• Wed. Nov 20th, 2024

‘বিদ্রোহী’ লিগের ঘোষণায় তোলপাড় ফুটবল বিশ্বে, জেনে নিন আদ্যোপান্ত

কাঁপন ধরে গেছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা উয়েফার। আর আবছা হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ভবিষ্যতও। রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ফ্লোরিন্তিনো পেরেজকে সভাপতি করে রোববার (১৮ এপ্রিল) রাতে ঘোষণা এসেছে ইউরোপিয়ান সুপার লিগের। ইউরোপের শীর্ষ ১২টি ক্লাব নিয়ে এ বছরের আগস্টেই মাঠে গড়াতে পারে নতুন এই সুপার লিগ। ইতোমধ্যেই ইউরোপিয়ান শীর্ষ ক্লাবগুলো অফিসিয়ালি এই টুর্নামেন্ট নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে। এমন ঘোষণা আসার পর জরুরি ভিত্তিতে সুইজারল্যান্ডে উয়েফার বৈঠক থেকে কড়া হুঁশিয়ারি এসেছে এই ১২ ক্লাব এবং ক্লাবের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে। তবে তাতে থোড়াই কিছু মনে করছেন এই ক্লাবগুলো। সুপার লিগের প্রধান ফ্লোরিন্তিনো পেরেজ ইতোমধ্যেই একটি সাক্ষাৎকারে সবকিছুর খোলাসা করেছেন। জানিয়েছেন ফুটবলকে বাঁচাতেই তাদের এই সিদ্ধান্ত। আর ক্লাবগুলোকে লোকসান থেকে বাঁচিয়ে লাভের মুখ দেখানোটাই প্রধান লক্ষ্য। আর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে সমর্থকদের কাছে ফুটবলকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলাটাই এই সুপার লিগের মূল উদ্দেশ্য।
তবে ইউরোপিয়ান সুপার লিগকে ইতোমধ্যেই ‘বিদ্রোহী লিগ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে উয়েফা। এর পেছনের কারণ হচ্ছে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগকে বাদ দিয়ে এই লিগ চালু করার ভাবনা তাদের। অর্থাৎ সুপার লিগ চালু হলে চিরতরে হারিয়ে যাবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ।
কি এই ইউরোপিয়ান সুপার লিগ (বিদ্রোহী লিগ)?
২০০৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে শঙ্কাটা প্রকাশ করেছিলেন আর্সেনালের সাবেক কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। ইউরোপিয়ান ফুটবলের ভেতরে-ভেতরে বেশ কিছু কর্তা-ব্যক্তি নাকি জোট বেঁধেছেন, সেরা ক্লাবগুলোকে নিয়ে আলাদা একটা লিগ করার জন্য। মাঝে এ নিয়ে দীর্ঘ সময় কিছু শোনা যায়নি। ফিসফাস শুরু হয় গত বছর থেকে। দর্শক-সমর্থকদের কথা মাথায় রেখে একই মৌসুমে ইউরোপের বড় বড় দলকে অন্তত একবার মুখোমুখি করাতে ‘ইউরোপিয়ান সুপার লিগ’ নামে একটা টুর্নামেন্টের কথা নাকি ভাবা হচ্ছে।
ইএসএল এক বিবৃতিতে জানায়, আরও তিনটি ক্লাব রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলোর তালিকায়। অর্থাৎ মোট ১৫টি ক্লাব। এই ১৫ দল সব সময় এই লিগে থাকবে। আরও পাঁচ দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে প্রতি মৌসুমে। অর্থাৎ মোট ২০ দল নিয়ে হবে সুপার লিগ।
নতুন ফরম্যাটে আসছে চ্যাম্পিয়নস লিগ
এই ২০ দল দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে গ্রুপ পর্বে লড়বে। এখনকার মতোই ‘হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ ভিত্তিতে ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি গ্রুপ থেকে শীর্ষ তিন দল উঠবে কোয়ার্টার ফাইনালে। বাকি দুটি স্থানের জন্য দুটি গ্রুপের চতুর্থ ও পঞ্চম দল দুই লেগের প্লে-অফ ম্যাচ খেলবে। এরপর বাকি পথটা চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো। ফাইনাল ছাড়া কোয়ার্টার ও সেমিফাইনাল হবে দুই লেগের ভিত্তিতে। আর্থিক বিষয় নিয়ে আয়োজকেরা জানিয়েছেন ‘বর্তমান ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার তুলনায় বেশি অর্থ আয় হবে।’ নতুন এই লিগে অংশ নেওয়ার জন্য ‘প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলো ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো করে পাবে।
কাদের হাত ধরে আসছে এই সুপার লিগ?
সুপার লিগের (ইএসএল) প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ১২টি ক্লাবের কথা জানানো হয়েছে ইএসএলের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে রয়েছে ছয়টি ক্লাব: লিভারপুল, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে রয়েছে ছয়টি ক্লাব: লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল, চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহাম হটস্পার্স। স্পেন থেকে আছে: রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও অ্যালেটিকো মাদ্রিদ। ইতালিয়ান সিরি ‘আ’ থেকে: জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান ও এসি মিলান।
এই ১২ ক্লাবের সঙ্গে আরও তিনটি ক্লাব শিগগিরই যোগ দেবে বলে জানায় সুপার লিগ কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে থাকবে এই ১৫টি ক্লাব।
তবে এই ১৫টি দলের তালিকায় নেই এখন পর্যন্ত কোনো জার্মান ও ফ্রেন্স ক্লাবের নাম শোনা যায়নি। ইউরোপের অন্যতম দুই পাওয়ার হাউজ বায়ার্ন মিউনিখ ও প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে এই তালিকায় না দেখে অবাক হতে দেখা গেছে অনেককেই।
সেমিফাইনালের আগেই বহিষ্কার হতে পারে রিয়াল, ম্যানসিটি ও চেলসি
তবে সোমবার রাতে ইএসএল’র প্রথম প্রেসিডেন্ট ফ্লোরিন্তিনো পেরেজ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তারা ইউরোপিয়ান সুপার লিগে অংশগ্রহণের জন্য প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে আমন্ত্রণই জানায়নি। তবে পিএসজি নিয়ে কথা বললেও বায়ার্ন মিউনিখ কিংবা জার্মান আর কোনো ক্লাব কেন নেই এই তালিকায় তা নিয়ে মুখ খোলেননি পেরেজ।
ইউরোপিয়ান সুপার লিগের গভার্নিং বডির তালিকা:
চেয়ারম্যান: ফ্লোরিন্তিনো পেরেজ (রিয়াল মাদ্রিদ)
ভাইস চেয়ারম্যান: স্ট্যান ক্রোয়েঙ্কে (আর্সেনাল)
ভাইস চেয়ারম্যান: আন্দ্রেয়া অ্যাগ্নেলি (জুভেন্টাস)
ভাইস চেয়ারম্যান: জোয়েল গ্লেজার (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)।
বায়ার্ন ও পিএসজি না থাকার কারণ:
ইউরোপের সব শীর্ষ ক্লাব নতুন এই সুপার লিগে অংশ নেওয়ার কথা অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়ে জানালেও দেখা মেলেনি অন্যতম পাওয়ার হাউজ দুই ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ এবং প্যারিস সেইন্ট জার্মেই-কে। তবে কি তাদের বাইরে রেখেই মাঠে গড়ানোর সিদ্ধান্ত সুপার লিগের?সুপার লিগ নিয়ে সোমবার নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে ডর্টমুন্ড। ক্লাবটির প্রধান নির্বাহী হান্স ইয়োখিম ভাটসকে বলেন, বায়ার্নের পাশাপাশি তারাও ইউরোপিয়ান ক্লাব অ্যাসোসিয়েশনের (ইসিএ) প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। ‘ইসিএ এর বোর্ড সদস্যরা রোববার এক ভার্চুয়াল বৈঠকে মিলিত হয়েছিল, সেখানে গত শুক্রবার বোর্ডের নেওয়া সিদ্ধান্তে অটল থাকার ব্যাপারে একমত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়, সব ক্লাব চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলি বাস্তবায়ন করতে চায়। সুপার লিগ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল ইসিএ এর বোর্ড সদস্যরা। ইসিএ বোর্ডের দুই জার্মান ক্লাব, বায়ার্ন মিউনিখ ও বর“শিয়া ডর্টমুন্ড সব আলোচনার ক্ষেত্রে একই অবস্থান নিয়েছে।’
এদিকে পিএসজি প্রেসিডেন্ট নাসের আল খেলাইফি বর্তমান উয়েফার গভর্নিং বডির নানান দ্বায়িত্বে আছেন। এছাড়াও নতুন প্রস্তাবিত চ্যাম্পিয়নস লিগের মডেলে ভোটও দিয়েছেন তিনি। তাই তো সুপার লিগের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবের তালিকায় নেই পিএসজি। আর গতরাতে ইএসএল প্রেসিডেন্ট ফ্লোরিন্তিনো পেরেজ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, পিএসজিকে সুপার লিগে খেলার আমন্ত্রণ জানানোই হয়নি।
এছাড়া পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তো জানিয়েছে, ইউরোপিয়ান সুপার লিগে খেলার আমন্ত্রণ তারা পেয়েছে কিন্তু উয়েফা এবং ইইউর কারণে তারা সুপার লিগকে ‘না’ বলে দিয়েছেন।
বিদ্রোহী লিগ নিয়ে উয়েফার হুঁশিয়ারি:
ইউরোপিয়ান সুপার লিগের ঘোষণার আসার পর হুমকির মুখে পড়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাকর টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস লিগের অস্তিত্বের। আর তাই তো চ্যাম্পিয়নস লিগকে বাঁচাতে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থায় গ্রহণ করবে উয়েফা। তাই তো সোমবার (১৯ এপ্রিল) জরুরি বৈঠকও ডাকে তারা। বৈঠক শেষে কঠোর হুঁশিয়ারি জানিয়েছে ওই ১২টি প্রতিষ্ঠাতা ক্লাব এবং ক্লাবের ফুটবলারদের। জরুরি বৈঠক শেষে সেটাই হুশিয়ারির সঙ্গে উচ্চারণ করলেন সংস্থাটির সভাপতি।
উয়েফার সভাপতি আলেক্সান্ডার ক্যাফেরিন কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান দিলেন, সুপার লিগে অংশগ্রহণ করলে কোনো খেলোয়াড় জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবেন না।
আলেক্সান্ডার ক্যাফেরিন বলেন, ‘কিছু ক্লাবের স্বার্থের জন্য করা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ফুটবল বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা একমত সুপার লিগ একটি অর্থহীন প্রকল্প। এফএ, লা লিগা, সিরি আ, ফিফা, এফইএফ, প্রিমিয়ার লিগ সবাই এই উদ্ভট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। আমরা এই পরিবর্তনের অনুমতি দিচ্ছি না। এই লিগে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়রা তাদের জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবে না।’ নতুন এই সুপার লিগের আবির্ভাবের পরপরই বিবৃতি দিয়ে হুশিয়ার করেছে উয়েফা। তারা এই ১২টি ক্লাবকে সতর্ক করে জানিয়েছে যে, কেউ যদি এই বিদ্রোহী টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে তবে তারা চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বহিষ্কার হবে। এছাড়াও প্রত্যেকটি শীর্ষ ঘরোয়া লিগ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি বৈঠকও করেছে উয়েফা। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার স্মরাণাপন্নও হয়েছে তারা।
ফিফা এ ব্যাপারে যা বলছে-
সুপার লিগের আত্মপ্রকাশের পর পর কড়া হুঁশিয়ারি বাণী শুনিয়েছিল ফুটবলার সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। জানান দিয়েছিল সুপার লিগে অংশগ্রহণ করা ফুটবলাররা জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবেন না। তবে পরবর্তীতে সুর পাল্টে তারা নরম হয়েছে। আর ফুটবলের সকল সংস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যাতে করে আটকানো সুপার লিগ।
কবে নাগাদ মাঠে গড়াবে সুপার লিগ?
২০২১ সালেই সুপার লিগ মাঠে গড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে কর্তৃপক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে ২০২১ সালের আগস্টেই এই টুর্নামেন্টের প্রথম আসর মাঠে গড়াতে পারে।
সুপার লিগের প্রেসিডেন্ট পেরেজ বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই টুর্নামেন্ট শুরু করার চেষ্টা করব। আমরা উয়েফা এবং ফিফার সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনা করব। আমি বুঝতে পারছি না তারা রেগে কেন আছে।’
আসবে যেখান থেকে এত অর্থ-
সুপার লিগ নিয়ে ১২টি ক্লাবের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
‘প্রতিষ্ঠাতা ১২টি ক্লাব ৩.৫ বিলিয়ন ইউরো করে পাবে, করোনার আঘাত কাটিয়ে নিজেদের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য।’ আরও বলা হয়, ‘বার্ষিক এই টুর্নামেন্ট ইউরোপিয়ান ফুটবলের শক্তি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে।’ চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দল এখন যে প্রাইজমানি পেয়ে থাকে, তার চেয়েও সুপার লিগের দলগুলো অনেক বেশি টাকা পাবে।
এর আগে ফরাসি সংবাদমাধ্যম ‘লা পারিসিয়েন’ জানিয়েছিল, সুপার লিগের ‘শীর্ষ ছয় দল মৌসুমে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো পাবে। বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ বিজয়ী আট কোটি ইউরোর কাছাকাছি আয়ের আশা করতে পারে।’
আর এসকল অর্থের যোগান দেবে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ভিত্তিক ব্যাংক জেপি মরগান। ধারণা করা হচ্ছে প্রাথমিকভাবেই ৬ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করবে এই ব্যাংক। সৌজন্য: সাহাবার সাগর, সারা বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *