্দী করার চেষ্টা চলছে অহরহ। এই বন্দী দশাকেই পর্দার শাসন বলে অভিহিত করতে চান পুরুষ শাসিত সমাজ। এ জন্যই সমাজে মহিলাদের অবস্থান অধঃস্তন পর্যায়ে রয়েছে।
আজকের এই পৃথিবীতে প্রাচীনকাল থেকে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা বরাবর এগিয়ে এসেছেন। এমনকি অশিক্ষিত নারীদের মধ্যেও দেখা যায় তারা কায়িক শ্রম দিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করছেন। তারপরও নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
একসময় ঢাকার তৈরি উচ্চমান সম্পন্ন অতি সুক্ষè মসলিন বস্ত্র সমগ্র বিশ্বে প্রসংশিত হয়েছিল। পরিবার ভিত্তিক মসলিম তৈরিতে মহিলা কারিগরদের অবদান কিন্তু কম ছিল না। বর্তমানে ঢাকার ডেমরার ওপারে রূপগঞ্জ এ যে কয়েকটি গ্রামে জামদানি তাঁত শিল্প রয়েছে, এবং ঢাকায় যে বর্ণাঢ্যজামদানি প্রদর্শিত হয়ে থাকে, তা এদেশেরই নারী পুরুষের মিলিত প্রচেষ্টার অসামান্য সৃজনশীলতা। যা কিনা দেশি-বিদেশি মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করছে। অথচ এসব কাজে পুরুষ কারিগররা যে মজুরী পায় মহিলা কারিগররা পায় তার অর্ধেক। কোন কোন সময় পরিবারের অংশগ্রহণকারী মহিলা বিনা পারিশ্রমিকে এসব কাজ করে থাকে। দেখা যাচ্ছে মহিলাদের ভাগ্যের মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ঢাকার শাঁখারী বাজারের শঙ্খের অলঙ্কার, রায়ের বাজারের মৃৎশিল্প প্রভৃতিতে পুরুষের সঙ্গে মহিলার অংশগ্রহণ থাকলেও তাদের শ্রমের কোন মূল্য নেই।
এদিকে পেশাজীবি মহিলাদের নিজেদের পাশাপাশি গৃহকর্ম ও শিশু সন্তানদের দেখাশুনার জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রে মা, শাশুড়ি অথবা গৃহপরিচারিকার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। এ সমাজে পুরুষ সাধারণত গৃহকর্মে কোন প্রকার সাহায্য করেনা। অথচ সংসারের মাকে বাইরে যেমন শ্রম দিতে হয় তেমনি ঘরেও শ্রম দিতে হয়। সে মা যত উচ্চশিক্ষিত কিংবা যত অধিক আয় করুন না কেন।
স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সংবিধানে ‘নারী-পুরুষের সমঅধিকারের নীতি ঘোষিত হওয়ার ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অধিকার বঞ্চিত, অবহেলিত ও শোষণের শিকার নারী গোষ্ঠির অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনগত ভিত্তি রচিত হয়। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৭৫ সালকে “নারী বর্ষ’, ১৯৭৬-১৯৮৫ সাল সময়সীমাকে ‘নারী দশক’ ঘোষণা করার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশে নারী সমাজের অবস্থা ও অবস্থানের অনুক‚ল পরিবেশ পেয়েছে। ফলে শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, সমাজসেবা প্রভৃতিতে নারীর ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। তারপরও দেখা যায় সমাজের কতিপয় নারীরা আজও শৃঙ্খলিত-অবহেলিত।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় পুরুষদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে তাদের জননী ও স্ত্রীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় অবিভক্ত ভারতের প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর মাতা বি-আম্মা বেগম পুত্রদের রাজনীতিতে উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন। এভাবে বহু মহিলা সংসারের গন্ডির ভেতর আবদ্ধ থেকেও স্বামী-পুত্রদের প্রেরণা ও সহযোগিতা করে আসছেন।
আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন এবং আরও অনেক সংগঠন নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও সংসারে নারীর
নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। ১৯৯৫ সালে বেইজিং সম্মেলনে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমতা রক্ষার বিষয় নিয়ে ঝড় উঠেছিল। একই বছরে কোপেনহেগেন ও কায়রোতেও নারীদের সামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে সেমিনার ও আলোচনা হয়। হিউম্যান রাইটস ও মানবাধিকার সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ভিয়েনা, আম্মান, জাকার্তা ডাকার প্রভৃতি দেশে প্রচুর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়েই প্রাধান্য লাভ করেছিল। এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী নারী শিক্ষা, নারী শ্রম ও নারীর অধিকার নিয়েই সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বেশ চিন্তা-ভাবনা করছে।
সমাজ ও কর্মজীবনে সবক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং নারীবাদী আন্দোলনে কেবল মেয়েরাই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সব দেশেই অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজতত্ত¡বিদসহ সকলেই একমত যে, বিশ্বের অর্ধেক জনশক্তি অর্থাৎ মহিলাদের অংশগ্রহণ ব্যতিত কোন দেশ বা জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কারণে নারী ও পুরুষের তুলনামূলক অবস্থানপরিমাপের জন্য টঘউচ যে মাপকাঠি উদ্ভাবন করেছে, তার নাম দেয়া হয়েছে জেন্ডার এমপাওয়ারমেন্ট মেকার এঊগ। এই এঊগ নির্ণয়ের ফলে দেখা যায়, উচ্চ প্রশাসনিক পদে মহিলাদের উপস্থিতি অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডাসহ গুটিকয়েক দেশে ৪০ শতাংশের মতো হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা ২০ শতাংশেরও কম।
এ কথা আজ সত্য যে, সমাজে সবকিছুতে নারীদের যে অধিকার রয়েছে এবং তা সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন এই বাস্তবতা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কথাটা বোধকরি আজকে এই একবিংশ শতাব্দীতে বলাটা অমূলক। সেই বেগম রোকেয়ার সময়ের অবরোধবাসিনীর যুগ শেষ হয়েছে। নারী আজ ঘরের বাহির হতে শিখেছে। শিখেছে উপার্জন করতে। সুতরাং নারীকেই তার অধিকার রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করে যেতে হবে। কারণ অধিকার অর্জন করা যেমন কঠিন, তার চেয়ে আরও কঠিন অধিকার রক্ষা করা।
( প্রবন্ধ রচয়িতাঃ সভাপতি, উইমেন কংগ্রেস অফ বাংলাদেশ, এবং ঢাকা বারডেম হাসপাতালের সাবেক সিনিয়র পুষ্টিবিদ)