ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ নদীমাতৃক অঞ্চল পাবনা। এর মাটির গন্ধ, শ্যামল প্রকৃতি মনে রেখাঙ্কন করে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ও জেলার অবদান ব্যাপক। কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের। এসব শিল্পীর অনবদ্য অবদানে আমাদের সাহিত্য হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ।
পাবনা জেলার যেসব শিল্পী-সাহিত্যিকের নাম এতে আলোচিত হয়েছে, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এঁদের বিশেষ ভূমিকা লক্ষণীয়। প্রথমে কবিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। মধ্যযুগে পাবনা জেলার যেসব কবির নাম মেলে তার মধ্যে অদ্ভুত আচার্য বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। রামায়ণ অনুবাদক হিসাবে পরিচিত। কবির সময় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে এ জেলার কৃষ্ণ কিশোর রায়, শশধর রায় মধ্য যুগের মতো পাঁচালীর অনুকরণে কাব্য রচনা করেছেন। এ জেলার কবিদের রচিত অন্যান্য উলেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী বিরচিত ‘নীহারিকা’, রজনীকান্ত সেনের ‘বাণী’ ও ‘অমৃত’, প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাশৎ’, ও ‘পদচারণ’, প্রিয়ংবদা দেবীর ‘রেণু’ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘অনল প্রবাহ’, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তার ‘প্রীতি ও পূজা’ মনীশঘটকের ‘যদিও সন্ধ্যা’ রাধাচরণ চক্রবর্তীর ‘আলেয়া’, আবুল হাশেমের ‘কথিকা’, বন্দে আলী মিয়ার ‘ময়নামতীর চর’ ও মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার ‘অরণ্যের সুর’ উলেখযোগ্য। এর মধ্যে সমকালীন সমাজচিত্রে প্রসন্নময়ী দেবী, স্বাদেশিকতায় রজনীকান্ত সেন, সনেটে প্রমথ চৌধুরী, আধ্যাত্মিকতায় অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা, শোককাব্যে প্রিয়ংবদা দেবী, জাতীয় জাগরণ মূলক রচনায় ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ঐতিহ্য বিষয়ক রচনায় আবুল হাশেম ও পলী কবিতায় বন্দে আলী মিয়ার নাম স্মরণীয়। গুরুপ্রসাদ সেন, বিহারীলাল গোস্বামী, শচীন্দ্রমোহন সরকার, আবু লোহানী, শেখ আব্দুল গফুর জালালী, সৈয়দ আসাদউদ্দৌলা সিরাজী এক বা একাধিক কাব্য রচনা করেছেন। এঁদের অনেকেই বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, সে তুলনায় সাহিত্য-অঙ্গণে ততটা পরিচিতি লাভে সমর্থ হননি।
সা¤প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মণীন্দ্র রায়, বাণী রায়, চৌধুরী ওসমান, আব্দুল গনি হাজারী, মযহারুল ইসলাম, তরুণ স্যান্যল, আনন্দ বাগচী, আবু হেনা, মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, জাহান আরা বেগম, ওমর আলী, মহাদেব সাহা, ফজল-এ-খোদা, মাকিদ হায়দার, জুলফিকার মতিন ও দাউদ হায়দার, মজিদ মাহমুদ প্রমুখের নাম উলেখযোগ্য। এর মধ্যে সংখ্যাগত প্রাচুর্য ও সৃষ্টির বিচিত্রায় সবচেয়ে প্রদীপ্ত নাম মণীন্দ্র রায়ের। যুগ যন্ত্রণা এবং একই সঙ্গে রোমান্টিকতা তার রচনায় ফুটে উঠেছে। মণীন্দ্র রায়ের ‘মুখের মেলা’, ‘মোহিনী আড়াল’, ‘এই জন্মভূমি’, কাব্যত্রয়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘রাজধানী ও মধুবংশীর গলি, বাণী রায়ের ‘জুপিটার’, তরুণ সান্যালের ‘মাটির বেহালা’, আব্দুল গনি হাজারীর ‘সূর্যের সিঁড়ি’, শংখ ঘোষের ‘নিহত পাতাল ছায়া’, আনন্দ বাগচীর ‘স্বাগত সন্ধ্যা’, জিয়া হায়দারের ‘এক তারাতে কান্না’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আপন যৌবন বৈরী’, জাহান আরা বেগমের ‘ইচ্ছার অরণ্যে’, মহাদেব সাহার ‘এই গৃহ, এই সন্ন্যাস’, মাকিদ হায়দারের ‘রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা’, ও দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ ইত্যাদি কাব্য বাংলা কবিতার ধারায় উলেখযোগ্য সংযোজন। এঁদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। আব্দুল গনি হাজারী ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ লিখে ১৯৬৪ সনে লাভ করেছেন ‘এশীয় কাব্য পুরস্কার’, মণীন্দ্র রায় ১৯৬৯ সনে তাঁর ‘মোহিনী আড়াল’ কাব্যে জন্য ‘সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেছেন এবং দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাটি লন্ডনের আন্তর্জাতিক কবিতা সমিতি কর্তৃক শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে।
ছড়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম শ্রী রামপ্রসাদ মৈত্র। কয়েকটি ছড়া তিনি লিখেছেন। তাঁর রচিত দু’টি ইতিহাস-আশ্রিত ছড়ায় ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকের বিচার ব্যবস্থার ব্যঙ্গচিত্র ফুটে উঠেছে। উপেন্দ্র কিশোর চৌধুরীর সম্পাদিত বিখ্যাত শিশু-সাময়িকী ‘সন্দেশ’-এ নিয়মিত লিখতেন প্রসন্নময়ী দেবী। রজনীকান্ত সেন বেশ কিছু শিশুপাঠ্য কবিতা লিখেছেন। এ ধারায় অন্যান্য রচয়িতার মধ্যে কয়েকজন-অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা, হেমেন্দ্রলাল রায়, বন্দে আলী মিয়া, জুলফিকার মতিন প্রমুখ। মণীন্দ্র রায়, সরদার জয়েন উদ্দীন, মযহারুল ইসলাম ব্যঙ্গাত্মক ছড়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। গীতিকার হিসেবে দুর্গা নারায়ণ চৌধুরীকে পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।‘সঙ্গীত কুসুমাঞ্জলি’ নামে তাঁর একটি সংকলন রয়েছে। রজনীকান্ত সেন অনেক গান রচনা করেছেন। কবিতার চেয়ে গানের ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিভা স্বতঃস্ফ‚র্ত। তাঁর রচিত ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ বিদেশী পণ্য বর্জনের সময় ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ জেলার অন্যান্য গীতিকারের রচিত গ্রন্থের মধ্যে প্রমথ নাথ রায় বিরচিত ‘গীতিকা’, উমাচরণ চৌধুরীর ‘গীতি কৌমুদী’, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘প্রেমাঞ্জলি’, মোহিনী মোহন নন্দীর ‘সঙ্গীত কুসুমাঞ্জলি’, তারিণী শঙ্কর বাগচীর ‘সুরলীলা’ উলেখযোগ্য। বেশ কিছু পলীগীতি লিখেছেন বিমল কৃষ্ণ মজুমদার, আবদুল গফুর ও কাজী নুরুল হোসেন। গজল রচনার ক্ষেত্রে উলেখযোগ্য নাম আবুল হাশেম। আধুনিক গানের ক্ষেত্রে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, শৈলেন রায়, আবু হায়াত মোহাম্মদ কামাল, ফজলে খোদা, তরুণ রায়।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে কাহিনীর চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য ও রূপ সৃষ্টির দিক থেকে প্রমথ চৌধুরীর নাম প্রথমেই উচ্চার্য। তাঁর গল্প সংগ্রহÑ ‘চার ইয়ারী কথা’, ‘নীল লোহিত’। সরলাবালা দাসী রচিত গল্প সংকলন ‘চিত্রপট’। এর একটি গল্প ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ লাভ করে এবং গিরিবালা দেবী ছোটগল্পে পান ‘নিরুপমা স্মৃতি পুরস্কার’। রাধাচরণ চক্রবর্তী রচিত গল্পের বইÑ ‘বুকের ভাষা’, ‘বৈরাগীর চর’। পরিমল গোস্বামীর বিশিষ্টতা সরস গল্পচিত্র রচনায়। তাঁর গল্প সংকলনÑ ‘ট্রামের সেই লোকটি’, ‘ব্ল্যাক মার্কেট’, বাণী রায়ের একটি অত্যন্ত স্মরণীয় সৃষ্টি ‘ময়নামতীর কড়চা’ এবং স্বরাজ বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘রাগিনী’। সরদার জয়েনউদ্দীন ও মযহারুল ইসলামের গল্পের উপজীব্য বিষয় গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের আলেখ্য। এ ক্ষেত্রে সরদার জয়েনউদ্দীনের বিশেষ সংযোজনÑ ‘খরস্রোত’, ‘নয়ান ঢুলী’। মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ ও নারী জীবনের সমস্যা নিয়ে ছোটগল্প লিখেছেন অবনী নন্দী, মকবুলা মনজুর, সাঈদা খানম ও জাহান-আরা বেগম। এ জেলার অন্যান্য গল্পকারদের মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, ফতেহ লোহানী, রশীদ হায়দার, সাইদ হাসনা দারা, আখতার জামান প্রমুখের নাম উলেখ্য। উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রথমেই উলেখ করা যায় গৌরনাথ নিয়োগীর নাম। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বের হয় তাঁর ‘আশা-মরীচিকা’। রোমান্টিক এ গ্রন্থ স্মরণীয়। উপাখ্যান না হলেও ইতিহাসগত কারণে তাৎপর্যবহ। এরপর বাংলা ১২৯৬ সনে বের হয় ‘অশোকা’। রচয়িতা প্রসন্নময়ী দেবী। নজিবর রহমান সাহিত্যরতœ বেশ কয়েকটি আদর্শ ভিত্তিক উপন্যাস প্রণয়ন করেন। এর মধ্যে ‘আনোয়ারা’ বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সিরাজী রচিত উলেখযোগ্য উপন্যাস ‘রায় নন্দিনী’। এ জেলার অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের মধ্যেগিরিবালা দেবী, দিগিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, মহাশ্বেতা দেবী, রাধাচরণ চক্রবর্তী, হেমেন্দ্রলাল রায়, পরিমল গোস্বামী, আবুল হাশেম, হারুনার রশীদ, বন্দে আলী মিয়া, স্বরাজ বন্দোপাধ্যায়, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সরদার জয়েনউদ্দীন, মকবুলা মনজুর ও রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম উলেখযোগ্য। এর মধ্যে গিরিবালা দেবী, বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায় ও সরদার জয়েনউদ্দীনের উলেখযোগ্য সংখ্যক উপন্যাস রয়েছে। এ জেলার ঔপন্যাসিকদের বিশেষ স্মরণীয় সৃষ্টিÑ রাধাচরণ চক্রবর্তীর ‘মৃগয়া’, হেমেন্দ্রলাল রায়ের ‘ঝড়ের দোলা’, বাণী রায়ের ‘প্রেম’, ‘কনে দেখা আলো’, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ‘কতো ছবি কতো গান’, সরদার জয়েন উদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, স্বরাজ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যা বাউলির বৃত্তান্ত’, ‘আজ রাজা কাল ফকির’, মকবুলা মনজুরের ‘আর এক জীবন’ ও রশীদ হায়দার রচিত ‘খাঁচায়’।
নাটকের ক্ষেত্রে বামাচরণ মজুমদারের নাম স্মরণীয়। এর প্রণীত ‘জমিদার’ নাটকটি অনেকটা দর্পণ জাতীয় নাটক। কৌতুকনাট্য রচনায় পরিমল গোস্বামী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংযোজনÑ ‘ঘুঘু’, ‘দুষ্মন্তের বিচার’। আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, মণীন্দ্র রায় মূলত নাট্যকার নন। একাধিক নাটক এদের রয়েছে। এর মধ্যে আবুল হাশেমের ‘মাষ্টার সাহেব’, বন্দে আলী মিয়া ‘মসনদ’ ও মণীন্দ্র রায়ের ‘ভীষ্ম’ (কাব্যনাটক) ও ‘লখীন্দর’ ইত্যাদি নাম করা চলে। এছাড়া ফররুক শিয়র, জিয়া হায়দার, ইন্দু সাহা ও রশীদ হায়দার এক্ষেত্রে বিশিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। এদের রচনা সংখ্যা সীমিত হলেও বিষয়বস্তু ও শিল্পগত দিক থেকে স্মরণীয়। ইন্দু সাহা সমাজের নিম্নশ্রেণির কথা তুলে ধরেছেন তাঁর নাটকে। সমাজের তথাকথিত এক বিশেষ শ্রেণির মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে ফররুক শিয়রের ‘ব্ল্যাক মার্কেট’ রচনায় এবং সমকালীন সমাজচিত্র হিসেবে রশীদ হায়দারের উলেখযোগ্য প্রয়াস ‘ তৈলসংকট’। প্রতীকধর্মী নাটক হিসেবে জিয়া হায়দারের ‘শুভ্রা-সুন্দর কল্যাণী-আনন্দ’ সুধীমহলের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ভ্রমণ-বিষয়ক প্রথম উলেখযোগ্য রচনা ‘আর্যবর্ত’ (১২৯৫)। লেখিকা প্রসন্নময়ী দেবী। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য সফরের ওপর গ্রন্থ লিখেছেন ইসমাইল হোসেন সিরাজী সেগুলো হল: ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ ও ‘সিরিয়া ভ্রমণ’। পরিমল গোস্বামীর এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান-Ñ‘পথে পথে’। সাংস্কৃতিক মিশনের সদস্য হিসেবে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুল আহাদ চীন সফরে যান। এরওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে ‘গণচীনে চব্বিশ দিন’ এবং মোহাম্মদ আবদুল খালেক বিরচিত ভ্রমণকথা ‘পদ্মা থেকে ইয়াংসি’। স্মৃতিকথামূলক রচনা এ জেলায় কিছু পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম প্রসন্নময়ী দেবী। তাঁর রচনা-‘পূর্বস্মৃতি’। এরপর আত্মকথা লিখেছেন প্রমথ চৌধুরী। এতে হরিপুর পাবনার স্মৃতি রোমন্থন লক্ষিত হয়। এছাড়া বাংলা ১৩৩৩ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘সবুজপত্রে’ তিনি ‘পাবনার কথা’ নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। পরিমল গোস্বামীর স্মৃতিচারণমূরক স্মরণীয় সৃষ্টি ‘পত্রস্মৃতি’ ও ‘আমি যাঁদের দেখেছি’। ময়েজউদ্দিন আহম্মদের ‘মহাসমরের পটচ্ছায়া’ তাঁর অভিজ্ঞতাপূর্ণ জীবনের আলোকে সমৃদ্ধ ও সুখপাঠ্য। অতীত স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে বন্দে আলী মিয়ার রচনা ‘জীবনের দিনগুলি’ এবং অশোক বাগচী রচিত গ্রন্থ ‘পিছু ডাকে’।
স্মৃতিকথার চেয়ে তুলনামূলকভাবে জীবন চরিত এ জেলায় রচিত হয়েছে অনেক। এ জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে আলাউদ্দিন আহমদের ‘হযরত বড় পীর সাহেবের জীবন চরিত্র’ গৌরগোবিন্দ উপাধ্যায়ের ‘আচার্য কেশবচন্দ্র’, প্রসন্নময়ী দেবীর ‘তারা চরিত’, সরলাবালা দাসীর ‘ভগিনী নিবেদিতা’, যোগেন্দ্রলাল রায়ের ‘মোস্তফা কামাল পাশা’, মোহাম্মদ সানাউলার ‘হযরত ফাতেমা’, এম সেরাজুল হকের ‘সিরাজী চরিত’, আব্দুল জব্বার সিদ্দিকীর ‘মানুষের নবী’ ও বন্দে আলী মিয়ার ‘জীবনশিল্পী নজরুল’ স্মরণীয়। জীবনকথা বিষয়ক প্রবন্ধে এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে পরিমল গোস্বামী, মোহাম্মদ বরকতুলাহ্, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, আবু লোহানী, ইজাবউদ্দীন আহমেদ, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, নীলুফার নার্গিস প্রমুখ বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন।
অনুবাদের ক্ষেত্রেও এ জেলার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রসন্নময়ী দেবীর ‘বনলতা’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজি থেকে অনূদিত। কুমুদনাথ চৌধুরী রচিত ‘ঝঢ়ড়ৎঃং ওহ ঔযববষং অহফ ঔঁহমষবং’ অনুবাদ করেছেন প্রিয়ম্বদা দেবী। তাঁর অনূদিত ‘ঝিলে জঙ্গলে শিকার’ ‘সবুজপত্রের কয়েকটি সংখ্যায় বের হয়। শেক্সপীয়রের ‘ঞযব ঈড়সবফু ড়ভ ঊৎৎড়ৎং’ অবলম্বনে হাবিবুর রহমান অনুবাদ করেছেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’। পরিমল গোস্বামী অনূদিত অন্যতম উলেখযোগ্য গ্রন্থ ‘সুখের সন্ধানে’ (মূলঃ বারট্রান্ড রাসেল)। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন রুমীর ‘মসনবী শরীফের’ আংশিক অনুবাদ করেছেন। বাণী রায়ের ‘জুপিটার’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজি থেকে অনূদিত এবং অনূদিত গদ্যরচনা ‘মোনালিসা’, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত এপুলিয়াস-এর ‘এড়ষফবহ অংং’ অবলম্বনে আবদুল গনি হাজারী অনুবাদ করেছেন ‘স্বর্ণ গর্দভ’। এক্ষেত্রে তাঁর আর এক উলেখযোগ্য প্রয়াস‘মনঃসমীক্ষা’ (মূল ফ্রয়েড)। আর্থার মিলার রচিত ‘উবধঃয ঙভ ধ ঝধষবংসধহ’ অবলম্বনে ফতেহ লোহানীর রচনা ‘একটি সামান্য মৃত্যু’ এবং ইউজীন ও নীল-এর নাটকের অনুবাদ ‘বিলাপে বিলীন’। মুহম্মদ শামসুল হকের মূল গ্রন্থ অবলম্বনে ‘শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন ড. আবদুলাহ্ আমমুতী শরফুদ্দিন। এছাড়া অনুবাদের ক্ষেত্রে এ জেলার শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা বিচরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে বিহারীলাল গোস্বামী, হেমেন্দ্রলাল রায়, মোহাম্মদ সানাউলাহ্, শাহ্ ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, মযহারুল ইসলাম ও জিয়া হায়দার প্রমুখের নাম করা যেতে পারে।
শিশুসাহিত্যেও পাবনা জেলার বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ জেলার উলেখযোগ্য সংখ্যক শিশুসাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা, প্রিয়ম্বদা দেবী হেমেন্দ্রলাল রায়, মোহাম্মদ সানাউলাহ্, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, মোহাম্মদ আবিদ আলী, বন্দে আলী মিয়া ও কাজী গোলাম আকবর প্রমুখের নাম করা চলে। শিশুসাহিত্যে মোঃ আকবর আলী, শেখ আবদুল হাকিম, শাহ্ ফজলুর রহমান, সরদার জয়েনউদ্দীন ও ড. আবদুলাহ্ আলমুতী শরফুদ্দিনের দানও প্রসঙ্গত স্মর্তব্য। এর মধ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে বন্দে আলী মিয়ার বইয়ের সংখ্যা পর্যাপ্ত। এক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬২ সনে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেছেন।
প্রবন্ধের ক্ষেত্রে পাবনা জেলার অবদান ব্যাপক। প্রথমে সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের কথা আলোচনা করা যেতে পারে। এতে প্রমথ চৌধুরী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, ড. মযহারুল ইসলাম, ড. গোলাম সাকলায়েন, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মুহম্মদ আব্দুল খালেক, মনোয়ার হোসেন জাহেদী, ড. এম. আব্দুল আলীম, ড. মো. হাবিবুলাহ প্রমুখের নাম স্মরণীয়। বাংলা গদ্যের বিবর্তনে ও প্রবন্ধের সাহিত্যের ধারায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য অবদান ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘নানাকথা’, ‘নানাচর্চা’। বাগ বৈদগ্ধ্য তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য প্রাবন্ধিকের মধ্যে ড. মযহারুল ইসলাম লোকসাহিত্যের ওপর বিশেষ গবেষণা করেছেন আর আধুনিক সাহিত্যের ওপর গবেষণায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ড. আবু হেনা রচিত গবেঘণা নিবন্ধ-ঞযব ইবহমধষর ঢ়ৎবংং ধহফ ষরঃবৎবধৎু ৎিরঃরহমং, ১৮১৮-১৮৩১’ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শিল্পীর রূপান্তর’- এ মনস্বিতার পরিচয় মেলে।লোকসাহিত্যের ওপর গবেষণার ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ড. মুহম্মদ আবদুল খালেক ও ড. মুহম্মদ আবদুল জলিল।
দার্শনিক প্রবন্ধ রচনায় সবিশেষ খ্যাত শশধর রায়, মোহাম্মদ বরকতুলাহ্ ও রফিউদ্দিন প্রমুখ। এক্ষেত্রে স্মরণীয় প্রয়াস মোহাম্মদ বরকতুলাহর ‘মানুষের ধর্ম’। ইতিহাসবিষয়ক রচনায় রাধারমন সাহা, তারিনী চরণ চৌধুরী, বঙ্কিমচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ মৈত্র, দূর্গানাথ সান্যাল, মির্জা আবু ছাঈদ, মোক্তার আহম্মদ সিদ্দিকী, মোহাম্মদ বরকতুলাহ বিশিষ্টতার দাবিদার। তাঁদের প্রণীত গ্রন্থের মধ্যে রাধারমণ সাহার ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’, রামপ্রসাদ মৈত্রের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ ও দুর্গানাথ সান্যালের ‘বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস’ স্মরণীয় রচনা। বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধে প্রথমেই মাখনলাল চক্রবর্তীর নাম করা চলে। এক সময়ে বিজ্ঞানের ওপর বেশকিছু প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে উলেখযোগ্য প্রয়াসÑ মো. আকবর আলীর ‘বিজ্ঞানে মুসলমানের দান’, শাহ্ ফজলুর রহমানের ‘মহাশূন্যে অভিযান’, মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের ‘তারা পরিচিতি’ ও ড. আবদুলাহ্ আলমুতী শরফুদ্দিনের ‘রহস্যের শেষ নেই’ ইত্যাদি গ্রন্থ। রম্যরচনার ক্ষেত্রে পরিমল গোস্বামী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। নির্মল কৌতুকের প্রচ্ছন্ন প্রবাহ লক্ষিত হয় তাঁর রচনায়। এক্ষেত্রে আর একটি উলেখযোগ্য নাম সমজিৎ পাল।
ছায়াচিত্রের ওপর নিয়মিত ফিচার লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন হুসনা বানু খানম এবং চিত্রকলার ওপর নিবন্ধ লিখেছেন শিল্পী আবুল বারক আলভী। লুপ্তপ্রায় পদ সংগ্রহ ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর সংগৃহীত পদ ‘হারামণি’ নামক গ্রন্থ ৮টি খন্ডে সংকলিত। এক্ষেত্রে অন্যান্যের মধ্যে ড. মযহারুল ইসলাম, ড. গোলাম সাকলায়েন প্রমুখের নামও উলেখযোগ্য। ধর্মবিষয়ক ও আদর্শমূলক প্রবন্ধে মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরউলাহ্, সালেহা খাতুন, তারিণীবালা দেবী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, খায়রুন্নেসা, আলাউদ্দীন আহমদ, আবু নাজেম, এলাহী বক্স, মোহাম্মদ আবদুলাহেল কাফী, আবদুর জব্বার সিদ্দিকী ও এম. সেরাজুল হক বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রমথ চৌধুরীর ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’ সঙ্গীত গ্রন্থ-জগতে উলেখযোগ্য সংযোজন। এবং বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধের ক্ষেত্রে দিগিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুলাহ্, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, নরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, গৌরগোবিন্দ উপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, মওলানা ভাসানী, হেমেন্দ্র কুমার গুপ্ত, ড. গোলাম মকসুদ হিলালী, শেখ আবদুল গফুর জালালী, আবু লোহানী, পরিমল গোস্বামী, প্রণবেশ সেন, অশোক বাগচী, আবদুলাহ্ আল ফারুক, মুজিবর রহমান বিশ্বাস, ফজলে লোহানী, কামাল লোহানী, আবু সাইয়িদ, আমিনুদ্দিন শাহ্, সমজিৎ পাল প্রমুখের নাম স্মরণীয়।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গেও পাবনা জেলা বিশেষভাবে জড়িত। করতোয়ার তীরে শাহজাদপুর কুঠিবাড়িতে কেটেছে রবীন্দ্রনাথের উলেখযোগ্য প্রহর। তাঁর রচনায় করতোয়া, ইছামতি, পদ্মা ও যমুনার চিত্র বিশেষভাবে মেলে। এখানে অবস্থানকালে অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প ও চিঠিপত্র লিখেছেন। পাবনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার এসেছেন। ‘পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইট কিনি’Ñ এ রকম ইচ্ছাও পোষণ করেছেন কবিতায়। পাবনায় অবস্থানকালে ঠাকুর এস্টেটের আইন উপদেষ্টা শ্রী তারকনাথ অধিকারীর কাছে এক সন্ধ্যায় সিঙ্গা শ্মশানের একটি বাস্তব ঘটনা শোনেন। এর সাথে সামান্য কল্পনা মিশিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘জীবিত ও মৃত গল্প, যে গল্পে ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’। পাবনা জেলার সাহিত্য-সাধনার সঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামও সম্পৃক্ত। ১৯৩২ সনে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কবি নজরুল। পাবনায় অবস্থানকালে কয়েকটি কবিতাও তিনি লিখেছেন। অনেক সাময়িকী এ জেলা থেকে বের হয়েছে। এর মধ্যে ‘পাবনা দর্পণ’, ‘উদ্যোগবিধায়নী’, ‘আশালতা’, ‘সৎসঙ্গী’, ‘সাম্যবাদ’, ‘সুরাজ’, ‘আমাদের দেশ’, ‘যমুনা’, ‘ইছামতি’, ‘প্রবাহ’, ‘পাবনার খবর’ ‘বিবৃতি’, ‘নির্ভর’, ‘বাঁশপত্র’, ‘সিনসা’, খবর বাংলা’ ‘জোড়বাংলা’, ‘বিশ্ববার্তা’, ‘পাবনার আলো’ ‘আমাদের বড়াল’ ‘সপ্তর্ষি’, খোলাচোখ, অনন্য কথা’ দিগন্ত, ইত্যাদি উলেখযোগ্য।
বর্তমানে পাবনা জেলার যেসব লেখক নিরলস সাহিত্যচর্চা করছেন তাদের মধ্যে গবেষণামূলক প্রবন্ধে মজিদ মাহমুদ, ড. এম. আবদুল আলীম, আবুল কাসেম, ড. মোঃ হাবিবুলাহ্, আতাহার আলী খান। কবিতায় মজিদ মাহমুদ, আবু জাফর খান, আবু মহম্মদ রইস, মানিক মজুমদার, আবুল কাসেম মৃধা, আজিজুল হক, আতাহার আলী খান, এনামুল হক টগর, সৈয়দা কামরুন্নাহার শিল্পী, শ্যামল দত্ত, আদ্যনাথ ঘোষ, মোঃ আলতাফ হোসেন, মধুসূদন মজুমদার, নাসরিন নিহার, শামসুর রহমান বাবু, ফাহমিদা হোসেন মিনু, ইফতেখারুল আলম ইন্টু, হাসান আহম্মদ চিশতি, আবুল কাসেম, সাজেদুল হক নিলু। ছোটগল্প সাইদ, হাসান দারা, আখতার জামান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। উপন্যাসের ক্ষেত্রে উলেখ্য নাম সাইদ হাসান দারা, আবু মহম্মদ রইস, খায়রুজ্জামান, আখতার জামান, নাসরিন নিহার। শিশু সাহিত্যে আজাদ এহতেশাম, শুচি সৈয়দ, মোঃ মোহসিন আলী, দেওয়ান ওহিদুজ্জামান বাদল খ্যাতিমান। নাটকে বৃন্দাবন দাস, আবু মহম্মদ রইস, আবু হাসনাত মোশারফ, আশরাফ রবি, এর প্রয়াস প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ইতিহাস ও সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে জহুরুল ইসলাম বিশু, রবিউল ইসলাম রবি, আবুল কালাম আজাদ ও আবুল কালাম আজাদ বাবু শ্রমনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। ভ্রমণ কথায় জিয়াউল হক এবং বিবিধ বিষয়ক রচনায় রণেশ মৈত্র, হাবিবুর রহমান স্বপন, মোস্তফা সতেজ প্রমুখের নাম উলেলখযোগ্য। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে হৃদয় খান, জুবায়ের খান প্রিন্স, রেহানা সুলতানা শিল্পী প্রমুখের নাম স্মর্তব্য।
পাবনা জেলার সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে প্রাঞ্জল করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন যে সব ব্যক্তিত্ব, তাদের মধ্যে প্রথমেই স্কয়ার গ্র“পের অঞ্জন চৌধুরী পিন্টুর নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত। ২০১৪ সালে পাবনাতে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের যে জাতীয় সম্মেলন হয়, তার সম্পূর্ণ স্পনসর তাঁর অবদান।
পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে আর এক উলেখ্য নাম কবি সোহানী হোসেন। ইউনিভার্সাল গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এক মহিলা শিল্প উদ্যোক্তা। সোহানী হোসেন নিজে একজন কবি। বেশ কয়েকটি কাব্য লিখেছেন। এ জেলার সাহিত্যানুরাগীদের বিভিন্নভাবে তিনি সহযোগিতা করেন।
মানিক মজুমদার বাংলাদেশ কবিতা সংসদ-এর প্রতিষ্ঠাতা, একজন লেখক, ‘খোলাচোখ’-এর সম্পাদক, একজন সব্যসাচী ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজে সাহিত্যচর্চা করেন এবং লেখকগোষ্ঠী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তার আর এক কৃতিত্ব দেশের এবং দেশের বাইরের শিল্পীদের নিয়ে সাহিত্যবাসর, মিলনমেলার আয়োজন। যৌথগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে লেখকদের পরিচিতি করা। প্রায় ছয়শত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন যা উত্তরবঙ্গে বিরল দৃষ্টান্ত। সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব মির্জা গোলাম রব্বানী তাঁর প্রয়াত পিতার নামে ‘মির্জা শমসের আলী স্মরণ পরিষদের পক্ষ থেকে একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা এবং স্মরণিকা বের করেছেন। এই সব স্মরণিকার মাধ্যমে অনেক নোতুন লেখকের আত্মপ্রকাশ লক্ষ্যণীয়। রেহেনা সুলতানা শিল্পী মহিয়সী প্রকাশনার মাধ্যমে ও আলমগীর কবীর হৃদয় উত্তরণ প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।
সাংবাদিক মহিউদ্দিন ভূঁইয়া তার ‘বহুমাত্রিক প্রতিভার মেলবন্ধনে পাবনা’ নামক গ্রন্থের মাধ্যমে অনেক লেখকের পরিচিতি উপস্থাপন করেছেন। এ রকম আর একটি উলেখ্য প্রয়াস ‘পাবনার কবি ও কবিতা’।সম্পাদনায়ঃ আলাউল হোসেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে আলাউল পাবনার অনেক কবির পরিচয় তুলে ধরেছেন।
ফোল্ডার পত্রিকার মাধ্যমে ইদ্রিস আলী পাবনার লেখক গোষ্ঠী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে ইদ্রিস ফোল্ডার সম্পাদনা করেছেন।
মানিক মজুমদার পাবনা থেকে রূপম প্রকাশনীর মাধ্যমে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। নোতুন লেখকেরা তার কাছে বিপুল ভাবে ঋণী, লেখকগোষ্ঠী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছেন তা অভিনন্দনযোগ্য। এ জেলার সাহিত্যচর্চার পোষকতার ক্ষেত্রে সাইফুল ইসলাম স্বপন চৌধুরী, রানা গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন বিশ্বাস রানা এবং মাসপো গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মুর্তজা সনি বিশ্বাস এর ভূমিকা প্রশংসনীয়। উলিখিত ব্যক্তি বর্গের পোষকতায়, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নিরন্তর প্রয়াসের ফলশ্র“তি হিসেবে আমরা এ জেলায় যে সব লেখকদের পেয়েছি তাদের নাম নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।
এদের মধ্যে ওমর আলী, হোসনেআরা চৌধুরী, মুহম্মদ ফজলুর রহমান, অটল খাঁ, বেগম রওশন আখতার, মোঃ আবদুল করিম, জাফর সাদেক, আলতাফ হোসেন, নুরুজ্জামান মুসাফির, বদিউর রহমান, বাবলা মাহফুজ, সরোওয়ার জাহান ফয়েজ, আবদুস সাত্তার, সাজেদ রহমান, কাজী আবদুর রউফ, এন.এন. নজরুল ইসলাম, খ.ম. আসাদ, খান নুরুজ্জামান, সরদার নজরুল ইসলাম, ডা. উত্তম কুমার রায়, ইদ্রিস আলী মধু, আফতাব আলী, আবদুলাহেল বাকী, আমিনুর রহমান খান, মোখলেসুর রহমান মুকুল, শেখ ডেভিট, কে.বি.এম.এ. মোসলেহ, আলমগীর কবীর হৃদয়, মৌমিতা মজুমদার মুক্তা, লুৎফর রহমান নুতু, মধুসূদন মজুমদার, সৈয়দা জহুরা আকতার ইরা, খান আনোয়ার হোসেন, রূপম মজুমদার, ফরিদুজ্জামান ফাহিম মিতুল উলেখযোগ্য। লেখকদের এই তালিকাটা দীর্ঘ। এই তালিকার অর্ন্তভূক্ত সাহিত্যিকদের মধ্যে জাহিদ হায়দার, শামিম হুসাইন, এ.কে. সাগর, স্বদেশ বন্ধু সরকার, আলাউদ্দিন আলো, মাসুদ শেখ কানু, সোলায়মান হোসেন, মির্জা তাহের জামিল, ইসলাম ফেরদৌস, তোফাজ্জল হোসেন তারা, আমিনুল ইসলাম জুয়েল, আহম্মদ ফিরোজ, মোশারফ হোসেন বাচ্চু, শামসুন্নাহার বর্ণা, লিখন অরণ্য, লতিফ জোয়ার্দার, আরিফ হায়দার, জুলকারনাইন, শফিউল শাহিন, অর্ণব রানা, আমিনুল ইসলাম সৌরভ, শফিক আনান, আনিসুল হক বরুণ, মোনায়েম খান, তারেক মাসুদ, ছিফাত রহমান সনম, সৈয়দ রুমী, রমন রফিক, নিষাদ রাকিব, অম্লান দত্ত, কান্তি তুষার, আলাউদ্দিন মোলা, মেহেদি হাসান অপু, শফিক লিটন তানজিন তামান্না, শহিদ সুবহান, উত্তম কুমার দাস, রিংকু অনিমিখ প্রমুখের নাম স্মতর্ব্য। মাত্র ৮ বছরে কবিতা লিখে ও প্রথম গ্রন্থ ‘সবুজ অবুঝ আল্পনায়’ ২০২০ সালে প্রকাশ করে পাবনার ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মানব মজুমদার সুবর্ণ। তার ভবিষ্যত প্রতিশ্র“তিপূর্ণ।
উপরে এ জেলার অনেক লেখকের নাম উলিখিত হল। তারপরেও নির্দ্বিধ চিত্তে বলছি, স্বল্প পরিসরে সকলের পরিচিতি তুলে ধরা সম্ভব হল না। এই তালিকার বাইরে যে সব প্রতিভাবান লেখকের নাম বাদ পড়ে গেল, সে সব তথ্য উপস্থাপনের দায়িত্ব আগামীকালের গবেষকদের হাতে রইল।
সাহিত্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পাবনা জেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বনমালী রঙ্গমঞ্চকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নাট্যআন্দোলন। উপমহাদেশের অনেক প্রখ্যাত অভিনেতা এই মঞ্চে অভিনয় করেছেন। এ মঞ্চে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের মধ্যে সুচিত্রা সেন, নারায়ণ চক্রবর্তী, জগদীশ চন্দ্র গুহ, তেজেন চক্রবর্তী, আবুল কাশেম, তপন লাহিড়ী, আবুল হোসেন, নিশি বক্সী, আবদুর রশীদ, আবদুস সালাম, দেবেশ সান্যাল, লক্ষী দাস চাকী, আয়েনউদ্দীন, মিনতি সান্যাল প্রমুখের নাম করা যেতে পারে। বিশিষ্ট লেখকদের মধ্যে বনমালী রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা এসেছেন তাঁদের মধ্যে রজনীকান্ত সেন, প্রমথ চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, শামসুর রহমান, বদরুদ্দীন উমর, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, অশোক বাগচী, কামাল লোহানী, আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, আবদুলাহ্ আবু সায়ীদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখের নাম উলেখযোগ্য। প্রখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে এসেছেন অহীন্দ্র চৌধুরী, চিন্ময় লাহিড়ী, জগন্ময় মিত্র, বারীণ মজুমদার, আবদুল আহাদ, ফেরদৌসী রহমান, আবদুল আলিম, মহিউদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, ইয়াসিন খান, আমজাদ হোসেন, আলী জাকের, রামেন্দু মজুমদার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দোপাধ্যায়, মামুনুর রশীদ, হুমায়ুন ফরিদী, সুবর্ণা মোস্তফাসহ আরো অনেকে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এ জেলায় অনেক বিখ্যাত শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে অখিল চন্দ্র পাকড়াশি, প্রমথ চৌধুরী, চিন্ময় লাহিড়ী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিমল মজুমদার, সতু মোহন সান্যাল, লাল টুনু, বারীণ মজুমদার, নিত্য গোপাল জোয়ারদার, ইলা মজুমদার, সত্য মজুমদার, শম্ভু জোয়ারদার, প্রণব রায়, বাঁশরী লাহিড়ী, অপরেশ লাহিড়ী, অন্নদা গোবিন্দ চক্রবর্তী, গৌরী শংকর ব্রহ্মচারী, হরিহর শুক্লা প্রমুখ।
আধুনিক গানে অপরেশ লাহিড়ী, হৈমন্তী শুক্লা, বাপ্পী লাহিড়ী, মৌসুমী ভৌমিক, মাস্টার নাননু, জান্নাতুল ফেরদৌস, নীরু শামসুন নাহার, তনুশ্রী দাস, অণিমা রায়, ডলি সায়ন্তনী, বাদশা বুলবুল, বাপ্পা মজুমদার, রীতা বসাক। রবীন্দ্র সঙ্গীতে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মোজাম্মেল হোসেন, সন্তোষ দত্ত, বরুণেশ্বর সাহা, রেণু অধিকারী, সন্ধ্যা সাহা, লিলি বিশ্বাস, শিউলি বিশ্বাস, মাধুরী হক। নজরুল গীতিতে মলয় মৈত্র, শেখ মহিউদ্দিন, নিত্য গোপাল জোয়ারদার, শিবানী নাগ, মাতোয়ারা সাকী, রেশমা কোহেন। রাগ প্রধান গানে চিন্ময় লাহিড়ী, লক্ষী তলাপাত্র। পলিগীতিতে দেলোয়ার হোসেন, মনোয়ারা বেগম। লালন গীতিতে এম.এ. গফুর এবং গণ সঙ্গীতে শহিদ গোলাম সরোয়ার সাধন। সেতারে বলাই বসাক, বাঁশীতে শংকর চক্রবর্তী, বেহালায় আবদুর রশীদ, তবলায় সুধারাম গুহ, বীরেন্দ্রনাথ মৈত্র, মলয় মৈত্র, শৈলেশ সান্যাল, পলব সান্যাল। সঙ্গীতে ওস্তাদ এবং সংগঠক হিসেবে মনসুর আলী, এম.এ. গফুর, দেলোয়ার হোসেন, প্রমথ চৌধুরী, সত্য মজুমদার, আবদুর রশীদ প্রমুখের নাম স্মরণীয়। নৃত্য, অভিনয় ও চিত্র জগতের সঙ্গে সংশিষ্টদের মধ্যে ফতেহ লোহানী, মহিউদ্দিন, রওশন আরা, দারাশিকো, মাসুম আজিজ, বৃন্দাবন দাস, শাহানাজ খুশী, চঞ্চল চৌধুরী, আবদুল হান্নান শেলী প্রমুখের নাম উলেখযোগ্য। পাবনার সাংস্কৃতিক অঙ্গণ যারা সচল রেখেছেন তাদের মধ্যে আবদুল মতীন খান, রবিউল ইসলাম রবি, রোখসানা খানম ডেইজি, আবুল হাশেম, আবুল কাশেম, ফুলরেণু রায়, প্রলয় চাকী, মলয় চাকী, শফিউদ্দিন, আবদুল মালেক, আশরাফ হোসেন রবি, নাসিমা আশরাফ, শংকর চক্রবর্তী, কবীর খান, সারওয়ার খান মিলন, মারুফা মঞ্জুরী খান সৌমি, সঞ্জীব কুমার নন্দ প্রমুখের নাম উলেখযোগ্য। সংস্কৃতির বিকাশে ইফা, আফা, সূচনা, উদীচি, গণশিল্পী, শিশু একাডেমি, গন্তব্য, এম.এ. গফুর বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান নিরলস কাজ করে চলেছে। তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ জেলা পাবনার সাহিত্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সত্যিই উন্নত। এখানকার লোকসংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্য বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। তাঁতের শাড়ির জন্য পাবনা বিখ্যাত, আর বিখ্যাত এখানকার জারি, সারি, ছড়া, মেয়েলি গীত, বিয়ের গান। এসব গান এ অঞ্চল তথা সারা দেশের মানুষকে করেছে বিমুগ্ধ। যুগে যুগে এখানে এসেছেন অনেক পরিব্রাজক। তুর্কি-পাঠান-মোঘল আমলে ইসলাম প্রচার উপলক্ষে এখানে এসেছেন সূফিসাধক ও আউলিয়াগণ। তাঁদের হাতে গড়া বহু কীর্তি জেলার নানান স্থানে ছড়িয়ে আছে। বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন স¤প্রদায়ের সম্মিলিত আবাসস্থল পাবনা। সব মিলিয়ে পাবনা জেলা বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এক কথায় বলা চলে, পাবনা অনেক ঐতিহ্যের আকরে সমৃদ্ধ। এর বুকের গভীরে লালিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার যেমন ঐতিহ্যমন্ডিত, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এখানকার গণমানুষের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে পাবনা জেলার যে ভূমিকা, তা শুধু ব্যাপকই নয়, সুদূর প্রসারী।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, (অব:) পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা।