• Sun. Sep 15th, 2024

চাকরি
লিটন ঘোষ জয়া

চাকরিটা খুব প্রয়োজন চঞ্চলের। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় চঞ্চল। মেজ ও সেজ দুই ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। সবার ছােট বােন জবা কেবল মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী । চঞ্চল গত বছর আইএ পাস করেছে। আজকালকার দিনে ইন্টারমিডিয়েট পাসে চাকরি পাওয়া যায় না। এটা চঞ্চল বেশ ভাল করেই জানে। তবুও চেষ্টা তো করা যেতে পারে! চঞ্চল মনে মনে এও ভাবে এখন চাকরি পাওয়া মানে হচ্ছে-আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মত ব্যাপার। যদিও তা মামা খালু অথবা টাকার জোরে মিলে যায়। এমনটাই হয়েছিল তাদের চেয়ারম্যান খালেক উদ্দিনের ছেলে জাহাঙ্গীরের বেলায়। একটা নয় পর পর তিন-চারটা চাকরি পেয়েছিল জাহাঙ্গীর। তবে তার একটাও সে করেনি। কারণ, উচ্চ শিক্ষার জন্য জাহাঙ্গীর বর্তমানে লন্ডন আছেন। জাহাঙ্গীর চঞ্চলের চেয়ে মােটেও ভাল ছাত্র না। বরং ওর চেয়ে। বরাবরই চঞ্চলের চেয়ে মোটেও ভাল ছাত্র না। বরং ওর চেয়ে। বরাবরই চঞ্চলের রেজাল্ট অনেক ভাল। অথচ সে আজ উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন আছে । টাকা পয়সার অভাবে ভাল রেজাল্ট থাকা । তার পড়াশোনার ইতি হয়ে গেছে । সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী পিতা আব্দুল মিয়া সামান্য একজন কৃষক। নিজেদের জমিজায়গা বলে বিশেষ কিছু নেই। মাত্র একফালি বসত ভিটাই সম্বল। মাঠে যেটুকু জমি ছিল তা তার পরীক্ষার ফিসের টাকার জন্য মহাজনের জিম্মায় আছে। মহাজন লোকজন দিয়ে তা দখল করে নিয়েছেন। পরের জমিতে এখন আব্দুল মিয়া কামলা খাটে। মাঝেমধ্যে চঞ্চলও তার বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করতে যায় । তবে এভাবে আর কতদিন! এই হাড়-ভাঙা খাটুনি তার আর ভাল লাগে না। শালার মহাজনটাও সুযোগ বুঝে আব্দুল মিয়ার কাছ থেকে কায়দা করে জমিটা লিখিয়ে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে মহাজনের নাক একঘুষি দিয়ে থেতলে দিতে। চঞ্চল একটা চাকরির জন্য দিনের পর দিন চেষ্টা করে যাচ্ছে। কবে পাবে চাকরি! আর কবে গুজবে পারছে না। তার ভীষণ খিদে লেগেছে। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে তাদের দুর্দশা? রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ও নিরবে কাঁদে । কখনো বা ঘর থেকে বেরিয়ে । তারপর সিক্ত দৃষ্টিতে দেখে আবছা প্রকৃতিটাকে। ওর নামে একটা ইন্টারভিউকার্ড এসেছে । ডাক পিয়নের কাছ থেকে চঞ্চলের মা চিঠিটা হাতে পেয়ে মনে মনে খুশিতে নেচে উঠল। ভেবে নিল এবার বুঝি তার ছেলের চাকরিটা… কিন্তু তার সে খুশি বেশিক্ষণ আর স্থায়ী থাকেনি। চঞ্চল যখন বলল, মা এটা ইন্টারভিউকার্ড । মা অত-শত বোঝে না। চঞ্চল যখন বলল, মা এই সব কার্ড-ফার্ডে কোন চাকরি-টাকরি হয় না। যাদের চাকরি হবার দেখ গিয়ে তাদের আগে-ভাগেই হয়ে রয়েছে। আজকাল টাকা পয়সা ছাড়া চাকরি হয় না মা। ছেলের মুখে এসব কথা শুনে মূহুর্তের মধ্যে মার হাস্যউজ্জল মুখটা মলিন হল। চঞ্চল এক বুক আশা নিয়ে রওনা হল ইন্টারভিউ দেবার জন্য মার কাছ থেকে দুইশত টাকা নিয়ে। হয়তো এবার নিশ্চিয় তার চাকরি হবেই, হবে! সে যে টাকাটা নিয়ে বেরিযেছে। এই দুইশো টাকা যোগার করার জন্য ভোরে চঞ্চলের মা দশসের ধান পাশের বাড়ির ফারুকের বউ নিলুফার কাছে বিক্রি করেছে। ধান বেচতে গেলে নিলুফা বলল, আপা টাকাটা আপনি নিয়ে যান ধার হিসাবে । পরে সময় করে শোধ করে দিয়েন । এই সব ধান-টান কিছু দেয়া লাগবে না। ওগুলো আপনি নিয়ে যান। কিন্তু চঞ্চলের মা কোন ভাবেই রাজি হয়নি। কেননা, পরে যদি টাকাটা শোধ করতে না চঞ্চল মনে মনে ঠিক করল চাকরির প্রথম মাসের বেতন পেয়ে মার জন্য একটা শাড়ি, বাবার জন্য লুঙ্গি আর ছোট ভাইবোনদের জন্য জামা কিনবে । ভাবতে ভাবতে বাস স্টান্ডে এসে থামল । অন্য সবার মত চঞ্চল ও গাড়ি থকে নামল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে লাগল ইন্টারভিউ অফিসের ঠিকানা। একটা রিক্সায় উঠলে হয় তাকে এত কষ্ট করে অফিস খুঁজতে হত না। রিক্সায় উঠলে করে অফিস খুঁজতে হত না। রিক্সায় উঠলে বিশ টাকা খরচ হবে! অবশেষে অফিসটা খুঁজে পাওয়া গেল । ইন্টারভিউ এক প্রকার ভালই হয়েছে। ভর দুপুরের আবার ও হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু চঞ্চল আর হাঁটতে অফিস খুঁজতে হত না। রিক্সায় উঠলে বিশ টাকা খরচ হবে! অবশেষে অফিসটা খুঁজে পাওয়া গেল । ইন্টারভিউ এক প্রকার ভালই হয়েছে। ভর দুপুরের আবার ও হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু চঞ্চল আর হাঁটতে পারছে না। তার ভীষণ খিদে লেগেছে। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে এক পা ও হাঁটতে পারছে না সে। মাথাটা ঝিন-ঝিন করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা হােটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর অনেক ভেবে চিন্তে ডাল ভাত খাওয়ার জন্য হােটেলে ঢুকল। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখল হােটেলের বয় তার সামনে রাখা টেবিলের উপর ভাত, মাছ ও মাংস সাজিয়ে ফেলেছে। চঞ্চল তার সামনে রাখা খাবারগুলো দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে মাছ মাংস কোনটা খাবে সে। কারণ, এত টাকা তার কাছে নেই। ডান হাতটা পকেটে ঢুকাল রুমাল বের করে মুখটা মুছার জন্য। কিন্তু পকেটে হাত দিতেই চমকে উঠল সে। এ কি টাকাটা গেল কোথায়? এই পকেটেই তো রেখেছিলাম! অসহায়ের মত বেশ কয়েকবার পকেটগুলো হাতরাতে লাগল । কিন্তু টাকার কোন হদিস পেল না। তাহলে কি পকেট মার হয়ে গেছে? মাথাটা নিচু করে আস্তে
বাসস্টান্ডে এসে টিকিট কেটে বাসে চেপে বসল। বাস চলতে শুরু করেছে । ও বাসের জানলা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিটাকে দেখছে। মনে হচ্ছে সে এর আগে কখনো প্রকৃতি দেখেনি। ভেতরটা কেমন যেন কেঁদে ওঠে দোকানদার লোকটার কথা ভেবে। সত্যি লােকটা যেন পৃথিবীর অন্য দশজন মানুষের । চেয়ে আলাদা। ইস! জগতের সব মানুষই যদি এমন হত তাহলে… । হঠাৎ উল্টা দিক থেকে আসা একটা ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাসটা দুমড়ে মুচড়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। অনেক লোকজন ছিটকে এখানে সেখানে পড়ে আছে। সেখানে পড়ে আছে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় চঞ্চলের রক্তাক্ত শরীরটা। লােকজন তা দেখার জন্য দলে দলে ভীড় জমিয়েছে। তাদের সবার মুখে একই কথা। ছেলেটা কে, ছেলেটা কে? তখন মাথার উপর একঝাক কাক একবার আসছে, আর একবার যাচ্ছে। থেকে থেকে তারা কা-কা-কা করে ডাকছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *