২২শে শ্রাবণ এলেই আমরা সচকিত হয়ে উঠি। কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী, কবি এবং মহাকবিরা একটি শব্দ কতবার কতরকম ভঙ্গিমায় লিখেছেন- বলেছেন। শব্দ এক হলেও ভাষাগত ধারালো যুক্তি ভাললাগা বিভিন্নরকম ভাবে মানুষের হৃদয়ের জমিনে পাকাপোক্ত কংক্রিট ভিত সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি ত্যাগের যে সময় ব্যয় তিনি করতে পেরেছেন বলেই মানুষের কাছে তাঁরা মরেও অমর। রবীন্দ্রনাথ, আইনষ্টাইন, নজরুল পৃথিবীতে একবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের স্থানে যোগ্যতায় পুনঃজন্মে কেউ আসবেনা। তবে রবীন্দ্রনাথ কবিগুরু তাঁদের মর্যাদা সন্মান এবং তাঁদের সৃষ্টির যে উপন্যাস আমরা তাঁদের বিকাশের জন্য মূল্যায়ন খুঁজছি। রবীন্দ্রনাথের সময়ে যে সমাজিক গোঁড়ামি ছিল সেখানে কবি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে অনেক কুসংস্কার প্রথা দূর করেছেন। সভ্য সমাজে একুশ শতকে এসেও চাকার নিচে থেঁতলে যাচ্ছে মানব জীবনধারা।
রবীন্দ্রনাথের সব সৃষ্টি অসীম শক্তিশালী। কবিগুরুর উপন্যাস অন্যান্য এবং “চোখের বালি” উপন্যাসে সেই সময়ে নারী সম্পর্কে লিখতে গেলেও পুরুষকে বিচ্ছিন্ন করে কোন কিছু বাদ দেওয়া হয়নি বরং নারী পুরুষকে উদারভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। তবুও সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যেভাবে শোষিত হয়েছে বর্তমানে সেই শোষণ ব্যবস্থা এখনো আছে। পাল্টে গেছে শোষণের পটভূমি। রবীন্দ্রনাথ ধর্ম বলতে মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কবিগুরু “মহুয়া” কবিতায় নির্ভয় রচনার তিনটি স্তবকেরই শেষ লাইন দুটি যথাক্রমে তুলে ধরলাম,
১। তুমি নাই ভয়, জানি নিশ্চয়
তুমি আছো আমি আছি।
২। মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব
তুমি আছো আমি আছি।
৩। এ বাণী প্রেয়সী, হোক মহিয়সি
তুমি আছো আমি আছি।
কবিতাটি রচনা হয়েছিল ৩১ শে শ্রাবণ ১৩৩৫। রবীন্দ্রনাথের চোখে নারীর প্রতি প্রেম ভালবাসা ছিল গভীর। রবি ঠাকুরকে নিয়ে ছোটবেলা থেকে আমার আলাদা এক কৌতুহল ও ভালবাসা ছিল। ভালবাসার তীব্রতায় চোখের বালি, বই পড়তে যেয়ে এবং টিভি নাটকের অভিনয় দেখতে চোখ দু’হাতে ঢেকে কেঁদেছি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, নৌকাডুবি, মালঞ্চ, ঘরে বাইরে, বলাকা, শেষের কবিতা প্রভৃতি পড়তে পড়তে প্রায় অধিকাংশ পড়েছি। সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী পড়েও রবীন্দ্র সাহিত্য ভূমিকানারী প্রগতির ইতিহাস, গীতিবিতান, গীতাঞ্জলি পড়েছি দীর্ঘদিন ধরে, তবু কবিগুরুর ইতিহাসের দৃষ্টি যে কোন লেখা শুরু করেছি। স্বল্পমেধায় যতটা পারার কথা ততটা না পারলে বিষয়টির গভীরতা আমায় থমকে দিয়েছে। সমাজে নারীর যে অবস্থান টানাপোড়েন চলছেই। গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা বলে একটি কথা প্রচলিত আছে সেই কথার সাথে ক্ষুদ্রনারী হয়েও কলমে হাত রেখেছি।
সমালোচনা যুগে যুগে ছিল, থাকবে; আমার মনে হয় সুস্থ মানুষ মেধা বোধসম্পন্ন হলে সুস্থ চেতনা সবাই করতে পারেনা। ইতিহাসের পাতাতে নারীর দাসপ্রথা আজও আছে। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের মজ্জাগত যে কীট আর সেই কীট ধ্বংস করার দায়িত্ব যে নারীর উপরে এসে বার বার আছড়ে পড়ে যার ফলস্বরূপ বহু মণীষী কবি অনেক করেছেন নারীদের আবদ্ধ জীবনের জন্য। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে ছিলেন অন্যতম।
রবীন্দ্র সৃষ্টিতে প্রাক সবুজপত্র পর্ব সম্পর্ক সামান্য তুলে ধরব, কারণ কবি কে তুলে ধরার মত আমার কলমের শক্তি ক্ষীণ। সবুজপত্র (১৯১৪) যুগে তাঁর আগে পর্যন্ত কবিতার জগতেও রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখত চেয়েছেন, মধুর হাসিনী, স্বপ্নচারিণী মূর্তিতে। রবীন্দ্র সাহিত্য উপন্যাসে ব্যক্তিত্বশালিনী নারীর অভাব নেই, তবে ব্যক্তিত্বের তিনি প্রেয়সী বা জননীত্ব আরোপ করেছেন। সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য সুরদাসের অন্ধতার প্রার্থনা, অন্যদিকে নারী সৌন্দর্যের স্তরঃ
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে, সৌন্দর্য সঞ্চারী
আপন অন্তর হতে।
প্রশান্ত কুমার পাল মন্তব্য করেছিলেন যে কবি স্ত্রীলোকের ভালবাসার মধ্যে মাত্রাভেদ নেই জাতিভেদ বর্তমান। পুরুষের ভালবাসা সৌন্দর্য প্রিয়ভাবের সঙ্গে যুক্ত আর নারীর ভালবাসা নির্ভরতা অর্থাৎ ক্ষমতায় আসক্ত হতে উৎপন্ন।
পুরুষের ওউঊঅখ এর প্রতি স্ত্রীলোকের যথার্থ জঊঅখ এর প্রতি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যরসে এবং সমাজ ধর্মের উর্ধ্বে নারীকে উপন্যাসে, ছোট গল্প, প্রবন্ধে, গানে, নাটকে, বিরহে সর্বরকমভাবেই জাগ্রত করেছিলেন সেই যুগেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য আর নারী প্রগতি স্বরূপ তুলে ধরেছেন, যেমন “নষ্ট নীড়” উপন্যাসে গীরিবালা প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন যেটা এক অর্থে আত্মখন্ডন। বাস্তব জীবনে স্বামী গোপীনাথ তাকে মর্যাদা দেয়নি। তবে গীরিবালা যখন রঙ্গমঞ্চে নকল জীবন (অভিনেত্রী) নিয়ে সবার প্রশংসা যোগ্যতায় খ্যাতিপেল গোপীনাথ তখন সেটা মেনে নিতে পারেনি? অথচ ঘরে সুন্দরী স্ত্রী গীরিবালা স্বামীর কাছে যোগ্যতা না পেয়ে মঞ্চে উঠে দর্শকদের নকল অভিনয়ে মন জয় করে ফেলে। গোপীনাথ সেইদিন মঞ্চে গীরিবাল কে থামাতে গেলে একসময় পুলিশ দর্শকের অনুমতিতে গোপীনাথ কে থানায় নিয়ে যায়। গীরিবালা কিছু না পেলেও নিজেকে আত্মখন্ডন করতে পেরেছে। নষ্টনীড় এভাবেই ট্রাজেডি নিয়ে শেষ হয়।
প্রকৃতভাবে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য দিয়ে সমাজ কাঠামোতে নারীকে সংস্কার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আজকের নারীরা মুক্তির সন্ধান পায়নি, না গৃহে না কর্মে। কবিগুরুর ‘চোখের বালি’ প্রকাশ হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ সতের বছর (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), গোরা (১৯৪০) এই তিনটি উপন্যাস উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে বাংলা মধ্যবিত্ত সমাজে আলোচনায় বিশেষভাবে স্থান পায়।
‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীকে দুর্লভ সাহসের অধিকারীনি রূপে চিত্রাায়িত করেছিলেন। সর্বগুণসম্পন্ন বিনোদিনীর একটাই অপরাধ ছিল সে বিধবা। সংসার যৌবনে সবরকম সুখ ভোগে বঞ্চিত ছিল বিনোদিনী। বিধবা জীবনে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করাটা সে মেনে নিতে পারতো না। বিনোদিনীর অতৃপ্ত বাসনা কে রবীন্দ্রনাথ পাঠক সমলোচকদের কাছে তখনকার দিনে তুলে ধরা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক সৃষ্টি। রবীন্দ্র সৃষ্টি সাহিত্যে মানুষের একটা সমগ্র চিত্র পাওয়া যায়। কবির “চোখের বালি” থেকে আরম্ভ করে সব উপন্যাসই ছিল বাস্তবনিষ্ঠ। “চোখের বালি” (১৩০৮) সালে সাহিত্য উপন্যাসে প্রচলিত ধর্ম এবং প্রকৃতির নতুন বুনিয়াদ সৃষ্টি হয়। বাস্তব অনুভূতি এবং নারী চেতনা পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছিল এই উপন্যাসে। বাংলা সাহিত্যর প্রথম মনস্তত্ব বিশ্লেষণমূলক সমস্যানিষ্ঠ উপন্যাস। এক নিমিষেই ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা “চোখের বালি” বাংলা সাহিত্যর প্রথম প্রবর্তন।
আমাদের সামাজিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার প্রভৃতি নিয়ে যে তর্ক বিতর্ক আলোচনা তারই বা যোগ কোথায়। অথচ গভীরভাবে দেখলে মনে অবশ্যই হবে কবি চিত্তে একটা পূর্ণাঙ্গ অখন্ড দর্শন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ‘চোখের বালি’ গল্পে কিছুটা শিথিল ছিল তবে গল্পে সরলভাবে বর্ণণা করা হয়েছে যে, এমন জটিল মানসিক ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দৃঢ় কঠিন হয়ে ওঠেনি। অথচ বিনোদিনীর সুযোগ থাকা সত্তে¡ও বিনোদিনীর চরিত্র ছিল দুঃসাহসিক এবং বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র।
আশা, বিহারী, মহেন্দ্র, বিনোদিনী এই চারজনের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য উপন্যাসের জটিল ঝড়ের সৃষ্টি করেছিল। মহেন্দ্র আর বিনোদিনীর চরিত্র ছিল জটিল আর আশা ও বিহারী এদের একটা ভিন্ন সম্পর্ক। মহেন্দ্র গোরা হতেই ঝঢ়ড়ৎঃ পযরষফ না চাইতেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ না দিয়েও সবকিছু পাওয়ার মধ্যে আশাকে পেয়েছে।বিনোদিনী সবরকম অবস্থায় অটুট ছিল। প্রেমে পবিত্রতার সাহস তবে সততায় বিনোদিনী কোনরকম কামতৃষ্ণার জল পান করেনি। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে উপন্যাসে জয়ের দিকে নিয়ে গেলেও আত্মবঞ্ছনা হতে মুক্ত করেন নি। তবুও বিনোদিনী চোখের বালি’র একমাত্র সত্য। কারো সংসারে কামবাসনার আগুন পুড়তে দেয়নি বরং নিজ গুণে নিজেকে দীপ্তময়ী করেছে। পাঠককে শ্রদ্ধা ক্ষুন্ন হতে দেয়নি। সমালোচকরা বাংলা সাহিত্যের প্রথম মনস্তাত্বিক উপন্যাস বলে মনে করেন ‘চোখের বালি’কে। কৃষ্ণ কৃপালিনী তাঁর জধনরহফৎধ হধঃয ঞধমড়ৎব, ধ নরড়মৎধঢ়যু (১৯৬২) গ্রন্থে বলেন-‘ওহ হড় ড়ঃযবৎ হবাবৎ যধং যব ধপপবঢ়ঃবফ ঃযব শরহংযরঢ় নবঃবিবহ ংবী ধহফ ষড়াব রিঃয ংঁপয ভৎধহশ ংুসঢ়ধঃযু ঃযব যিরঃব ষড়ঃঁং ড়ভ ষড়াব ৎড়ড়ঃবফ রহ ঃযব ফধৎশ ংষরসব ড়ভ ফবংরৎব. ইঁঃ ংবী যবৎ নববহ শবঢ়ঃ ঁহফবৎ ঢ়ৎড়ঢ়বৎ পড়হঃৎড়ষ. ঘড় যিৎিব যধং রঃ নববহ ধষষড়বিফ. ঞড় ঃৎরঁসঢ়য ড়াবৎ ফবপবহপু ধহফ ফবপড়ৎঁস’
তবে একথা সত্য যে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বিষ বৃক্ষ’তে কুন্দনন্দিনীকে সহানুভ‚তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন; তবে কবিগুরু উজার করে সহানুভূতি দিয়েছেন বিনোদিনীকে ‘চোখের বালি’তে। রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছর পূর্ণ হতে গেলে সেই সময়ে বাঙালি ও ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য যে তার সম্পূর্ণ সাহিত্যের ভূমিকা প্রকাশিত হয়।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে সবরকম শ্রেণীর কর্ম- ধ্যান- জ্ঞান- চিন্তা আদর্শ তাঁর দান অপরিসীম ও প্রদীপ্ত প্রতিভার চিহ্ন সুপরিকল্পিত। রবীন্দ্র সাহিত্যের উপন্যাস আর প্রবন্ধ কে বুঝতে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি।
কবির ব্যক্তিগত জীবন ও সমসাময়িক সমাজে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩০০ সালের ২৬ শে চৈত্র বঙ্কিমচন্দ্রর মৃত্যু হয়; রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৩২ বছর। তাঁর প্রথম উপন্যাস “বৌ ঠাকুরাণীর হাট”। (১২৮৮-৮৯) সালে এবং দ্বিতীয় উপন্যাস “রাজর্ষি” (১২৯২) সালে রচিত হয়। তবে উপন্যাসের সার্থক উপন্যাস “চোখের বালি” রচিত হয় ইহার দশ বৎসর পরে (১৩০৮) সালে। এবং সেই সময়ে রচিত উপন্যাসের মধ্যেই সমাজে মানুষ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। উপন্যাস ও ছোট গল্পে যতটা পাওয়া যায় তেমনি কাব্যে, বিশেষভাবে গীতি কবিতায় সেটা সম্ভব না। রবীন্দ্রনাথ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র। জোড়াসাকোঁর ঠাকুর পরিবারে শালীনতায় বাংলাদেশের অভিজাত সমাজের শ্রেষ্ঠ পরিবারের অন্যতম। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির দুটো ধারার শ্রেষ্ঠ সঙ্গমস্থল। রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক ছিলেন তবে দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, দম্ভ সমস্যা ক্লান্তি সব কিছু বাস্তব ভিত্তিতে বিশ্লেষণের কারণে পাঠক মনে ও সমাজে তাঁর লেখনী