• Wed. Nov 20th, 2024

আমাদের বাড়ির পাশেই সোনাবরু বাড়ি। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ার কারণে আমার সুযােগ হয়েছে তাদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার । সোনাবরু তার আসল নাম নয়। আসল নাম হলো ফেরদৌসি আক্তার । মিষ্টি মেয়ে হাসি খুশি প্রাণ চঞ্চল আর সোনার মতো মুখ বলেই লোকে তাকে আদর করে সোনাবরু নামে ডাকে। এনামে ডাকলে তার মনে হয় ভালোই লাগে। তাইতো যে কেউ সোনাবরু বলে ডাকলে সত্যিই সে সোনার মতো সোহাগী হয়ে ওঠে। তার ভিতরে বাহিরে একটা আনন্দ এসে ঝিলিক দিয়ে যায়। ছোট মেয়ে সোনাবরু । পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। দুই ভাই আর একমাত্র বোন ও মাকে নিয়ে তাদের সংসার ছিল অভাব অনটনের । নুন আনতে পানতা ফুরায়। তাই বাবার মৃত্যু হয় চিকিৎসার অভাবে । বাবার সারা দিনের রুজিতে রীতিমতো তিনবেলা খাবারই জুটতাে না। অমন অবস্থায় সোনাবরু বাবার অসুখ হয়। সোনাবরু মুখ থেকে শুনেছি তার বাবার নাকি কালা জ্বর হয়েছিল । দৈন্য আর হাভাতের সংসারে নিয়মতি চুলায় হাড়িই উঠতো না। তাও আবার কালাজ্বর চিকিৎসার করবে কি দিয়ে। সোনাবরু রমা জানে শহরে বড় বড় ডাক্তার থাকে। সেখানে নিয়ে চিকিৎসা করা সে মেলা টাকার দরকার । এতো টাকা কোথায় পাবে? অবহেলায় অনাদরে দারিদ্রতার কষাঘাতে সোনাবরু বাবার বুকটা ঝাঝরা হয়ে যায় । এমনি করে ধীরে ধীরে অস্তমিত সূর্যের মতাে সোনাবরু বাবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে এবং তার পরিবারে নেমে আসে গভীর অন্ধকার ।। স্বামীকে হারিয়ে ছােট ছােট ছেলে মেয়েদের নিয়ে সখিনা বেগম জীবন যুদ্ধে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। সন্তানদের মুখে একমুঠোভাত তুলে দিতে সখিনা বেগম ব্যাকুল । অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা একটু আধটু পায়, তা দিয়ে কোন মতে তাদের সংসার চলে কিন্তু দিন আর কাটতে চায় না । জীবন যেন চলতে চলতে থেমে যেতে চায় । সোনাবরু বড় ভাই মানিককে তার মা বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে অল্প বয়সেই কাজে দিয়ে দেয়। পাওয়ার ট্রিলারে জমি চাষের কাজ মানিক সহজেই শিখে নেয়। থাকা খাওয়ার সাথে সাথে মানিক কিছু টাকা বেতনও পেতে শুরু করে। মানিক স্বপ্ন দেখে সে একদিন অনেক টাকা কামাবে। তাদের আর অভাব থাকবে না। সে কামাই করে মায়ের দু:খ ঘুচাবে এবং ছোট বাই ও বোনকে সে পড়াশুনা শিখাবে। যাতে তার মতো কষ্ট করে কাজ করতে না হয়। সোনাবরু ছোট বেলা থেকেই স্কুলে যায়। এবং সে পড়া শুনায় অনেক মনােযােগী আর তার সাথে সাথে ক্লাসে সবার কাছে সোনাবরু সোনামণি হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় সে ক্লাসের প্রথম স্থান লাভ করে । জয় করে নেয় শিক্ষক শিক্ষিকা সহ সবার মন । তাই সবাই তাকে অনেক বেশি আদর করে । সোনাবরু সােনামুখে মুক্ত ছড়ানো হাসি দিয়ে ক্লাস ভরিয়ে রাখে । পড়াশুনায় যেমন ফার্স্ট তেমনি সবার কাছে অতি আদরের সোনাবরু । এবার সোনাবরু পঞ্চম শ্রেণীতে । আগের মতোই এবারও সে প্রথম। সোনাবরু সংসারের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারও বুঝি বুঝতে শিখেছে। বয়স সবে মাত্র এগার। কতোইবা বড় হয়েছে। কিন্তু আজকাল সোনাবরু সোনামুখটাও মাঝে মাঝে ফিকে হয়ে যায়, যখন ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তবুও তীব্র দারিদ্রতার উত্তাপ মা সখিনা বেগম শীতল স্পর্শভেবে সহ্য করে নেয়। মাঝে মাঝে মায়ের মুখেও ক্ষুধার ছায়া পড়লে তা আড়াল করতে চায় শুকননা হাসি দিয়ে। সন্তানের মুখে খাবার না দিতে পারলে মায়ের মুখের খাবার যে কখনোই গলা বেয়ে উদরে প্রবেশ করতে পারে না। যেন মায়ের পেট থেকে নাড়ি ভুড়ি বেরিয়ে আসতে চায় । ইদানিং সোনাবরু মাকে বুঝতে শুরু করেছে । সমস্যা যা এখানেই, মা আর মেয়ের কাছ থেকে কোন কিছু সোনাবরু কাছে মা যেন ক্রমেই দর্পনের মতো পরিস্কার হয়ে যেতে থাকে। মা বলে কথা। তাই মেয়েকে সহজেই লুকাতে পারে না। এটা ওটা বলে নিজেকে লুকাতে চায়। একদিন সোনাবরু আমাকে বলল দাদা ভাই তোমাকে একটা কথা বলবো । আমি মাঝে মাঝে আদর করে তাকে বুড়ি বলে ডাকতাম। আমি বললাম, কি কথা বলবিরে সোনাবুড়ি । আমার কথা শুনেই আচমকা হাসি দিয়ে লজ্জা জড়িত কণ্ঠে বলল, ছি ছি, দাদা ভাই ও কথাকি বলতে আছে? আনত নয়নে মিটিমিটি করে বলল সব কিছু বলতে হয় না। কিছু বুঝতে হয়। তুমি কি কিছু বুঝনা? এই প্রথম সোনাবরুকে বুঝতে পারলাম না । তাছাড়া সোনাবরু আমার কাছে ভিতরে বাহিরে এক। সোনাবরু কি কথা বলতে গিয়ে চুপসে গেল তা আমি বুঝতে পারলাম না। আর বুঝতে চেষ্টাও করলাম না। কারণ যদি কোন কিছু বলার মতো হয় তাহলে আমি জানি বুড়ি আমাকে বলবেই। সেটা আজ হোক আর কালই হোক। সোনাবরু জন্মের পরে এতোটুকু বড় হয়েছে কিন্তু বাবা বলে একটি ডাকও দিতে পারেনি। বাবাকে চোখে হয়তো দেখেছে। বাবা কোলে নিয়ে আদর করেছে, চুমুয় চুমুয় দুটি গাল ভরিয়ে দিয়েছে। তখন যে সোনাবরু বাবা কাকে বলে তাও জানে না। এখন সখিনা বেগমই তার বাবা-মা। সখিনা বেগম প্রাণ পনে চেষ্টা করে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে। তার সেজন্যই প্রতিনিয়ত নিরবধি জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। একবার সোনাবরু জ্বর হয়। তাকে নিয়ে মা সখিনা বেগম গায়ের ডাক্তার আপার কাছে গেলে ডাক্তার আপা সােনার মতো কোমল মতি মুখটি দেখে অনেক আদর করে। ডাক্তার তাকে চিকিৎসা করে, ঔষধপাতি দেয়। বিনিময়ে একটি টাকাও নেয়নি। বরং ডাক্তার সোনাবরুকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলে তুমি কিছু খেয়ো । বুড়ি তো অনেক খুশী। আর মনে মনে ভাবে ডাক্তার আপা অনেক ভালো মানুষ। একটি টাকাও
নেয়নি, বরং আমাকে আদর করে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে । বুড়ি হঠাৎ একদিন আমাকে বলে, আচ্ছা ভাইয়া ডাক্তার হতে কি মেলা টাকা লাগে? আমি বললাম কেনরে হঠাৎ একথা, এই বুঝি তুই বলতে চেয়েছিলি । সে বলল, না দাদা ভাই সে কথা তােমাকে আমি বলতে পারবো না। তুমি নিজেই বুঝবে । আমি আরাে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ছােট্ট বুড়িকে জিজ্ঞেসও করতে পারিনে, আবার আমি জানিও না আমি কি বুঝব । হয়তো একটা কিছু হবে । তা পরে দেখব। আমি জানি বুড়ি পড়াশুনায় খুবই ভালাে । আমি বললাম তুমি ভালো মতাে পড়াশুনা কর তুমি তাহলে ডাক্তার হতে পারবে। তােমার কোন টাকাই লাগবে না। বরং ডাক্তার হয়ে মানুষের চিকিৎসা করে তুমি অনেক টাকা রােজগার করবে। অনেক বড় হবে । আমার কথা শুনে বুড়ির চোখে মুখে আনন্দের জোয়ার বইছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কল্পনায় সে নিজেকে ডাক্তার মনে করছে । আমি আরাে বললাম তখন তােমাদের কোন কষ্ট থাকবে না। তােমার অনেক টাকা হবে, বাড়ি গাড়ি হবে। তােমার মাকে আর তোমার ভাইকে কষ্ট করে কাজ করতে হবে না। কথা গুলো শুনে খুশী সোনাবরু । বুড়ির যেমন মনে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল তেমনি পরক্ষণে মনে বেদনার নীল তাকে বিমর্ষ করে। সে জানে তার বাবার মৃত্যু হয়েছিল চিকিৎসার অভাবে । তাই সে ডাক্তার হয়ে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা করবে বিনা। পয়াসায় । গরীব দু:খী মানুষের ব্যাথা সোনাবরু চেয়ে কে ভালো জানে। এজন্যই বুঝি ডাক্তার হয়ে গরীব দু:খী মানুষের পাশে দাড়াতে চায় । হয়তো সে ভাবে আর একটি বাবাও বিনা চিকিৎসায় মরবে না তাই তার স্বপ্ন সে ডাক্তার হবে । আজকাল বুড়ি পড়াশুনায় আরাে বেশি মনোযোগী। শুনেছি বাড়িতেও নাকি একজনের কাছে পড়ে। ও পাড়ার একজন মেয়ে নাকি ওকে এসে পড়িয়ে যায় । আমি বললাম টাকা কত দিতে হবে। বুড়ি বলে আপা কোন টাকা নিবেনা । আমাকে আদর করে মাঝে মাঝে চকলেট নিয়ে আসে, এবং আমার খুব যতœ নেয় যেন পড়াশুনায় আরো ভালো করতে পারি। আমি মনে মনে ভাবতাম বুড়িকে আমি অনেক আদর করি। তাই বলে কিছু শাসনও করা দরকার আছে, সেজন্য অনেক সময় আমি তাকে আমার আদর ভালােবাসা সম্পূর্ণ বুঝতে দিতাম না কারণ আদরে আদরে যেন ভয় ও শ্রদ্ধা না হারায়। বুড়ির জন্য কিছু না করতে পারলেও কম আদর সোহাগ করতামনা। আমার একটি ছোটবোন ছিল, ছােট থেকে সে কবে যেন বড় হয়ে গেল । একসময় ওর বিয়েও হয়ে গেল। ওর বিযের আগে যেমন আদর স্নেহ করতাম, তেমনি খুনসুটিও কম হতো না। এমনি করে একটি মজার সময় কেটে গেল ওর বিয়ের আগ পর্যন্ত সোনাবরুকেই এখন ছোট বোনের মতো আদার করি। মনে পড়ে, তার মাকে বলছিল, মা সবাই নতুন নতুন জামা পড়ে স্কুলে আসে আমার আর পুরনো জামা পড়ে স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। মায়ের কাছে সন্তানের সামান্য একটি আবদারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর মা যদি সন্তানের যে দাবি মিটাতে না পারে তাহলে মায়ের মুখটা শুকনো রুটির মতো হয়ে যায়, এবং অন্তরে দু:খের কালো মেঘ জমতে থাকে। এতো ঝড়ের মধ্যে সখিনা বেগম তার চেষ্টার কোন কমতি করেনি তার। সন্তানদের আবদার রক্ষার্থে। মা তার মেয়ের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনে আনে । সেগুলো সেলাই করতে দেয় পাড়ারই এক মহিলা দর্জির কাছে। কষ্ট করে হলেও মা তাকে এক সাথে তিন সেট জামা বানিয়ে দেয়। মানিক জমি চাষের কাজ করে কিছু টাকা পায়, আর মায়ের এ বাড়িতে ও বাড়িতে কাজ করে সামান্য যা পায় তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলে। সোনাবরু বাবার মৃত্যুর পর জন্ম হয় ছােট ভাই অনিকের । এখন অনিকও স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ছোট কচি খােকা, সোনার মতো মুখ । মায়ের কাছে এটা ওটা চায়। অনেক সময় অনেক কিছু বায়না ধরে । না পেলে স্কুলে যেতে চায় না। অবুঝ শিশুকে হতভাগী মা বুঝবে কি করে । সন্তানের কাছে যেন মা নিজেই অবুঝ । চেষ্টা করে তাদের সকল দাবি পুরনের । মায়ের ঝামেলা যা একটু অনিককে নিয়ে। সোনাবরু েেক নিয়ে এখন আর মাকে ভাবতে হয় না। সে এখন অনেক বুঝতে শিখেছে । তাই কখনো যদি মায়ের মন খারাপ দেখে সোনাবরু রই মাকে সাšন্তনা দেয় । বলে মা একদিন আমাগোর কোন অভাব থাকব না। তুমি দেখো আমি ডাক্তার হয়ে অনেক টাকা রোজগার করবাে । গরীব দু:খী মানুষের সেবা করবাে। আমাদের সুন্দর বাড়ি হবে তােমাকে একটা গাড়ি কিনে দিব । এসব কথা বলতে গিয়ে সোনাবরু চোখের কোনে আনন্দ অশ্রু এসে সিক্ত করে দেয়। আর মা ভাবে হতভাগী মেয়ের কথা ভাবে এতো সুখ জীবনে সইবে কিনা, যেন স্বপ্নের মত মনে হয় । মা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। যদি স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় । তাই সখিনা বেগম নিজের জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের সুখী করে তুলতে চায়। এ বুঝি সৃষ্টিকর্তারই বিধান। তিনি যে সকল মাকেই মনে গভীর স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা আর মমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই বুঝি মা তার সন্তানদেরকে শত সহস্র কষ্ট যন্ত্রনা সয়েও বুকে আগলে রাখে গভীর মমতায় । সোনাবরু একরোখা মেয়ে। যা বলবে, তাই করবে, আর যদি মাকে কখনো মন খারাপ দেখে, শাসনও কম করে না । এক বিকেলে বুড়ি এসে আমাকে বলে, ভাইয়া কিছু বুঝ নাকি। আমি বললাম কি বুঝবরে পাকা বুড়ি কোথাকার। এটুকুন আমি বললাম কি বুঝবরে পাকা বুড়ি কোথাকার। এটুকুন মেয়ের এতাে রহস্যময় কথার মানে আমি আসলে আজও বুঝিনি । ও এমনিতে যেমন মেধাবী তেমনি বুদ্ধিমতী। বুড়িকে বলি বড় পাকা হয়ে গেছিস। তোকে একটা বিয়ে দেয়া দরকার । সে বলে যাও ভাইয়া কিযে বলো না । আমার বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি। তুমি জান না বাল্য বিবাহ অপরাধের কাজ। বুড়ি বলে ভাইয়া দেখনা ওপাড়ার আপু আমাকে পড়াতে আসে। খুব ভালো আপু। সেও তােমার থেকে আমাকে কম আদর করে না । আমি বললাম এসব বলে বলে আরো বেশি আদর পাওয়ার চেষ্টা চলছে বুঝি। বুড়ি বলে ওহ ভাইয়া তুমি বুঝনা আমি কি সে কথা বলেছি নাকি? আর তুমিতো শুধু বলাে এটা করোনা ওটা করোনা, যত সব তোমার বিধি নিষেধ। আমি মনে মনে ভাবি বুড়ি তুমি ঠিকই বলেছ । আমার আদর স্নেহ এরকমই। আমি যে তোমাকে বেশি ভালোবাসি, তাইতো এতো শাসন । সে তুমি এখন বুঝবেনা । বুড়ি বলে আপু অনেক ভালো আমাকে আদর করে, চকলেট দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলি হয়েছে এবার থামো, তোমার পড়াশুনার খবর বলো । তােমাকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে । বুড়ি বলে, ভাইয়া আর একটি কথা বলবো। আমি বললাম বলো। বুড়ি আনত নয়নে লজ্জা জড়িত কণ্ঠে বলে, আপু তোমার কথা বলে। আমি বললাম, আমার কথা কি বলে? বলতেই বুড়ি লজ্জায় লাল হয়ে বলে তুমি কিছু বুঝনা বলে দৌড়িয়ে পালায় । সোনারুর একটা কথা আজ আমার আর বুঝার বাকি রইল না। শুনেছি ওই মেয়েটা আমাকে চিঠিও নাকি দিয়েছে । কিন্তু বুড়ি আমার কাছে দেয়ার সাহস পায়নি। এতো দিন বুঝতে পারলাম সোনাবরুকে পড়ানোর ছলে আমাকে দেখাই তার মুল অভিপ্রায়। আসলে মেয়েরা নিজেরাই জানে না কখন কি চায়। সোনারুর রহস্যময় কথা আমি বুঝতে পারিনি সেটা কি আমার দোষ? আর যদি আমার দোষ হয় তাহলে আমি দোষীই। এখন বর্ষাকাল। বর্ষার প্লাবনে আর শ্রাবনের অঝর ধারায় মাঠ ঘাট ক্ষেত খামার পানিতে থই থই । নব-যৌবনা নদীর মতাে হাওড়, বিল, ক্ষেত, খামার নয়া পানিতে ভরে উঠেছে । যেমন করে শ্রাবণ ধারা বর্ষার আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে এলো তেমনি নববর্ষা মানিকের জমি চাষের কাজে ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিল । বর্ষায় মানিকের কোন কাজ নেই। রােজগারের পথ বন্ধ হওয়ায় সে। বাড়িতে অলস সময় কাটায়। এদিকে রােজগারের পথটি বন্ধ দেখে সখিনা বেগমের চলার পথ আরাে অন্ধকার হয়ে আসে। সোনাবরু এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠবে । পরীক্ষা দিয়েছে কেবল রেজাল্ট হওয়া বাকি। ফাইনাল পরীক্ষার ছুটির পর স্কুল খুলল । দৈবক্রমে সোনাবরুর জন্ম দিনে রেজাল্ট প্রকাশের তারিখ পড়েছে। আজ সােনাবরুর জন্ম দিন এবং বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আজই দিবে । ঘুম থেকে সকালে উঠে সোনাবরু ও জন্মদিন রেজাল্ট আজই দিবে। ঘুম থেকে সকালে ওঠে সােনাবরু । জন্মদিন ও রেজাল্টের আনন্দে চকিত চমকিত । খুব সকালে তৈরী হয়ে আজ একটু আগেই স্কুলে যায় সে। জন্ম দিন বলে কথা, স্কুলে গিয়ে দোকান থেকে একটি কেক কিনে এনে সহপাঠী ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদেরা নিয়ে সকালে স্কুলেই জন্মদিন পালন করে। রেজাল্টের আগে জন্ম দিনের আনন্দটা শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করে নিল সে। কিছুক্ষণ পড়ই রেজাল্ট প্রকাশিত হলাে। প্রথমে ঘােষিত হলো সোনাবরুর নাম। এবারও সে প্রথম হয়েছে। এবারে যেন অন্যরকম আনন্দ বয়ে নিয়ে এসেছে রেজাল্ট । যেন জন্ম দিনের উপহার। এদিকে সখিনা বেগম ছেলে অনিককে সাথে নিয়ে এক বাড়িতে কাজ করতে গেছে। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যা বেলা কাজের বিনিময়ে পাওয়া আড়াই সের চাল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সখিনা বেগম মনে মনে ভাবে যাই হােক অন্তত দুদিনের খাবার চলে যাবে এতে। মেয়ে স্কুল থেকে রেজাল্ট নিযে ফিরবে। মাকে ঘরে না দেখলে মন খারাপ করবে । সােনাবরু স্কুল থেকে এসে দেখে হাড়ি পাতলি খালি । সকালে কিছু খেয়ে যায়নি। স্কুলে যা একটু আধটু কেক খেয়েছে । জন্ম দিনেও ঘরে খাবার নেই, সােনাবরু মানতে পারেনি। দারিদ্যতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে আর পেরে উঠছেনা । এটুকুন বয়সে দারিদ্রতার সাথে লড়তে লড়তে হঠাৎ যেন থেমে গেছে। হঠাৎ যেন সে বড় হয়ে যায় । সন্ধ্যাবেলায় ঘর খালি পেয়ে দরজা বন্ধ করে গলায় ওড়না জড়িয়ে আত্মহত্যা করে সোনাবরু । হজন্ম দিনে কঠিন বাস্তবতা সােবনাবকে এই উপহার দিয়েছে । হত ভাগীনী মা এসে দেখে দরজা বন্ধ । দরজা বন্ধ দেখে মায়ের বুকটা হঠাৎ নাড়া দিয়ে ওঠে । দরজা খুলে দেখে মেয়ের মৃত দেহ ঝুলে আছে । রেজাল্ট হলে প্রতিবারে মা চুমোয় চুমোয় সােনাবরুকে ভরিয়ে দিত। আজ যেন মায়ের বুক থেকে হৃদপিন্ডটা কে যেন ছিড়ে নিল। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে যে মা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাঢ তবুও সন্তানের মুখে অন্ন যোগাতে তার শক্তির যোগান দিত সোনাবরু । সেই সোনাবরুর জন্ম দিনে দু:খিনী মাকে দারিদ্রতা সন্তানের মৃত্যু উপহার দিল।
আতাউর রহমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *