সাহসীরা কখনো হারে না। সেই ষাট দশকের এক পাড়া গ্রামের জন্ম গ্রহণ করেছে এক মেয়ে। যার চলন বলন আলাদা। কারো সাথে মিল নেই, সম্পূর্ণ অন্যরকম। দুরন্তপনার শেষ নেই, পরিবারের সবাই চিন্তিত তার চলার ঢং বলার ঢং দেখে। কাউকেই জমা খরচ দেয় না, ওর মতো ও। গাছে চড়া, লাফানো, ঝাঁপানো, সাঁতার কাঁটা, কারো অন্যায় দেখলে জ্বলে উঠা। ছোট বড় নেই, কেউ তার কাছ থেকে রেহাই পায় না। এই মেয়েটির নামই রুমকী।
রুমকীর বাবা তিন চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে সবার বড়। আর রুমকীও বাড়ির সব নাত-নাতনীদের মধ্যে বড়। মা বাবার বিয়ের বারো বছর পর প্রথম সন্তান। খুব আদরী, সবার আদরে বাঁদড় হয়েছে, পা পরে না মাটিতে লোকে বলে। কেউ কেউ এমনও বলে মিলিটারীর মেয়ে মিলিটারীর স্বভাব পেয়েছে। তবে সামনে বলার সাহস দেখায় না কেউ। গ্রামের মধ্যে শিক্ষিত পয়সাওয়ালা পরিবার। রুমকী কখনো থালায় ভাত নিয়ে পিড়ায় বসে খায় না। দৌঁড়ায় আর দাদী চাচীদের লোকমা খায়। পাঠশালার পন্ডিত ছোটদাদা মাঝে মাঝে বলে- ও বড় হয়ে কি হবে জানি না। আমাদের মান সম্মান জলাঞ্জলি দিবে না কি? রুমকীর বাবা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে সরকারি চাকরি করেন। দু’তিন মাস পর পর পূর্ব পাকিস্তানের নিজ বাড়িতে আসেন। যৌথ পরিবার, চলিশ জনের একসাথে বসবাস, সুখ দুঃখ একা কারো নয়। সবাই সবার সাথে শেয়ারে চলে। রুমকীর বাবা গর্ব করে বলে- আমার সন্তান কখনো খারাপ হবে না, বংশের নাম বাড়াবে। আমার মা অনেক বড় হবে, সমাজের মানুষ চিনবে।
সেসময় একটু পয়সাওয়ালারা লজিং মাষ্টার রেখে বাড়িতে বাচ্চাদের আরবী বাংলা পড়াতেন। রুমকীদের বাড়িতেও রীতি অনুযায়ী লজিং মাষ্টার আছেন। সব বাচ্চারা লজিং মাষ্টার মশায়ের কাছে পড়লেও রুমকী পছন্দ করে না এবং বড়দের কাছে বলছে এ মাষ্টার মশায় ভালো না। উনাকে তাড়িয়ে দিতে কোন দোষও বলছে না। বিষয়টা পন্ডিত দাদা ভাবলো- রুমকী যা বলে তা কোন কারণ ছাড়া অযথা কিছু বলার মেয়ে না। ওর জ্ঞান বুদ্ধি বয়সের তুলনায় একটু বেশীই। হয়তো এমন কিছু দেখছে বা বুঝতে পেরেছে কিন্ত বলতে চাচ্ছে না। ঠিক করলো লজিংমাষ্টারকে বাদ দিবে। বাড়ির সবাইকে ডেকে জানানো হলো, মাষ্টারকে কিছু টাকা দিয়ে বলে দেবে চলে যাওয়ার জন্যে। সবাই একমত হলো। দাদা খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিলেন। একজনের খরচও বেঁচে গেল। সব বাচ্চারা এখন থেকে কোন বিষয়ে খটকা লাগলে ছোটদাদা বা ছোট কাকা অথবা ফাতেমা ফুফুর কাছ থেকে বুঝে নিবে। সব তো পাক্কা বুড়ির মতো বলে দিলে। কেন দাদা ভুল বলছি কিছু। একদমই না, সব ঠিক আছে।
সন্ধ্যার খাবার নিয়ে সবাই ব্যস্ত এদিক দিয়ে রুমকী দেখতে পেল, সালেহ ফুফু মার কাছে কি বলছে আর চোখের পানি মুচ্ছে শাড়ির আচঁলে। ব্যাপারটা বুঝার জন্যে খুব ধীর পায়ে তাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো, সব বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝেছে। ফুফুর খুব কষ্ট ফুফার কারণে। রাতের খাবারও ভালোভাবে খেতে পারলো না রুমকী। কারো দুঃখ কষ্টে আমি এতো কষ্ট পাই কেন? আমার খেতে ইচ্ছে হয় না। সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। মা তো কাউকে কিছু বলতে শুনলাম না। ফুফু বললো আর মা শুনলো, মাকে তো ফুফু নানী ডাকে, ভাবী ডাকে না। আমার মা বাড়ির বড় বউ, সবাই কতো ভালোবাসে, সম্মান করে, তার দায়িত্ব জ্ঞানও তেমন থাকা উচিৎ।
ফুফু শুনো, তুমি এই ফ্রকটা পরবা আর আমি এটা পরবো। শুনি এই দামী জামা কাপড় পরে কোথায় যাওয়া হবে?
কেন স্কুলে? তারপর যদি মন চায় তাহলে–
তারপর কোথায়, তা বললে না তো?
ফুফু কিছু পড়া বাকী, তা আগে পড়িনি।
তোর মনে বার চিন্তা, তোর কি পড়ার চিন্তা মাথায় থাকে।
আচ্ছা ফুফু, এ বাড়ির ছেলে মেয়েরা কি কখনো ফেল করেছে? তা তো করেনি তাহলে তোমরা আমার পিছনে লেগে থাকো কেন?
মোটেও তোর পিছনে কেউ লেগে নেই। তোর রেজাল্ট আরেকটু ভালো করা উচিৎ নয়?
দেখ ফুফু, আমার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যারিষ্টার হওয়ার চিন্তা নেই, একজন মানুষ হতে চাই।
স্কুলে এসেও মনটাকে স্থির রাখতে পারছে না। বার বার সালেহা ফুফুর করুণ দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ফুফু এমন করে কাঁদলো, কতো কষ্ট। যা আছে কপালে, কেমন মেয়ের কারণে ফুফুর এতো কষ্ট তা আমি দেখেই ছাড়বো। ফাতেমা ফুফুটা লেখাপড়ায় ভালো ক্লাসে ফাষ্ট হয় কিন্ত গাধা গাধা ভাব নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভাবে না। খাওয়া পড়া স্কুলে আসা যাওয়া এই তার কাজ। আর আমি সারাক্ষণ কিযে নিয়ে ভাবি, ধ্যাত ছাই।
ফুফু এখন তো টিফিন আওয়ার, চলো এক জায়গায় যাই।
কোথায় যাবো? আরো দুইটা বিষয়ের ক্লাস বাকি আছে।
তা জানি।
যাবে কি না বলো?
না যেয়ে কি উপায় আছে।
তাহলে চলো। সোজা দক্ষিণ দিকে। দু’জন হাটঁছে চুপচাপ। ফাতেমা ভাবছে আর কোথায় রুমকী মামার বাড়ি যাবে হয়তো। বেশ রাস্তা পার হলো, তাকিয়ে দেখে রুমকীর মামার বাড়ি পার হয়ে গেছে। এই রুমকী বলতো কোথায় যাইতে শুরু করলে, বাবারে, বাবারে, এই মেয়েটার পালায় পরে পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে যে।
ফুফু এমন করো না, আর একটু হাঁটো।
কোথায় যাবে বল না। বাড়ৈগাও পার হয়ে গেলাম, সাতপাড়ার কাছাকাছি প্রায় চলে আসছি।
এইতো ফুফু বলে এক বাড়ির ভেতর ঢুকে পরলো। কোন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। কি যে মেয়েটা ! আলাহ ছাড়া ওর মতিগতি কেউ বুঝার উপায় নাই। রুমকী ডাকতে লাগল- খালা বাড়ি আছেন গো। ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো কে গো? আরে খালা আগে কাছে আসেন তারপর তো দেখবেন।
তোমরা কারা চিনি নাতো।
আমি বাড়ৈগায়ের জালালের ভাগনী। আমার নাম রুমকী আর ও আমার ফুফু ফাতেমা।
স্কুল থেকে আসছো মনে হচ্ছে। কে কোন ক্লাসে পড়?
আমি ক্লাস ফোরে আর ফুফু ক্লাশ এইটে।
অহনা মনে মনে ভাবছে বাহ খুব ছটফটা মেয়েরে। গ্রামের মেয়ে বলে মনেই হয় না। কোন স্কুলে পড়ো?
মোহর পাড়া স্কুলে পড়ি।
বসো তোমরা, আমি আসছি।
কোথায় যাবেন?
এমন সময় কেউ কারো বাড়ি আসলে কিছু খেতে হয়। না খাবো না।
না বললেই হবে না কি? বসো, বেশী সময় লাগবে না। বাড়িতে কেউ নেই আমি একাই আছি। ভাবী বাপের বাড়ি গেছে আর বাবা দাদা ক্ষেতে গেছে। বেশী দেরী হলো না, কথা বলার মাঝেই চানাচুর আর কিছু আম কেটে নিয়ে আসলো। কেরোসিনের চুলায় দুধের মধ্যে কলের সেমাই চিনি দিলো। একদম মনে হলো আমরা আসবো তা যেন আগে থেকেই জানতো। এতো ঝটপট খাবারগুলো সামনে দিলো। মুখে না বললে কি হবে, পেটে তো খাবার চাচ্ছে। খেতে খেতে রুমকী বললো- খালা ডাকলাম মামার বাড়ির আশেপাশের হিসাবে। আমরা তমিজউদ্দিন ড্রাইভারের বাড়ির। উনিতো আপনাকে বেশ পছন্দ করেন জানি। প্রতি বৃহস্পতিবার ঘোড়াশাল থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে আপনার সাথে দেখা করে, তারপর বাড়ি যান। আপনাকে উপহার দেয় তো?
এই মাঝে মধ্যে পাউডার, স্নো, সাবান দেয়।
খুব ভালো।
এর মধ্যে খাওয়া শেষ হলো। খুব তাড়িতাড়ি এতো কিছু করলেন আর খালাগো ঋণী করে ফেললেন।
কি যা তা বলছো, তেমন কি করলাম। ভাত খাওয়াতে পারলাম না । যথেষ্ট করেছেন, এইটুকুই বা ক’জন করে কার জন্যে, অনেক ধন্যবাদ। উঠতে হবে, আপনাকে দেখার খুব সখ ছিলো।
এখনই চলে যাবে ?
ভালো থাকেন বলে উঠে হাঁটা শুরু করলো। সাথে সাথে অহনাও তাদের পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো। গ্রামের রীতি মেহমান বাড়ি আসলে তাকে এগিয়ে দিতে হয়। মেহমান বাড়ির রহমত নিয়ে আসে, তাকে আদরের সাথে যতœ করে খাওয়াতে হয়, বিদায় দিতে হয় কিছু পথ এগিয়ে। কিছুদূর এগিয়ে রুমকী আম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পড়লো। খালা কিছু সত্য কথা বলি। তমিজউদ্দিন ড্রাইভার বিয়ে করেছে যাকে তার ভাই নেই। সে অনেক সম্পদের মালিক, তাকে কখনো তালাক দিবে না আর আপনিও নিশ্চয় সতিনের সংসারে যাবেন না? কাজেই আপনার তার সাথে আর কথা না বলাই ভালো। এইখানেই সম্পর্কটা শেষ করে দেয়া ভালো। বেটারা মেয়ে মানুষ নিয়ে মজা করে। নষ্ট হয় মেয়ে মানুষ আর বেটারা জলে ধোয়া তুলসী বুঝলেন খালা। সমাজ নষ্ট বলবে আপনাকে। তমিজ উদ্দিনের বউয়ের চাচাতো জেঠাতো ভাইগুলো গুন্ডা পান্ডার সেরা একেকটা। ইউসুফ মেম্ব^ারের নাম শুনেছেন নিশ্চয়, এবার ফেল করতো। যখন দেখলো পাস করবে না তখন আমার এক চাচা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পুলিশের নাকের উপর পড়লো, আর নাক ফেটে গড় গড় করে রক্ত পরতে লাগলো। সবার নজর পুলিশের দিকে আর আমরা সব পিচ্চিরা সীল মেরে বাক্স ভরে দিলাম, জেঠা বিপুল ভোটে জয়ী । কি বুঝলেন? যান, বাড়ি চলে যান।
বুঝলে ফুফু সন্দেহযুক্ত বিশ্বাসহীন সম্পর্ক মরে যায়।
কি বললে? এতো সব বুঝি না, তাড়াতাড়ি হাঁটো। বাড়িতে গিয়ে কতো জবাবদিহি করতে হবে।
কেন?
এক কথা, স্কুলে ক্লাস দেরিতে শেষ হয়েছে।
লেখক: কবি, গল্পকার; সদস্য-বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশনা বিজ্ঞপ্তি
পাবনা থেকে প্রকাশিত রুচিশীল সাহিত্য পত্রিকা মাসিক অনন্য কথা’ পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশ হবে আগামী আশ্বিন ১৪২৮এ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ’২০২১ মাসে। সকল সদস্য ও শুভার্থীদের আগামী ৫ সেপ্টেম্বর ২১ এর মধ্যে লেখা প্রেরণের জন্য আহŸান জানানো হলো। সম্পাদক, ‘অনন্য কথা’ পাবনা।